সড়ক দুর্ঘটনা-ভুলটা সামান্য কিন্তু ক্ষতিটা? by এবিএম জামাল

মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ট্যাক্সি ক্যাবচালক। সামনের রেলক্রসিং, অতিরিক্ত মনোযোগ দাবি করে সেটি খেয়াল করার সময় কোথায়। রেলগেট নেই। ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল গাড়ি। নিমেষেই শেষ কয়েকটি তাজা প্রাণ।


আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না চলন্ত অবস্থায় কথা বলার অভ্যাস

অফিসের কাজে মিটিংয়ে যাচ্ছিলেন ডলার। রোকেয়া সরণি ধরে শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নামবেন। বাসের চালক রাস্তার মাঝখানে গাড়ি স্লো করলেন। ঝুঁকি নিয়েই নামতে বাধ্য হলেন তিনি। আরেকটি ধাবমান বাস ড্রাইভার বামদিক দিয়ে দ্রুত ওভারটেক করছিলেন। মাথায় আঘাত পেয়ে লুটিয়ে পড়লেন তৎক্ষণাৎ। জ্ঞান হারালেন। নাক, কান, মুখ দিয়ে তীব্র রক্তক্ষরণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্রুত অপারেশন শেষে তিনি আইসিইউতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার পর চিরবিদায় নিলেন। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চলে না_ এ তো জানা কথা। তীব্র যানজট, অপ্রশস্ত রাস্তা, অতিরিক্ত যানবাহন, ট্রাফিক আইনকানুন মেনে চলার অনীহা। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ঢাকার রাস্তার বাস কখনও থামে না। বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি হলেই হেলপারের হাঁকডাক 'ওস্তাদ স্লো করেন'। কখনও বলেন না থামান। 'স্লো করেন'। ওই অবস্থায়ই আমাদের বাসে উঠতে হয়, নামতে হয়। মানে নামতে-উঠতে বাধ্য হই। ডলারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ভুলটা সামান্য, গাড়ি পুরোপুরি থামেনি এবং বামপাশ দিয়ে না গিয়ে স্লো করছিল। দ্বিতীয় বাসটির চালকের ভুলটাও সামান্য। বামপাশ দিয়ে গিয়ে অন্য গাড়িকে ওভারটেক করছিল। ক্ষতিটা?
সাদা দাগকে আমরা সাদা মনেই নিই! :রাস্তায় বিশেষ করে হাইওয়েতে তিন ধরনের সাদা দাগ দেখতে পাওয়া যায়। একটি রাস্তার মাঝ বরাবর বিরতি দিয়ে দেওয়া সাদা দাগ, যেখানে ওভারটেক করা যাবে। বিরতিহীন সাদা দাগ, যে জায়গায় কোনো অবস্থায়ই ওভারটেক করা যাবে না। জেব্রাক্রসিং। যেখানে পথচারীদের প্রয়োজনে যানবাহনের গতি সীমিত করতে হবে। করার কথা। কোনো অবস্থাতেই মাঝখানের সাদা দাগ অতিক্রম করে অপরপাশে যাওয়া যাবে না। হাইওয়ের চালকরা থোড়াই কেয়ার করেন। সামান্য বৃষ্টি। সোজা রাস্তা। বিশালদেহী বাসের চালক সাদা দাগ অতিক্রম করে মাঝ বরাবর দ্রুতগতিতে চালালেন। সজোরে আঘাত করলেন মাইক্রোবাসকে। তারেক-মিশুক মুনীরের সৃজনশীলতা রক্ত-মাংসের পিণ্ড হয়ে গড়াগড়ি খেল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। ভুলটা সামান্য, চালক সাদা মনেই সাদা দাগ অতিক্রম করে চালাচ্ছিলেন! ক্ষতিটা?
নির্দেশনা তো শুধু নির্দেশনাই :অফিসের কাজেই সরকারের সর্বোচ্চ পদস্থ দু'জন আমলা ঢাকা-পাটুরিয়া সড়ক ধরে যাচ্ছিলেন। শক্ত পাজেরো গাড়ি। দক্ষ সরকারি চালক। নিরাপত্তার মানদণ্ডে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে থেকে সমকোণে বেরিয়ে গেছে যে পাটুরিয়া ঘাট সড়ক, সেখানে কোনো সড়ক নির্দেশনা ছিল না। যাওবা ছিল কৌণিক কারণে এবং গাছপালার আড়ালে তা দৃষ্টিগোচর হয় না। দ্রুতগামী বাস আছড়ে পড়ল শক্ত দেহের পাজেরোর ওপর। স্পট ডেথ। ভুলটা সামান্য : সড়ক নির্দেশনা তো শুধু নির্দেশনাই! ইচ্ছা হলে দিলাম, ইচ্ছা হলে পড়লাম, ইচ্ছা হলে মানলাম। ক্ষতিটা?
আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজপথে :বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে দিনাজপুর থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলেন মেডিকেল কলেজের সার্জারির দু'জন অধ্যাপক। কাকডাকা ভোর। বৃষ্টিবিঘি্নত পিচ্ছিল রাজপথে একটু দ্রুতই হয়তো চালাচ্ছিলেন মাইক্রোবাস চালক। হঠাৎ মাঝ রাস্তায় চলে আসা ভ্যান গাড়িকে বাঁচাতে মাইক্রোটি নিয়ন্ত্রণ হারাল। বিপরীত দিকের দ্রুতগামী ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ। তৎক্ষণাৎ ঝরে গেল কয়েকটি তাজা প্রাণ। অপারেশন করে দুর্ঘটনায় আহতদের প্রাণ বাঁচানো যাদের নিত্য কাজ, তারাই খবর হয়ে গেলেন। ভুলগুলো সামান্য : ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, দ্রুতগতি, বৃষ্টিবিঘি্নত পিচ্ছিল পথের অবিবেচনা, অযান্ত্রিক গাড়ির হাইওয়েতে চলা। ক্ষতিটা?
নিরাপত্তাবোধ নিজের জন্য, অন্যেরটা ভাবে কে :মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ট্যাক্সি ক্যাবচালক। সামনের রেলক্রসিং, অতিরিক্ত মনোযোগ দাবি করে সেটি খেয়াল করার সময় কোথায়। রেলগেট নেই। ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল গাড়ি। নিমেষেই শেষ কয়েকটি তাজা প্রাণ। আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না চলন্ত অবস্থায় কথা বলার অভ্যাস। কথাই বলে, কথার নাকি দাম নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে কথার কী দাম! আর আমরা অবিবেচকের মতো ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিচ্ছি কথার মূল্য কত বেশি হতে পারে। ক্ষতিটা?
সবাই ভুলের ভুক্তভোগী :পাথরবোঝাই অচল ট্রাক সারাচ্ছিলেন ড্রাইভার আর তার দুই সহযোগী। মাতুয়াইল পার হয়ে বিশ্বরোডের ওপরই কাজটি শেষ করতে চাচ্ছিলেন। ট্রাকের এক্সেলের নিচে শুয়ে কাজ করছিলেন তিনজনই। দ্রুতগামী অন্য একটি ট্রাকের ধাক্কায় তিনজনেরই মৃত্যু। করুণ এবং বীভৎস! সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে যে ট্রাফিক সার্জন কর্তব্য পালন করছিলেন, তিনি কি আর জানতেন সব কর্তব্য থেকে তাকে মুক্তি দেবে কোনো এক চালকের আপাত অসতর্কতা। কাগজপত্র পরীক্ষা করতে করতে নিজেই খবরের কাগজের 'একদিনের' খবর হয়ে গেলেন।
ভুল, অন্যায়, অপরাধ :আমরা আমাদের সামান্য (আসলে সামান্য নয়) ভুলগুলো এভাবে প্রতিনিয়ত করে যেতে থাকলে প্রায়ই তা অন্যের (এমনকি নিজেরও) প্রাণহানির কারণ হতে পরে। ভুলগুলো সামান্যই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন। শতকে একটা, হাজারে একটা, লাখে একটা দুর্ঘটনায় গিয়ে পেঁৗছায়। মানছি। ক্ষতিটা যার, তার কিন্তু শতভাগ। আর যখন কেউ কেউ ভুলগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন না করে প্রশ্রয় দেওয়ার অন্যায় পথ ধরেন, তখন তা অপরাধের পর্যায়ে পেঁৗছায়। অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করাও একধরনের অপরাধ। প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে ভুলের পসরা সাজিয়ে আমরা রাতদিন অতিবাহিত করছি আর ভাবছি_ 'কই, কিছু হচ্ছে না তো!', 'অত নিয়মকানুন কে মানে,' 'ছোটখাট ভুল করাই যায়'। আমরা পথচারীরা ভুল করছি অহরহ (৩৭% সড়ক দুর্ঘটনার শিকার), চালক এবং সহযোগী (২৫%), যাত্রী (২০%), আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ, রাস্তা প্রস্তুত এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী, হাইওয়ে পুলিশ, আমলা। কে নয়। একটুখানি ভুলের তোড়ে অনেক বিপদ ঘটে। ভুল করছি আমরা সবাই ভুক্তভোগী সবে। শুরুটা 'সবে' থেকেই করতে হবে। দায়িত্বটাও সবাইকেই নিতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শুধু চালককে 'বিড়াল' বানিয়ে গলায় ঘণ্টা বাঁধার চেষ্টা করলে খুব বেশি লাভ যে হচ্ছে না তা তো দেখাই যাচ্ছে। কেউ নিয়ম মেনে চলে না, আমি মেনে কি লাভ, তা না হয়ে যদি এমন হয় 'আমি সবসময় মেনে চলি, অন্যরা মানুক বা না মানুক, তাহলেই একদিন অনেক আমি আমরা হয়ে উঠব।' আইন তৈরি, আইন প্রয়োগ, আইনের শাসন_ এগুলো দেখা যাদের দায়িত্ব তাদের ভুল করার বা শৈথিল্য দেখানোর কোনো সুযোগই নেই। আসুন আমরা আমাদের 'সামান্য ভুলগুলো' অসামান্য দৃঢ়তার সঙ্গে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করি।

ডা. এবিএম জামাল :চিকিৎসক
 

No comments

Powered by Blogger.