সা ক্ষা ৎ কা র-জনপ্রিয় সাহিত্যের বিস্তার বেশি দরকার by পবিত্র সরকার

পবিত্র সরকার, শিক্ষাবিদ। লেখালেখি করেন উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধসহ বিবিধ বিষয়ে। বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা ভাষা ও বাংলা বানান নিয়ে রয়েছে তাঁর দীর্ঘ গবেষণা। নাটক, সংগীতচর্চাতেও তিনি নিরলস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের সার্ধশত বর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন ঢাকায়।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজল রশীদ

প্রশ্ন: বাংলাদেশে আপনার এবারের আগমণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষের (৬ মে ২০১২) সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দান করার জন্য। অনুষ্ঠান আপনি ‘হে মহাজীবন, হে মহামরণ’ শিরোনমে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এই অনুষ্ঠান আপনার প্রত্যাশা কতটা পূরণ করেছে?
পবিত্র সরকার: সামগ্রিক অনুষ্ঠানটা আমার খুবই ভাল লেগেছে। এর দুটি মাত্রা ছিল। একটি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক মাত্রা। অন্যটি হচ্ছে রাজনৈতিক মাত্রা। ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক মাত্রাটা ছিল। যদিও রবীন্দ্রনাথ উপলক্ষ, কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক এখানে মুখ্য। দুই দেশের সম্পর্ককে আরও উন্নত করার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ যেমন। আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও তেমনই আগ্রহ দেখালেন। আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে আশা করব, এই সম্পর্কটা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ হোক। এবং দুই দেশ এটাকে উন্নত করার জন্য সব রকম সমস্যা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ান এবং সমাধান করুন। তিস্তার জলবণ্টন প্রসঙ্গে সত্যি সত্যি আমি কোন সমস্যা দেখি না। তারপরেও কেন জানি না, রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে তিস্তা নিয়ে, পদ্মা নিয়ে।
প্রশ্ন: সাংস্কৃতিক দিকটা নিয়ে বলেন?
পবিত্র সরকার: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পুরোটাই বিশেষ করে সাজানোর দিকটা আমার অনেক বেশি ভাল লেগেছে। শর্মিলা ঠাকুর যে অত ভাল আবৃত্তি করেন, এখানে এসে বুঝলাম। কবিতা নির্বাচনটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশিওয়ালা’ উনি অনেক সুন্দর আবৃত্তি করেছেন। এখানে এসে আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম রবীন্দ্র ভারতীয় জয় জয়কার। এখানকার-ওখানকার মিলে ওদেরকেই বেশি করে চোখে পড়ল। অধ্যাপক ফখরুল আলম ‘ রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড ইকো কনশাসনেস’ শিরোনামের প্রবন্ধটাও বেশ চিত্তাকর্ষক ছিল।
প্রশ্ন: অনুষ্ঠানে যা কিছু হলো, এর বাইরেও কি আপনার কোন প্রত্যাশা ছিল।
পবিত্র সরকার: আমি শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হবে এই অনুষ্ঠানে, কিন্তু দেওয়া হয়নি। হয়তো পরবর্তীতে সময়ে হবে। আমি ঠিক জানি না। তবে সাধারণ মানুষ এই কথাগুলো বলছিল। শিল্পকলা একাডেমীতে সন্ধ্যা বেলায় একটা অনুষ্ঠান ছিল, যা আমাকে কিছুটা হতাশ করেছে। যা মান সম্পন্ন মনে হয়নি। এমন কয়েকজন শিল্পী এসেছিলেন, যাদের গলায় সুর অতোটা নেই।
বাংলাদেশে এলে দেখি পশ্চিম বাংলার চেয়ে এখানে বোধ হয় সবকিছুর চর্চা একটু বেশি আন্তরিক ভাবেই হচ্ছে। কি নাচে, কি নাটকে, কি সাহিত্যে, কি গানে। অনেকের কাছে এই বিচারটা একপেশে মনে হতে পারে, কিন্তু আমার এমনটাই মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনি নাটকেরও লোক। সরাসরি নাট্যদলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রচনা, নির্দেশনা, নিয়মিত সমালোচনা লেখার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন। আপনার কি মনে হয়, নাট্যচর্চায় আমাদের অবস্থান কতোটা সন্তোষজনক?
পবিত্র সরকার: আমার মনে হয়, ভাল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের নাট্যচর্চা অনেকখানি এগিয়েছে। এ ব্যাপারে আমার ধারণা খুব স্পষ্ট। কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের নাটকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটা অনেক বেশি। এই কারণে নয় যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই কারণে যে, বাংলাদেশ নাটকের কারুকলার দিকে যেমন ভাবছে, তেমনি নাটককে জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়টিও প্রতিনিয়ত ভাবছে।
অর্থাৎ নাটকের বিষয় ও শরীর এই দুটো দিকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। সেলিম আল দীনের কথা তো বলাই যায়। অন্যান্য নাট্যকাররাও ভাল করছে। দায়বদ্ধতার দিকটি যেমন আছে, তেমনি শরীর নিয়েও বিস্তর ভাবনা চিন্তা হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিক্ষার দিক দিয়ে আপনার দৃষ্টিতে দুই দেশের ফারাকটা কেমন?
পবিত্র সরকার: একটা বিষয় লক্ষনীয়। দুই দেশেই বেসরকারি শিক্ষাটা রমরমা চলছে।
প্রশ্ন: এতে কি শিক্ষাটা কুফলে যাচ্ছে?
পবিত্র সরকার: তাই কি? এটা হচ্ছে, বড় লোকদের শিক্ষা ব্যবস্থা। বলতো পারেন, গণতন্ত্রের দিক থেকে শিক্ষার সুযোগ, পয়সা দিতে পারলে শিক্ষাটা কিনে নিতে পারবে।
প্রশ্ন: সার্টিফিকেট সর্বস্ব লেখাপড়ার অভিযোগ রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি।
পবিত্র সরকার: হ্যাঁ অনেক সময় সার্টিফিকেট সর্বস্ব এবং সার্টিফিকেট বিক্রির একটা জায়গা হয়ে যায় কোন কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ওখানে বেশ কিছু কলেজ আছে। যেখানে সার্টিফিকেট বিক্রি হয় বলা যায়।
এ কারণে আমি মনে করি, সরকারি উপস্থিতি শিক্ষাক্ষেত্রে থাকা দরকার। গরীব মানুষ দুদেশেই প্রচুর। তারা অল্প পয়সায় উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পায়, এই সুযোগটা থাকা দরকার। যেটা দুজায়গাতেই সংকুচিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে কতটা হচ্ছে জানি না, তবে ভারতে সেই চেষ্টাটা করা হচ্ছে। নানা রকম আবোল-তাবোল কর্মসূচি প্রণীত হচ্ছে। ভারতে যেমন পাশ ফেল তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশ ফেল তুলে দেওয়ার যুক্তি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের স্কুলে রাখা, অর্থাৎ ড্রপআউটের সংখ্যা কমানো। কিন্তু এর একটা কুফল হচ্ছে, লেখাপড়ার ওপর জোরটা কম হচ্ছে। কেউ বলছে না আমরা আরও ভাল করে শেখাতে চাই। এই লক্ষ্যটা আড়ালে পড়ে গেছে। শুধু এই কথাটা নিয়ে চালাচালি হচ্ছে যে, পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: পাঠ্যক্রমের প্রতি কোন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না?
পবিত্র সরকার: পাঠ্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, পরীক্ষা-পদ্ধতি সংশোধন করাটা জরুরি। পরীক্ষাটা আর ভয়ের জিনিস রাখবো না। ছেলেমেয়েরা পরীক্ষাটা আনন্দের সঙ্গে দেবে। এবং সেই ভাবে একটা পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি করা দরকার। কিন্তু সেই দিকে তো কারো চেষ্টা নেই। খুব একটা কৃতিত্ব নেওয়া হচ্ছে যে, পাসফেল তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের নতুন হাওয়া যে, শিক্ষানীতি ‘রাইট ফর এডুকেশন’ সেখানে সারা ভারতে পাশ ফেল তুলে দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: মৈত্রী বন্ধন, রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে। এটাকে কিভাবে আরও নিবিড় করা যায়, একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ করা যায়, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোকে?
পবিত্র সরকার: রবীন্দ্রনাথ একটা উপলক্ষ। আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথকে একমাত্র উপলক্ষ করলে অন্যান্য বন্ধনগুলো খানিকটা অবহেলা করা হয়। আমি মনে করি, নজরুল আর একটি বন্ধন। আমাদের প্রত্যেক বড় লেখকই আমাদের দুই বাংলার উত্তরাধিকার। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন আমাদের উত্তরাধিকার, সতীনাথ ভাদুড়িও আমাদের উত্তরাধিকার। এক্ষেত্রে আমার কাছে দুই বাংলাকেই সচেতন বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ তাদেরকে নিয়ে দুজায়গাতেই গবেষণা সহ আরও নানারকম কাজ হচ্ছে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর কথায় ধরা যাক এখানে ওখানে দুজায়গাতেই পাঠ্যক্রমে তিনি আছেন। তাঁকে নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণাও হচ্ছে।
প্রশ্ন: আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের কোন লেখকের রচনা কি আপনাদের ওখানে পাঠ্য করা হয়েছে?
পবিত্র সরকার: হ্যাঁ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পাঠ্য। নাট্যকার হিসেবে সেলিম আল দীন পাঠ্য। বাংলাদেশের সাহিত্য আমাদের ওখানে পাঠ করা হচ্ছে, এবং আধুনিক লেখকেরাও এর মধ্যে রয়েছে। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, নাটক এগুলো আমাদের উভয়েরই উত্তরাধিকার। এই সাংস্কৃতিক বন্ধনটা আরও মজবুত করা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই মাথার ওপরে আছেন। কিন্তু শুধু রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই নয়, আমার মনে হয়, অন্য বন্ধনগুলোর দিকেও নজর দেওয়া দরকর।
প্রশ্ন: আপনি দেখেছেন নিশ্চয়, টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং প্রথম আলো মৈত্রী বন্ধন নামে নানারকম কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
পবিত্র সরকার: হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখেছি। একটা অনুষ্ঠানে আমার থাকার কথা ছিল। আমি বাংলাদেশে চলে এলাম বলে থাকতে পারলাম না। এটা খুব ভাল একটা ব্যাপার। প্রথম দিকে খুব বেশি সাড়া না মিললেও, আস্তে আস্তে এটা একটা ঐতিহ্যে পরিণত হবে।
প্রশ্ন: আপনি অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে বাংলা বানান নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এটা সম্পর্কে বলুন।
পবিত্র সরকার: বাংলা বানান নিয়ে বাংলা একাডেমীর সঙ্গে যে কাজটা করেছি, সেটা যে অভিনব, অর্থাৎ অতীতের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে করেছি তা কিন্তু নয়। এর আগে বড় কাজ করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৩৬ সালে। তারপর আনন্দবাজার পত্রিকাও নিজের মতো করে কিছু কাজ করেছে। আমরাও সেই সব মূল স্রোতের সঙ্গে থেকেই কিছু কিছু কাজ করেছি। বাংলা একাডেমী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার সঙ্গে শতকরা ৯৫ ভাগ, কিংবা তারও বেশি মিল আছে। ফলে, বানান সংস্কারের যে প্রবণতা সেটা সকলেই গ্রহণ করেছে। আমরাও সেটাকে গ্রহণ করে এগিয়েছি মাত্র। এটা মোটামুটিভাবে গৃহীত হয়েছে।
প্রশ্ন: কাজটা কি উভয় বাংলার সঙ্গে যৌথ ভাবে হয়েছে?
পবিত্র সরকার: না যৌথভাবে নয়। এরা আলাদাভাবে করেছে। আলাদা করলেও আমাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল। ফলে, উভয়ের বানান নীতি অনেকটাই এক।
প্রশ্ন: দুই বাংলার সাহিত্য নিয়ে বলুন?
পবিত্র সরকার: দেখো আমি সাহিত্য সম্পর্কে বলার যোগ্য নই। তার কারণ হচ্ছে, আমি এখন সাহিত্যের চেয়ে ভাষা বিজ্ঞান নিয়ে, ব্যাকরণ নিয়ে চর্চাটা বেশি করছি। সাহিত্য পড়ছি, যেমন ধরো ইসমত চুকতাইয়ের আত্মজীবনী। উভয় বাংলার সাহিত্যের বৈচিত্র্য আমার কাছে অসাধারণ লাগে। জনপ্রিয় সাহিত্যেরও আমি একজন মুগ্ধ পাঠক। হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল—এই দুইভাই ছাড়াও জনপ্রিয় অনেক সাহিত্যিকের লেখাই আমি পড়ি। আমি মনে করি, জনপ্রিয় সাহিত্যের বিস্তার বেশি দরকার। জনপ্রিয় সাহিত্যই পাঠক সংখ্যা বাড়ায়। এবং এই পাঠকেরাই পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় সাহিত্য ছাড়াও অন্য ধরনের সাহিত্য পাঠে মনোযোগি হয়।
আমার বলতে ভাল লাগে, আমার নাতি পড়া শেখার পর প্রথম বইটি পড়েছে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘ভূতের বাচ্চা কটকটি’। জীবনের প্রথম বই পড়ল পরপর তিনবার, বাংলাদেশের একজন লেখকের। আমি মনে করি, এই সুযোগ পশ্চিমবাংলার সকল শিশুদেরই পাওয়া উচিত। এখানকার শিশুসাহিত্য বেশভাল হচ্ছে। বড়দের সাহিত্যও ভাল হচ্ছে। আমি সাধারণভাবে যা জানি তাই বললাম। বিশেষজ্ঞের মতো করে কিছু বলতে পারব না।
প্রশ্ন: বর্তমানে ভাষার যে দুরবস্থা যাচ্ছে—এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
পবিত্র সরকার: হা হা হা। ‘নদী দূষণ ভাষা দূষণ’ লেখাটা আমি পড়েছি। এটা শুধু বাংলার সমস্যা নয়, মারাঠি, তামিল সবজায়গাতেই এই অবস্থা চলছে। এটা হচ্ছে একটা বিশেষ শ্রেণীর ভাষা ব্যবহারের লক্ষণ। এই শ্রেণীটা ইংরেজি ব্যবহার করে। পারঙ্গম না হলেও ব্যবহার করতে চায়। ভাষাগুলো শক্তির ভিত্তিতে সাজানো। যাদের বেশি শক্তি সেই ভাষাটা আমাদের আকর্ষণ করে বেশি। কম শক্তির ভাষাটা আমরা লুকোতে চাই। দৃষ্টান্তটা বলি, মধুসূদনের একটা নাটক ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ তাতে এক বন্ধু দেরি করে এসেছে বলে আরেক বন্ধু তাকে লায়ার বলেছে। সে ভীষণ রেগে গিয়ে বলছে আমি তোমাকে শ্যুট করব। আমাকে বাংলায় মিথ্যাবাদী বললে না কেন? তাতে কোন শালা রাগ করতো? তাই বলে লায়ার? এ কি সহ্য হয়। এই থেকে বোঝা যায়, ইংরেজি ভাষার ক্ষমতাটা কত। এই ক্ষমতার জন্যই আমরা ইংরেজি ভাষাটা অনেক সময় অবান্তরভাবে ব্যবহার করি। এই অ্যাকচুয়ালি, আসলের জায়গায় প্রাকটিক্যালি এসব আমরা শুধু শুধু ব্যবহার করি। শহর-গ্রাম সকল নাগরিকের মধ্যে এই মূল্যবোধটা তৈরি হতে হবে, সে যা করছে ঠিক করছে না। ভুল করছে। সবার ভেতরে এই চেতনাটা আসা দরকার। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম খুব ভাল কাজ করেছে এই প্রবন্ধটা লিখে।
প্রশ্ন: এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি?
পবিত্র সরকার: সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাবা-মাদের, কলকাতাতেও দেখা যায় সন্তান যদি বলে, মা আমি একটা বিড়াল দেখেছি। মা তখন রাগ করে। উনি চান, সন্তান বলুক মা আমি একটা ক্যাট দেখেছি। মা-বাবাদের বুঝতে হবে, ইংরেজি শেখার জন্য বাংলাকে ভুলিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। দুটো ভাষা ছেলেমেয়েরা আলাদাভাবে শিখতে পারে। আবার পাশাপাশিও শিখতে পারে। এটা বাচ্চাদের নয়, মা-বাবা আর কিছু শিক্ষকদের দোষ। যারা বাচ্চাদের বলে, বাড়িতে গিয়েও বাংলা বলবে না, ইংরেজি বলবে। এটা ডিরেক্ট ম্যাথড বলে একটা বাতিল মেথড। যেখানে বলা হচ্ছে সব সময় ইংরেজি বলবে। এই থিওরীটাই ভুল। এটা শেখাতে হবে। দেখো বাংলা ভুলিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।
প্রশ্ন: এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা থাকতে পারে?
পবিত্র সরকার: হ্যাঁ পারে। বিচার ব্যবস্থা এগিয়ে এসেছে। বইপত্র বাংলায় করাটা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। একটা হচ্ছে শেখানো। আরেকটা হচ্ছে দেখানো। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু একটা ভাষা দিয়ে চলবে না। এমনকি আমেরিকাতেও এম এ করতে হলে দুটো অন্য ভাষা শিখতে হয়। পিএইচডি করতে হলে তিনটে অন্য ভাষা শিখতে হয়। কারণ তুমি যখন রেফারেন্স বইগুলো পড়বে, তখন অন্যভাষার বইগুলো পড়ার যোগ্যতা থাকতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিটা কোথায়?
পবিত্র সরকার: নিরক্ষর মানুষকে লেখাপড়া শেখানো এবং প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি জোর দেওয়া। এই শিক্ষাটা শক্তিশালী করা। এটা নেই। আমার কাছে যা সবচেয়ে বড় ত্রুটি বলে মনে হয়। প্রাথমিক শিক্ষাটা শক্তিশালী হলে পরবর্তী ধাপগুলো আস্তে আস্তে নিজেরা সামলে নিতে পারবে। আমার মনে হয়, আমরা ভুল জায়গায় জোর দিচ্ছি। উচ্চশিক্ষায় যতটা দিচ্ছি প্রাথমিকে ততটা নয়। শিক্ষণ ব্যবস্থার প্রতি, শিক্ষা পদ্ধতির প্রতি, শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে, কি সম্পর্ক তৈরি করবে সেটা ঠিক যুক্তিযুক্ত হচ্ছে না।
প্রশ্ন: সকলেরই তো স্বপ্ন থাকে, আপনার স্বপ্নের কথা বলুন।
পবিত্র সরকার: স্বপ্ন হলো, সকলেই খাবার পাক, জল পাক, একটু মাথার ওপর ছাউনি পাক। এটা হচ্ছে প্রাথমিক স্বপ্ন। আমি তাতে কোন ভূমিকা নিতে পারি না। আমি শুধুই স্বপ্নই দেখতে পারি। আর আমি পাশে থেকে একটু মাস্টারি করে যেটুকু করেছি, সেটা হলো ছাত্র তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে আমার প্রার্থনা, যে মানুষগুলোর এই অভাব থেকে গেছে, সেই অভাবগুলোপূর্ণ হোক। আর একটা চাই, নিরাপত্তা ও শান্তি। ছোট পরিবারে হলেও আমরা যদি ভারত-বাংলাদেশ মিলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে সেটা হবে অনেক বড় কাজ। এটাই আমার স্বপ্ন।

No comments

Powered by Blogger.