স্মরণ-মৃত্যুঞ্জয়ী ব্রিগেডিয়ার জামিল আহমেদ by মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ
‘বঙ্গবন্ধুর এই একজন আপনজনের কথা আমরা ১৫ আগস্ট যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করি না, এই সত্যটুকু সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। এত বড় আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি জাতি এখনো দেয়নি। একটি রাষ্ট্রীয় খেতাব তাঁর কপালে জোটেনি। কোনো আলোচনা সভায়, প্রবন্ধে ও স্মৃতিচারণায় তাঁর নামটি আসে না।
আত্মীয়স্বজন ও আপনজন ছাড়া কেউ তাঁর কবর জিয়ারত করেন না, ফুলের তোড়া দেন না।’
এ কথাগুলো অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা তাঁর ১৯৯৭ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত ‘এসেছিলো শুধু একজন’ শীর্ষক প্রবন্ধে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন চারদিক থেকে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে সাহায্য চেয়েছিলেন অনেকেরই কাছে। সেদিন সেই অমোঘ লগ্নে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেননি তাঁর সিপাহসালার কিংবা উপ-সিপাহসালাররা। সাড়া দেননি তাঁরই একান্ত আগ্রহে সৃষ্ট রক্ষীবাহিনীর প্রধান কিংবা উপদেষ্টারা। এটা কেমন করে সম্ভব হলো যে এঁদের কেউই ৫০ জন সেনা নিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতির প্রাণরক্ষায় এগিয়ে এলেন না? কোথায় ছিল দেশের সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো? তারা কেন এমন নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিল?
যা হোক, সেদিন সবার দুয়ারে ধাক্কা দিয়েও তাদের ঘুম ভাঙাতে পারেননি একটি স্বাধীন দেশের প্রধান স্থপতি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কেউ আসেননি। কেউ কেউ ঘুমিয়েছিলেন, কেউ বা জেগে ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু এসেছিলেন একজন—বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব এবং পরে ডিজিএফআইয়ের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জামিল আহমেদ। অকুতোভয়ে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। ঘাতকদের কালো মুখোশ তাঁকে বিচলিত করেনি, নির্ভয়ে তিনি তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই আনুগত্য ও কর্তব্যবোধ নিশ্চয়ই তাদের অপরাধী আত্মাকে নাড়া দিয়েছিল, যারা লুকিয়েছিল প্রাণের ভয়ে কিংবা ইচ্ছা করে। শহীদ জামিল আহমেদ প্রাণের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছিলেন। অন্তত একজন সৈনিক সেদিন দেশের রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছিলেন, এটাই সম্ভবত সামরিক বাহিনীকে চরম লজ্জা ও আত্মগ্লানির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
নিয়োগের সময় প্রত্যেক সামরিক অফিসারকে যে শপথ নিতে হয় তা হলো, ‘আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আমি আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারের আদেশ পালনার্থে জলপথ, স্থল বা আকাশপথে আমাকে যেখানেই যেতে বলা হবে, আমি সেখানেই যাব।’ এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে কোনো কোনো সামরিক অফিসার অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার জামিল আহমেদ তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটুট ছিলেন বলেই প্রাণ দিয়ে তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন।
১৫ আগস্ট শেষরাতে ব্রিগেডিয়ার জামিল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে টেলিফোন পান। তিনি তখন ডিফেন্স ফোর্সের ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক। টেলিফোনে তিনি সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট প্রধানদের বঙ্গবন্ধুর টেলিফোনের কথা জানিয়ে দেন। তাঁরাও তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। কিন্তু কার্যত কাউকে এগিয়ে না আসতে দেখে তিনি নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যান। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তিনি বাধাগ্রস্ত হন। কৌতূহলী একদল সাধারণ মানুষ তাঁকে ৩২ নম্বরের দিকে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্রিগেডিয়ার জামিল তাঁদের কথা না শুনে এগিয়ে গেলেন। ভাবলেন, অস্ত্র দিয়ে নয়, যুক্তিতর্ক দিয়ে তিনি বিদ্রোহী সৈনিকদের বোঝাতে পারবেন। বিদ্রোহীরা তাঁকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার জামিল ফিরে যাওয়ার মতো অপমানকে মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং সৈনিকদের উপেক্ষা করে তিনি ভেতরে ঢুকতে গেলেন। আর সে সময়ই আততায়ীর গুলি তাঁর সমস্ত শরীর ঝাঁজরা করে দেয়।
ব্রিগেডিয়ার জামিলের মৃত্যুর মুহূর্তে কি মনে পড়েছিল তাঁর স্ত্রী ও তিনটি প্রাণপ্রিয় সন্তানের কথা? হয়তো পড়েছিল, হয়তো একবার দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়মুখগুলো। ব্যক্তিগত জীবনে এই সৌম্যকান্তি, বিনয়ী মানুষটি বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, কর্তব্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠায় নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, সেদিন সেই ভয়াল মুহূর্তে অন্তত একজন ছিলেন, যিনি মৃত্যুকে ভয় না করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জামিলের স্মৃতি অমর হোক। শহীদের কোনো মৃত্যু নেই। ব্রিগেডিয়ার জামিল মৃত্যুহীন।
এ কথাগুলো অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা তাঁর ১৯৯৭ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত ‘এসেছিলো শুধু একজন’ শীর্ষক প্রবন্ধে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন চারদিক থেকে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে সাহায্য চেয়েছিলেন অনেকেরই কাছে। সেদিন সেই অমোঘ লগ্নে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেননি তাঁর সিপাহসালার কিংবা উপ-সিপাহসালাররা। সাড়া দেননি তাঁরই একান্ত আগ্রহে সৃষ্ট রক্ষীবাহিনীর প্রধান কিংবা উপদেষ্টারা। এটা কেমন করে সম্ভব হলো যে এঁদের কেউই ৫০ জন সেনা নিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতির প্রাণরক্ষায় এগিয়ে এলেন না? কোথায় ছিল দেশের সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো? তারা কেন এমন নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিল?
যা হোক, সেদিন সবার দুয়ারে ধাক্কা দিয়েও তাদের ঘুম ভাঙাতে পারেননি একটি স্বাধীন দেশের প্রধান স্থপতি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কেউ আসেননি। কেউ কেউ ঘুমিয়েছিলেন, কেউ বা জেগে ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু এসেছিলেন একজন—বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব এবং পরে ডিজিএফআইয়ের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জামিল আহমেদ। অকুতোভয়ে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। ঘাতকদের কালো মুখোশ তাঁকে বিচলিত করেনি, নির্ভয়ে তিনি তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই আনুগত্য ও কর্তব্যবোধ নিশ্চয়ই তাদের অপরাধী আত্মাকে নাড়া দিয়েছিল, যারা লুকিয়েছিল প্রাণের ভয়ে কিংবা ইচ্ছা করে। শহীদ জামিল আহমেদ প্রাণের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছিলেন। অন্তত একজন সৈনিক সেদিন দেশের রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছিলেন, এটাই সম্ভবত সামরিক বাহিনীকে চরম লজ্জা ও আত্মগ্লানির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
নিয়োগের সময় প্রত্যেক সামরিক অফিসারকে যে শপথ নিতে হয় তা হলো, ‘আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আমি আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারের আদেশ পালনার্থে জলপথ, স্থল বা আকাশপথে আমাকে যেখানেই যেতে বলা হবে, আমি সেখানেই যাব।’ এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে কোনো কোনো সামরিক অফিসার অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার জামিল আহমেদ তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটুট ছিলেন বলেই প্রাণ দিয়ে তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন।
১৫ আগস্ট শেষরাতে ব্রিগেডিয়ার জামিল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে টেলিফোন পান। তিনি তখন ডিফেন্স ফোর্সের ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক। টেলিফোনে তিনি সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট প্রধানদের বঙ্গবন্ধুর টেলিফোনের কথা জানিয়ে দেন। তাঁরাও তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। কিন্তু কার্যত কাউকে এগিয়ে না আসতে দেখে তিনি নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যান। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তিনি বাধাগ্রস্ত হন। কৌতূহলী একদল সাধারণ মানুষ তাঁকে ৩২ নম্বরের দিকে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্রিগেডিয়ার জামিল তাঁদের কথা না শুনে এগিয়ে গেলেন। ভাবলেন, অস্ত্র দিয়ে নয়, যুক্তিতর্ক দিয়ে তিনি বিদ্রোহী সৈনিকদের বোঝাতে পারবেন। বিদ্রোহীরা তাঁকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার জামিল ফিরে যাওয়ার মতো অপমানকে মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং সৈনিকদের উপেক্ষা করে তিনি ভেতরে ঢুকতে গেলেন। আর সে সময়ই আততায়ীর গুলি তাঁর সমস্ত শরীর ঝাঁজরা করে দেয়।
ব্রিগেডিয়ার জামিলের মৃত্যুর মুহূর্তে কি মনে পড়েছিল তাঁর স্ত্রী ও তিনটি প্রাণপ্রিয় সন্তানের কথা? হয়তো পড়েছিল, হয়তো একবার দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়মুখগুলো। ব্যক্তিগত জীবনে এই সৌম্যকান্তি, বিনয়ী মানুষটি বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, কর্তব্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠায় নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, সেদিন সেই ভয়াল মুহূর্তে অন্তত একজন ছিলেন, যিনি মৃত্যুকে ভয় না করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জামিলের স্মৃতি অমর হোক। শহীদের কোনো মৃত্যু নেই। ব্রিগেডিয়ার জামিল মৃত্যুহীন।
No comments