লিমনের পঙ্গুত্ব ও র‌্যাবের বক্তব্য by এ এম এম শওকত আলী

র‌্যাবের ক্রসফায়ারে লিমন নামের তরুণ যুবক আজীবন পঙ্গু থাকবে। কারণ সে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। মিডিয়া প্রশংসনীয়ভাবে সত্য ঘটনা কী, তা জানার জন্য বিশ্লেষণধর্মী তথ্য প্রকাশ করে। এ ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘন তথা আইনের শাসন নিশ্চিত করার ব্যর্থতারই অনেক চিত্রের মধ্যে একটি।


ঘটনাটি এমন সময়ে আলোচিত হচ্ছে, যে সময় যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত সার্বিক চিত্র প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে বক্তব্য ছিল ভিন্নরূপ। বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের ভিত্তি অনেকাংশে স্পষ্ট। অন্যদিকে যেকোনো সশস্ত্র অপরাধ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সরকারি মহল থেকে বলা হয়, এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হলে বলা হয়, বাহিনীর সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। সন্ত্রাসীরা এই প্রক্রিয়ায় নিহত হলে আরো বলা হয়, সন্ত্রাসী নিহত হলেই মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলা হয়, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হলে সবাই নিশ্চুপ থাকে। অর্থাৎ এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না।
সংশ্লিষ্ট মহলের শীর্ষ কর্ণধাররা যখন এই যুক্তি প্রদর্শন করেন, তখন ধারণা করা যায়, আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত করার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করা হয়নি। তাহলে ধরে নিতে হবে যে এসব ঘটনারও কোনো ভিত্তি নেই। এ ধারণাও অমূলক। কারণ সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বিষয়টি ভিত্তিহীন, তা কোনো সময়ই বলেননি। যা বলছেন তা হলো, গুলি করা হয়েছে আত্মরক্ষার্থে। আত্মরক্ষা আইনসিদ্ধ। সরকারি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা প্রথমে জিরো টলারেন্স বা এ বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার কথা উচ্চারণ করে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। কিছুদিন পরই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে যান তাঁরা। তখনো তাঁরা বলেন, আত্মরক্ষার্থে গুলি করা হয়েছে। এ জন্য এটা আইনসিদ্ধ। অথচ এ সম্পর্কে আইন কি বলে কিছু দেশে ন্যাটো বাহিনীর গুলি বা বোমাবর্ষণে নিরীহ নাগরিকরা মৃত্যুবরণ করছে, সে অবস্থায় কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে না। এমনকি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তথ্য প্রদানে আগ্রহী মহাশক্তিশালী দেশটিও এ কথা বলে না।
মানবাধিকার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিচার হবে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় অভিযুক্ত বা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির অধিকার। তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বা অভিযুক্তের অধিকার একাধিক আইনে স্বীকৃত। সংশ্লিষ্ট বিধিতেও এ বিষয়ে বিস্তারিত বিধান রয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ের কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত আলোচনায় পাওয়া যায় না। এর ফলে আলোচনা অভিযোগ ও অভিযোগ অস্বীকার করা চক্রে আবদ্ধ হয়। ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, লিমনের ঘটনা তদন্তে পাঁচটি দল বা সংস্থা কাজ করছে। পাঁচটি দলই পৃথকভাবে তদন্ত করবে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট র‌্যাব সদস্য বা সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। লিমনের মা ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচার প্রার্থী হন। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট থানা কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। থানার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছুটি শেষে কাজে যোগদান করলে নির্দেশ পালন করা হবে। এ ধরনের আচরণ আদালত অবমাননারই শামিল। কারণ নির্দেশ পালন করবেন কর্তব্যরত কর্মকর্তা। প্রশ্ন হলো, আদালত অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর একাধিক তদন্ত কমিটির প্রয়োজন ছিল কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে পুলিশ বা র‌্যাবের বিধি অনুযায়ী এ ধরনের বিভাগীয় তদন্ত করা বেআইনি কিছু নয়। তবে আরো প্রশ্ন থেকে যায় যে একাধিক বিভাগীয় তদন্ত কেন? এমনটি ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। একাধিক তদন্ত দল গঠনের ফলে পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন পেশ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন হলে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। অন্যদিকে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী প্রচলিত আইনের আওতায় যে তদন্ত হবে, সেটাই হবে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায় সবাইকে মেনে নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী বিচারকসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা স্বীয় কর্তব্য পালন প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত হলে কোনো আদালত সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ না করে অভিযোগ আমলে নিতে ক্ষমতাবান নন। এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ আজ পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদে পাওয়া যায়নি। তবে আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট আদালত পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে অবশ্য অতীতে হাইকোর্টসহ সুপ্রিম কোর্টের কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে।
ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে কোনো ব্যক্তি নিহত হলে সরাসরি আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে হত্যার বিষয়টি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কাজেই শত শত নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিটিরই আত্মরক্ষার অজুহাত দেওয়া সমীচীন নয়। গ্রহণযোগ্য তো দূরের কথা। আইনে প্রাথমিকভাবে যে রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে তা হলো, আত্মরক্ষার জন্য গৃহীত কোনো কর্মকাণ্ড অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না। তবে প্রচলিত দণ্ডবিধি (চবহধষ ঈড়ফব) এ বিষয়ে একাধিক সীমাবদ্ধতাও আরোপ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি করার জন্য বা গুরুতর আঘাতের কোনো যৌক্তিক বা বিশ্বাসযোগ্য উপাদান না থাকলে আত্মরক্ষার বিষয় আইনসিদ্ধ নয়। এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে সরকারি কর্মকর্তার জন্যও যে প্রযোজ্য, তা-ও বলা হয়েছে। এখানে সরল বিশ্বাসে গৃহীত কর্মকাণ্ডের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু বা গুরুতর জখম হলে আত্মরক্ষার অজুহাত আইনের দৃষ্টিতে অচল। সংশ্লিষ্ট বিধিতে সরল বিশ্বাসের মূল উপাদান হলো উপযুক্ত সতর্কতা ও বিবেচনা। সাধারণ নাগরিক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অযৌক্তিকভাবে গুলি ছোড়ার কোনো আইনি অধিকার দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যই বিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন। তবে যে প্রক্রিয়ায় বা কাঠামোতে তদন্ত চালু করা হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রচলিত পুলিশ বিধিতে সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করলে দুই ধরনের তদন্ত করার নিয়ম স্বীকৃত ছিল। এক. নির্বাহী তদন্ত, দুই. বিভাগীয় তদন্ত। নির্বাহী তদন্তের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত পুলিশ বাহিনীর পদমর্যাদা অনুযায়ী তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষেত্রবিশেষে স্বয়ং এ কমিটির নেতৃত্ব দিতেন। এ নিয়ম বিধিতে আছে কিন্তু বাস্তবে প্রতিপালিত হয় না। এ নিয়ে সরকারেরও কোনো মাথাব্যথা নেই। এ ধরনের কমিটি গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা। অন্যদিকে সব মহানগরীতে এ-সংক্রান্ত বিষয় সংশ্লিষ্ট মহানগর পুলিশ আইনের দ্বারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। এসব স্থানে গুলি ছোড়ার ঘটনার তদন্ত হবে বিভাগীয় তদন্ত, নির্বাহী তদন্ত নয়।
এ কথা সত্য, কয়েক দশক ধরে প্রকৃত অবস্থা বিচার না করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোড়ার বিলাসিতায় লিপ্ত_এমনই ধারণা সুশীল সমাজের। ২০০২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যেসব ঘটনায় কথিত সন্ত্রাসীরা নিহত হয়েছে তার বিভাগীয় তদন্তের ফলাফল কেউ জানে না। সব সময় বলা হচ্ছে, আত্মরক্ষার জন্য গুলি করা হয়েছে। কিন্তু গুলি করা যৌক্তিক ছিল কি না তা জানার উপায় নেই। সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের ঘটনার পর বলা হচ্ছে, দোষী প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু শাস্তির কোনো নজির এখন পর্যন্ত জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এ কারণেই র‌্যাব অনেক প্রশংসনীয় কাজ করলেও বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের শিকার হচ্ছে। র‌্যাবের গ্রহণযোগ্যতাও হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজস্ব ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য র‌্যাবকে অধিকতর সচেষ্ট হতে হবে। সরকারের জন্য প্রয়োজন হবে প্রচলিত বিধি-বিধান পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে বিধি যুগোপযোগী করা। এ জন্য আইনসহ বিধিরও সংস্কার প্রয়োজন। সরকারের তথা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার জন্যও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.