কালের পুরাণ-নতুন বছর: স্বৈরাচার ও যুদ্ধাপরাধীকে না বলুন by সোহরাব হাসান
যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, বিদায়ী বছরটিতে বাংলাদেশের কোনো সাফল্য ছিল কি না? এর উত্তর অবশ্যই ইতিবাচক হবে। অনেক সাফল্য ছিল। আবার যদি প্রশ্ন করা হয়, ২০১০ সালে কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না? এর তালিকাও দীর্ঘ হবে।
সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েই মানুষের জীবন, প্রতিষ্ঠান ও দেশের পথচলা। ব্যক্তির ব্যর্থতায় দায় হয়তো তিনি নিজে বা পরিবারকে ভোগ করতে হয়। কিন্তু নেতৃত্বের ব্যর্থতার দায় ভোগ করতে হয় গোটা জাতিকে।
২০১০ সালে আমাদের সাফল্যের তালিকায় আছে তরুণ মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়, বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন, চিকিৎসাবিজ্ঞানী শুভ রায়ের কৃত্রিম কিডনি তৈরি এবং আরও অনেক কিছু। ২০১০ সালেই বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে। অর্থনীতিতে বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমাদের রপ্তানি-আয় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে, বেড়েছে কৃষি উৎপাদন, বেড়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও। এসবে সরকারের তেমন কৃতিত্ব নেই, যতটা কৃতিত্ব আছে ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের। প্রবাসী শ্রমিকেরা, দেশের সাধারণ কৃষক এবং তৈরি পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকেরা আমাদের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন। বছরের শুরুতে একটি লেখায় তাঁদের ‘তিন নায়ক’ বলে অভিহিত করেছিলাম। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায়, সরল নায়ক। এই সরল নায়কদের কথা রাষ্ট্র, সরকার এবং আমাদের মতো ভদ্রলোকেরা খুব একটা মনে রাখেন না। এর প্রমাণ বছর শেষে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা, সংঘর্ষ এবং পুলিশের গুলি ও আগুনে পুড়ে ২৬ শ্রমিকের মৃত্যু। এ দেশে সাধারণ মানুষের জীবন এতই তুচ্ছ যে ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে-কর্মস্থলে—কোথাও তাঁদের নিরাপত্তা নেই।
বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের শ্রম ও ঘামে রপ্তানি-আয় বাড়লেও তাঁদের ন্যূনতম বাঁচার জন্য যে মজুরি প্রয়োজন, তা দেওয়া হচ্ছে না। অনেক দেনদরবারের পর সরকার ন্যূনতম বেতন তিন হাজার টাকা করলেও অনেক কারখানার মালিক তা মানেননি। বাংলাদেশের মানুষ এখন সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। জেলখানায় তাদের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হচ্ছে। কারখানায়, সড়ক দুর্ঘটনায়, লঞ্চ দুর্ঘটনায় বেঘোরে তারা প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ ন্যূনতম অধিকার ও মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান হয়নি। নতুন শ্রমিক নেওয়া বন্ধ আছে অনেক দিন ধরে। প্রতিবারই মন্ত্রীরা-সচিবেরা সেসব দেশে লটবহর নিয়ে সফর করে এসে বলেন, আশ্বাস পাওয়া গেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী সৌদি বাদশাহর সঙ্গে আলোচনা করে বলেছিলেন, আকামা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হয়নি। মন্ত্রীরা কি জানেন, এই দুটি দেশসহ অনেক দেশে আমাদের শ্রমিকেরা কী মানবেতর জীবন যাপন করছেন? সেসব নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মাথাব্যথা নেই। সরকার খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সেনানিবাসের বাড়ি উদ্ধার করে বড় কৃতিত্ব জাহির করেছে। কিন্তু এই ঢাকা শহরে এবং ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে যাঁরা সরকারি বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? নেয়নি। আইন তো সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।
তবে বিদায়ী বছরে দুটি ক্ষেত্রে মহাজোট সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। এক, একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, দুই, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু। তবে তাও ভালোয় ভালোয় হয়েছে, বলা যাবে না। এসব নন্দিত কাজে যে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন, তার অনুপস্থিতি ছিল প্রবলভাবেই। শিক্ষানীতির ব্যাপারেও বিরোধী দলের আপত্তি ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনেও সরকার বাধা দিয়েছে। অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হামলা-মামলা হয়েছে। সব ব্যাপারে দুই পক্ষের বৈরিতা থাকলে দেশ চলবে কীভাবে?
যদি তিন বছর পর ক্ষমতার পালাবদল হয়, তাহলে কি শিক্ষানীতি বাতিল করা হবে? যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে? এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপির নেতাদের দিতে হবে। সরকারও অন্তত এ দুটি কাজে বিরোধী দলের সহায়তা নিতে পারত। কেউ কারও জায়গা থেকে এক চুল সরতে চায় না। তাহলে সমঝোতা হবে কী করে? যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে আইন অনুযায়ী। অতএব, এ নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের মাঠ গরম করার প্রয়োজন নেই। বরং জনগণকে বোঝাতে হবে, এটি দলের বিষয় নয়, সমগ্র দেশের।
২০১০ সালে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের সমস্যা, বেকারত্ব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বৈরিতা, সংঘাত ও অস্থিরতা। কোনো ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দল একমত হতে না পারলেও আলোচনা করতে অসুবিধা কোথায়? কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে পিএলও-ইসরায়েল বছরের পর বছর আলোচনা করতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো কথা নেই। আলোচনা নেই। আমরা ৩৯ বছর ধরে ঝগড়া করেছি, মারামারি করেছি, অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে গিয়ে নিজের নাক কেটেছি; তার পরও ক্ষান্ত হচ্ছি না। আমরা আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে কী আদর্শ রেখে যাচ্ছি?
২০১০ সালের প্রায় পুরোটা সময় রাজনৈতিক দলগুলো খামোখা বিতর্ক করেছে, একে অপরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। সরকার বলেছে, বিরোধী দল ষড়যন্ত্র করছে, জঙ্গিদের লালন করছে। আবার বিরোধী দল বলছে, সরকার তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এই যুদ্ধ কত দিন চলবে?
২০১০ সালে সরকারের অনেক সাফল্য আছে, তাই বলে ব্যর্থতার পাল্লাটি মোটেই হালকা নয়। সরকার একটি ভালো কাজ দিয়ে জনগণের আস্থা লাভ করলে, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ১০টি মন্দ কাজ করে সেই আস্থা ধুলায় মিলিয়ে দিয়েছে। আগে শিক্ষাঙ্গনে সংঘর্ষ হতো ছাত্রলীগ বনাম প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনে। এখন প্রতিদ্বন্দ্বীরা মাঠে নেই। তাই ছাত্রলীগ নিজেরই মারামারি করছে। যুবলীগ মারামারি করছে। বছরের শেষ দিনের আগের দিন ঝিনাইদহে আত্মঘাতী লড়াইয়ে খুন হয়েছেন যুবলীগের তিনজন কর্মী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই বলবেন না, এটি তারাই ঘটিয়েছে, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না।
বছরজুড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাহাস করেছে। কখনো বাড়ি নিয়ে, কখনো ভোট নিয়ে, কখনো মামলা নিয়ে। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে বিরোধী দল কোনো আন্দোলন করেনি। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ বর্জন করে চলেছে। অথচ বেতন-ভাতা ঠিকই নিচ্ছে। এটি অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য। আর সরকারি দল সংসদে আপন কৃতিত্ব ও মহিমায় এতটাই বিভোর যে বিরোধী দল এল কি গেল, তাদের কিছু আসে-যায় না।
২০১০ সালটি বাংলাদেশের জন্য আরেকটু ভালো হতে পারত; মানুষ আরেকটু ভালো থাকতে পারত। পারেনি মূলত বৈরী ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বঙ্গবন্ধুর পাঁচ ঘাতকের ফাঁসি হয়েছে। হাইকোর্ট দুটি ঐতিহাসিক রায়ে দুই সামরিক স্বৈরশাসকের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এসব ঘটনা সরকার ও বিরোধী দলের ঐক্য ও সমঝাতার ভিত্তি হতে পারত। অতীতে দুই দলই সামরিক শাসনের নিপীড়নের শিকার হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এমন তো নয়, এক স্বৈরশাসকের লাঠির বাড়ি কড়া ছিল, আরেক লাঠির বাড়ি মোলায়েম ছিল। এই প্রসঙ্গে প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক বদরুল হাসানের (প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের বড় ভাই ) একটি ঠাট্টার কথা বেশ মনে পড়ে। তিনি বলতেন, পত্রিকাগুলো পুলিশের মৃদু লাঠিপেটা করেছে বলে লিখে থাকে। পুলিশ প্রেমিকের মতো কখনো মৃদু বা মোলায়েমভাবে কর্মীদের শরীর স্পর্শ করে না। এক স্বৈরশাসক ‘হারাম’ হলে অন্যজন ‘হালাল’ হতে পারে না। দুই স্বৈরশাসককেই পরিত্যাগ করতে হবে। জিয়াউর রহমান বেঁচে নেই। কিন্তু এরশাদ এখনো বেঁচে আছেন। অতএব অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য তাঁর বিচার করতে হবে। এটা হলো গণতান্ত্রিক সরকারের প্রথম কর্তব্য। দ্বিতীয় কর্তব্যটি হবে নিজেদের শাসনে কোনোভাবেই যেন স্বৈরশাসনের ছায়া না পড়ে, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকা। মানুষ যাতে বলতে না পারে, ‘এর চেয়ে সামরিক শাসনই ভালো ছিল।’ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বড় ব্যর্থতা, তাঁরা সামরিক শাসন থেকে নিজেদের শাসনকে আলাদা করতে পারেননি।
২০১০ সালে আমরা সুস্থ রাজনীতি পাইনি। সুষ্ঠু ও সচল সংসদ পাইনি। কি সরকার, কি বিরোধী দল—কেউ জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করেনি। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সরকার বিরোধী দলকে ঘায়েল করতে সচেষ্ট ছিল, বিরোধী দল সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছিল। এই হাঁকডাকে আমরা ২০১০ সাল পার করেছি।
২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণ হবে। ইংরেজি দিনপঞ্জি ধরলে আজ ১ জানুয়ারি থেকেই সেই বছরটি শুরু হয়ে গেল। এই বছরে কি আমরা সরকার ও বিরোধী দলের কাছে ভালো কিছু চাইতে পারি না, পেতে পারি না? আমরা চাই, তাদের ভাষা, রীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসুক। ‘ওরা চোর’ কিংবা ‘এরা দেশ বেচে দিয়েছে’—এ ধরনের ঢালাও কথাবার্তা শুনতে চাই না।
আজ অবশেষে একটি ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে চাই, ২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছরে সরকার ও বিরোধী দল একটি সমঝোতা স্মারকে সই করুক। যাতে লেখা থাকবে, তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী ও স্বৈরশাসককে আশ্রয় দেবে না। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী দুই পক্ষই অপরাধী। একজনকে বাঁচিয়ে আরেকজনের বিচার গ্রহণযোগ্য হবে না।
সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নীতি ও আদর্শের যতই পার্থক্য থাকুক, অন্তত এই একটি বিষয়ে তারা একমত হতে পারে। অতীতে হয়েছে, বলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
২০১১ সালের প্রথম দিনটি গতকালের মতো না হোক। পুরো বছরটি ২০১০ সালের মতো হিংসা ও হানাহানিতে ভরা না থাক; ক্ষুধাকাতর মানুষের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী না হোক।
আসুন, ২০১১ সালে আমরা শপথ নিই, যুদ্ধাপরাধী ও স্বৈরশাসককে না বলি। তাদের সংস্রব এড়িয়ে চলি। এক পক্ষ স্বৈরশাসককে নিয়ে মাতামাতি করবে, আরেকপক্ষ যুদ্ধাপরাধীকে কোলে তুলে নেবে—সেটি সুস্থতার লক্ষণ নয়। গণতন্ত্র মানলে যুদ্ধাপরাধীকে বর্জন করুন। বর্জন করুন সাবেক স্বৈরশাসককেও।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
২০১০ সালে আমাদের সাফল্যের তালিকায় আছে তরুণ মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়, বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন, চিকিৎসাবিজ্ঞানী শুভ রায়ের কৃত্রিম কিডনি তৈরি এবং আরও অনেক কিছু। ২০১০ সালেই বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে। অর্থনীতিতে বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমাদের রপ্তানি-আয় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে, বেড়েছে কৃষি উৎপাদন, বেড়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও। এসবে সরকারের তেমন কৃতিত্ব নেই, যতটা কৃতিত্ব আছে ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের। প্রবাসী শ্রমিকেরা, দেশের সাধারণ কৃষক এবং তৈরি পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকেরা আমাদের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন। বছরের শুরুতে একটি লেখায় তাঁদের ‘তিন নায়ক’ বলে অভিহিত করেছিলাম। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায়, সরল নায়ক। এই সরল নায়কদের কথা রাষ্ট্র, সরকার এবং আমাদের মতো ভদ্রলোকেরা খুব একটা মনে রাখেন না। এর প্রমাণ বছর শেষে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা, সংঘর্ষ এবং পুলিশের গুলি ও আগুনে পুড়ে ২৬ শ্রমিকের মৃত্যু। এ দেশে সাধারণ মানুষের জীবন এতই তুচ্ছ যে ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে-কর্মস্থলে—কোথাও তাঁদের নিরাপত্তা নেই।
বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের শ্রম ও ঘামে রপ্তানি-আয় বাড়লেও তাঁদের ন্যূনতম বাঁচার জন্য যে মজুরি প্রয়োজন, তা দেওয়া হচ্ছে না। অনেক দেনদরবারের পর সরকার ন্যূনতম বেতন তিন হাজার টাকা করলেও অনেক কারখানার মালিক তা মানেননি। বাংলাদেশের মানুষ এখন সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। জেলখানায় তাদের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হচ্ছে। কারখানায়, সড়ক দুর্ঘটনায়, লঞ্চ দুর্ঘটনায় বেঘোরে তারা প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ ন্যূনতম অধিকার ও মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান হয়নি। নতুন শ্রমিক নেওয়া বন্ধ আছে অনেক দিন ধরে। প্রতিবারই মন্ত্রীরা-সচিবেরা সেসব দেশে লটবহর নিয়ে সফর করে এসে বলেন, আশ্বাস পাওয়া গেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী সৌদি বাদশাহর সঙ্গে আলোচনা করে বলেছিলেন, আকামা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হয়নি। মন্ত্রীরা কি জানেন, এই দুটি দেশসহ অনেক দেশে আমাদের শ্রমিকেরা কী মানবেতর জীবন যাপন করছেন? সেসব নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মাথাব্যথা নেই। সরকার খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সেনানিবাসের বাড়ি উদ্ধার করে বড় কৃতিত্ব জাহির করেছে। কিন্তু এই ঢাকা শহরে এবং ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে যাঁরা সরকারি বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? নেয়নি। আইন তো সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।
তবে বিদায়ী বছরে দুটি ক্ষেত্রে মহাজোট সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। এক, একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, দুই, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু। তবে তাও ভালোয় ভালোয় হয়েছে, বলা যাবে না। এসব নন্দিত কাজে যে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন, তার অনুপস্থিতি ছিল প্রবলভাবেই। শিক্ষানীতির ব্যাপারেও বিরোধী দলের আপত্তি ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনেও সরকার বাধা দিয়েছে। অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হামলা-মামলা হয়েছে। সব ব্যাপারে দুই পক্ষের বৈরিতা থাকলে দেশ চলবে কীভাবে?
যদি তিন বছর পর ক্ষমতার পালাবদল হয়, তাহলে কি শিক্ষানীতি বাতিল করা হবে? যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে? এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপির নেতাদের দিতে হবে। সরকারও অন্তত এ দুটি কাজে বিরোধী দলের সহায়তা নিতে পারত। কেউ কারও জায়গা থেকে এক চুল সরতে চায় না। তাহলে সমঝোতা হবে কী করে? যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে আইন অনুযায়ী। অতএব, এ নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের মাঠ গরম করার প্রয়োজন নেই। বরং জনগণকে বোঝাতে হবে, এটি দলের বিষয় নয়, সমগ্র দেশের।
২০১০ সালে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের সমস্যা, বেকারত্ব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বৈরিতা, সংঘাত ও অস্থিরতা। কোনো ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দল একমত হতে না পারলেও আলোচনা করতে অসুবিধা কোথায়? কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে পিএলও-ইসরায়েল বছরের পর বছর আলোচনা করতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো কথা নেই। আলোচনা নেই। আমরা ৩৯ বছর ধরে ঝগড়া করেছি, মারামারি করেছি, অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে গিয়ে নিজের নাক কেটেছি; তার পরও ক্ষান্ত হচ্ছি না। আমরা আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে কী আদর্শ রেখে যাচ্ছি?
২০১০ সালের প্রায় পুরোটা সময় রাজনৈতিক দলগুলো খামোখা বিতর্ক করেছে, একে অপরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। সরকার বলেছে, বিরোধী দল ষড়যন্ত্র করছে, জঙ্গিদের লালন করছে। আবার বিরোধী দল বলছে, সরকার তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এই যুদ্ধ কত দিন চলবে?
২০১০ সালে সরকারের অনেক সাফল্য আছে, তাই বলে ব্যর্থতার পাল্লাটি মোটেই হালকা নয়। সরকার একটি ভালো কাজ দিয়ে জনগণের আস্থা লাভ করলে, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ১০টি মন্দ কাজ করে সেই আস্থা ধুলায় মিলিয়ে দিয়েছে। আগে শিক্ষাঙ্গনে সংঘর্ষ হতো ছাত্রলীগ বনাম প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনে। এখন প্রতিদ্বন্দ্বীরা মাঠে নেই। তাই ছাত্রলীগ নিজেরই মারামারি করছে। যুবলীগ মারামারি করছে। বছরের শেষ দিনের আগের দিন ঝিনাইদহে আত্মঘাতী লড়াইয়ে খুন হয়েছেন যুবলীগের তিনজন কর্মী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই বলবেন না, এটি তারাই ঘটিয়েছে, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না।
বছরজুড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাহাস করেছে। কখনো বাড়ি নিয়ে, কখনো ভোট নিয়ে, কখনো মামলা নিয়ে। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে বিরোধী দল কোনো আন্দোলন করেনি। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ বর্জন করে চলেছে। অথচ বেতন-ভাতা ঠিকই নিচ্ছে। এটি অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য। আর সরকারি দল সংসদে আপন কৃতিত্ব ও মহিমায় এতটাই বিভোর যে বিরোধী দল এল কি গেল, তাদের কিছু আসে-যায় না।
২০১০ সালটি বাংলাদেশের জন্য আরেকটু ভালো হতে পারত; মানুষ আরেকটু ভালো থাকতে পারত। পারেনি মূলত বৈরী ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বঙ্গবন্ধুর পাঁচ ঘাতকের ফাঁসি হয়েছে। হাইকোর্ট দুটি ঐতিহাসিক রায়ে দুই সামরিক স্বৈরশাসকের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এসব ঘটনা সরকার ও বিরোধী দলের ঐক্য ও সমঝাতার ভিত্তি হতে পারত। অতীতে দুই দলই সামরিক শাসনের নিপীড়নের শিকার হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এমন তো নয়, এক স্বৈরশাসকের লাঠির বাড়ি কড়া ছিল, আরেক লাঠির বাড়ি মোলায়েম ছিল। এই প্রসঙ্গে প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক বদরুল হাসানের (প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের বড় ভাই ) একটি ঠাট্টার কথা বেশ মনে পড়ে। তিনি বলতেন, পত্রিকাগুলো পুলিশের মৃদু লাঠিপেটা করেছে বলে লিখে থাকে। পুলিশ প্রেমিকের মতো কখনো মৃদু বা মোলায়েমভাবে কর্মীদের শরীর স্পর্শ করে না। এক স্বৈরশাসক ‘হারাম’ হলে অন্যজন ‘হালাল’ হতে পারে না। দুই স্বৈরশাসককেই পরিত্যাগ করতে হবে। জিয়াউর রহমান বেঁচে নেই। কিন্তু এরশাদ এখনো বেঁচে আছেন। অতএব অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য তাঁর বিচার করতে হবে। এটা হলো গণতান্ত্রিক সরকারের প্রথম কর্তব্য। দ্বিতীয় কর্তব্যটি হবে নিজেদের শাসনে কোনোভাবেই যেন স্বৈরশাসনের ছায়া না পড়ে, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকা। মানুষ যাতে বলতে না পারে, ‘এর চেয়ে সামরিক শাসনই ভালো ছিল।’ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বড় ব্যর্থতা, তাঁরা সামরিক শাসন থেকে নিজেদের শাসনকে আলাদা করতে পারেননি।
২০১০ সালে আমরা সুস্থ রাজনীতি পাইনি। সুষ্ঠু ও সচল সংসদ পাইনি। কি সরকার, কি বিরোধী দল—কেউ জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করেনি। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সরকার বিরোধী দলকে ঘায়েল করতে সচেষ্ট ছিল, বিরোধী দল সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছিল। এই হাঁকডাকে আমরা ২০১০ সাল পার করেছি।
২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণ হবে। ইংরেজি দিনপঞ্জি ধরলে আজ ১ জানুয়ারি থেকেই সেই বছরটি শুরু হয়ে গেল। এই বছরে কি আমরা সরকার ও বিরোধী দলের কাছে ভালো কিছু চাইতে পারি না, পেতে পারি না? আমরা চাই, তাদের ভাষা, রীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসুক। ‘ওরা চোর’ কিংবা ‘এরা দেশ বেচে দিয়েছে’—এ ধরনের ঢালাও কথাবার্তা শুনতে চাই না।
আজ অবশেষে একটি ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে চাই, ২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছরে সরকার ও বিরোধী দল একটি সমঝোতা স্মারকে সই করুক। যাতে লেখা থাকবে, তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী ও স্বৈরশাসককে আশ্রয় দেবে না। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী দুই পক্ষই অপরাধী। একজনকে বাঁচিয়ে আরেকজনের বিচার গ্রহণযোগ্য হবে না।
সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নীতি ও আদর্শের যতই পার্থক্য থাকুক, অন্তত এই একটি বিষয়ে তারা একমত হতে পারে। অতীতে হয়েছে, বলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
২০১১ সালের প্রথম দিনটি গতকালের মতো না হোক। পুরো বছরটি ২০১০ সালের মতো হিংসা ও হানাহানিতে ভরা না থাক; ক্ষুধাকাতর মানুষের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী না হোক।
আসুন, ২০১১ সালে আমরা শপথ নিই, যুদ্ধাপরাধী ও স্বৈরশাসককে না বলি। তাদের সংস্রব এড়িয়ে চলি। এক পক্ষ স্বৈরশাসককে নিয়ে মাতামাতি করবে, আরেকপক্ষ যুদ্ধাপরাধীকে কোলে তুলে নেবে—সেটি সুস্থতার লক্ষণ নয়। গণতন্ত্র মানলে যুদ্ধাপরাধীকে বর্জন করুন। বর্জন করুন সাবেক স্বৈরশাসককেও।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments