রাজনীতি-চেনা পথ ধরে, গোলকধাঁধার জগতে! by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করছি, যখনই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অর্জন ঘটে, অর্থনীতি শক্তি সঞ্চয় এবং শান্তি ও স্থিতি বিরাজ করে তখনই বিভিন্ন অপশক্তি মাঠে নেমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে উঠেপড়ে লাগে। এসব অপশক্তির অস্তিত্ব-উপস্থিতি রাজনৈতিক দলের ভেতরে আছে, বাইরেও আছে।
সরকারের কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, আইনের অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন সচেষ্ট হতে দেখি না
বিএনপির সিলেট জেলার সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান বা গুম হওয়ার ঘটনায় দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা একদিকে যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত তেমনি অবধারিত। অবধারিত বলছি এ কারণে যে, কয়েক মাস ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান অস্থিরতার সর্বশেষ ঢেউই বর্তমানের সংকট। সরকার যখন উচ্চ আদালতের রায়ের অংশবিশেষ বাস্তবায়ন করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তখনই বোঝা গিয়েছিল যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেটা মানবে না। এ ইস্যু নিয়ে তারা মাঠে নামবে এবং সেটা সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত চলবে। ইতিমধ্যে তারা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরুর ঘোষণাও দিতে থাকে। মাঝে বিএনপি এবং তার মিত্ররা জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী দীর্ঘ সময় ধরে তার বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পান। কিন্তু এ অবস্থান যে শুধুু জাতীয় সংসদ সদস্য পদ বজায় রাখার জন্য সেটা দেশবাসীর কাছে দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায়।
গত কয়েক মাস ধরেই সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীরা সভা-সমাবেশে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করছেন, যা এমনকি বিরোধীদের সংসদে সীমিত সময়ের উপস্থিতির সময়ও প্রকাশ পায় এবং তাতে শালীনতার সীমারেখা মানার কোনো পক্ষই চেষ্টা করেনি। এটা থেকেও স্পষ্ট হয় যে, দেশ চলেছে সংঘাতের পথে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে সুশীল সমাজ, এমনকি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মতো রাজনৈতিক নেতাও ফর্মুলা হাজির করেন। কিন্তু না সরকার, না বিরোধী দল_ কারও কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিএনপি মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় বড় ধরনের রাজনৈতিক সমাবেশ করেছিল। সেখান থেকে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য তিন মাসের আলটিমেটাম প্রদান করা হয়। আমার মতো অনেকেই ধরে নিই যে, এ সময়ের মধ্যে বিএনপি হয়তো বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদান করবে না। এর পরিবর্তে দেখা যাবে জেলা বা বিভাগ পর্যায়ে সভা-সমাবেশ এবং রোডমার্চের মতো জনবান্ধব কর্মসূচি।
ইতিমধ্যে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস এবং রেলের পদস্থ একজন কর্মকর্তার বিপুল অঙ্কের অর্থসহ পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে মধ্যরাতের নাটকীয় ঘটনা এবং রেলওয়েতে নিয়োগ-বাণিজ্য বিষয়ে তার জড়িত থাকার অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গন কয়েকদিন উত্তপ্ত ছিল। বিরোধী দল এ জন্য শুধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নয়, গোটা সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। প্রধানমন্ত্রী রেলমন্ত্রীকে গণভবনে ডেকে পদত্যাগ করতে বললে তিনি তাতে সম্মত হন এবং সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দিলে জনগণ তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করায় সরকারের ভাবমূর্তি প্রকৃতই পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটে_ রাজধানী থেকে ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যান। এ ঘটনার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ইস্যু সম্পর্কিত_ এমন অভিমত কোনো কোনো সংবাদপত্রে দেখেছি। এ মুহূর্তে এর সত্যাসত্য নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, তবে এমন যোগসূত্র থাকলে সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে মোটেই অসঙ্গত বা বেমানান মনে হবে না। একই সঙ্গে এটাও বলব যে, এর ফলে সুস্থ ধারায় রাজনীতির পথে উত্তরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি হলো এবং তা পরিবর্তনের জন্য নিশ্চিতভাবেই অনেক মূল্য শুধুু রাজনৈতিক দলগুলোকে নয়, দেশকেও দিতে হবে।
বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি নতুন নয় এবং ইলিয়াস আলীর গুম কিংবা অপহরণের মূলে সেটাই। এ প্রতিহিংসার অনেক ভয়ঙ্কর চিত্র নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের পর থেকেই আমরা দেখে অভ্যস্ত। এইচএম এরশাদের জমানার পতনের পর বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে ক্ষমতায় আসে। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে বিএনপি ফের ক্ষমতায় আসে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সক্রিয় জোট বেঁধে। এ সময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়াকে এক জনসভায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। একে একে ঘটে আরও ভয়ঙ্কর সব ঘটনা_ টঙ্গীর জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার খুন হন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ অন্তত ২৪ জন। সে সময়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আহত হন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিপুলসংখ্যক কর্মী ও সমর্থক। এর ধারাবাহিকতা চলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পরও। রাজধানীর সুপরিচিত বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। গুম-খুনের ঘটনা নিয়মিতই সংবাদপত্রে আসতে থাকে। তবে এসবের কোনোটিই ইলিয়াস আলীর ঘটনার মতো রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করেনি। এ ঘটনাটি আমাদের বিশেষভাবে শঙ্কিত করে। সমকাল ও যুগান্তরসহ আরও কোনো কোনো পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ইলিয়াস আলীকে সরকারেরই কোনো সংস্থা আটক রেখেছে। তাকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য কয়েক দফা শর্ত দেওয়া হয়েছে এবং এ নিয়ে পরিবার ও বিএনপির সঙ্গে দেনদরবার চলছে। ২৩ এপ্রিল বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ইলিয়াস আলী সরকারেরই কোনো সংস্থার জিম্মায় জীবিত ও সুস্থ রয়েছেন। আশা করব, দ্রুততম সময়ে এ নাটকের অবসান ঘটবে এবং তাতেই তার পরিবার ও দেশবাসীর স্বস্তি।
বাংলাদেশে যে কোনো ব্যক্তির সংবিধান ও প্রচলিত আইন-কানুন মেনে রাজনীতি করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ অধিকার যাতে প্রত্যেকে বাধাহীনভাবে প্রয়োগ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। দুই যুগ আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে দেখছি যে, সে অধিকার রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের এক শ্রেণীর নেতাকর্মীর অসহিষ্ণুতা ও জিঘাংসার কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। অনেকে অত্যাচারিত হয়েছেন ও হচ্ছেন এবং কেউ কেউ উধাও হয়ে গেছেন। নিরাপত্তার জন্য দেশান্তরী হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। কিন্তু নির্বাচনে ভোট দেয়নি, এ অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। সম্প্রতি সাতক্ষীরা এলাকায় সংখ্যালঘুদের মন্দির এবং সহায়সম্পদ আক্রান্ত হয়েছে এবং এর পেছনে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের সক্রিয়তা রয়েছে বলে সংবাদপত্রে দেখেছি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করছি, যখনই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অর্জন ঘটে, অর্থনীতি শক্তি সঞ্চয় এবং শান্তি ও স্থিতি বিরাজ করে তখনই বিভিন্ন অপশক্তি মাঠে নেমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে উঠেপড়ে লাগে। এসব অপশক্তির অস্তিত্ব-উপস্থিতি রাজনৈতিক দলের ভেতরে আছে, বাইরেও আছে। সরকারের কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, আইনের অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন সচেষ্ট হতে দেখি না। বরং নিজ দলের দুষ্কৃতকারীদের আশকারা দিয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনা পরিস্থিতিকে ক্রমশ খারাপের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। ইলিয়াস আলী অপহরণ বা গুম প্রমাণ করে, যে কোনো মাপের রাজনৈতিক নেতাকর্মীই এখন আর নিরাপদ নন। যদি এ ঘটনায় সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে সব দায় তাদেরই নিতে হবে। আর যদি এমন কোনো চক্র সরকারের অজ্ঞাতে এ অপরাধ সংঘটিত করে থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করা এবং জড়িতদের কঠোর শাস্তি বিধান করাও তাদেরই দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করে সরকার তার অপহরণের দায় এড়াতে চাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটি অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা। এ ঘটনায় দেশব্যাপী যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের একমাত্র উপায় তাকে খুঁজে বের করা।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ ঘটনাটিকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা পরপর তিনদিন হরতাল দিয়েছে এবং এর যুক্তি হচ্ছে সরকারকে চাপে রাখতে হবে। এভাবে মুক্তি ত্বরান্বিত করাও তাদের লক্ষ্য। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় হরতাল যে কার্যকর পন্থা নয়, নিতান্তই ধ্বংসাত্মক ও আত্মঘাতী সেটা বিএনপির নেতা-নেত্রীরা ভালো করেই জানেন। তারা ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক হরতাল-অবরোধ মোকাবেলা করেছেন। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনাও দুই দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আন্দোলনের চাপে তার সরকার কোনো ছাড় দেয়নি এবং এখনও দিচ্ছে না। তিনদিন হরতালের পরও তাদের তরফে এমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি, যা থেকে বলা যায় 'সফল হরতাল' কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা-সংলাপের প্রয়োজন ছিল, হরতাল নয়। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করলে তিনি 'নিখোঁজ' ঘটনায় সরকারের তরফে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আমি বিশ্বাস করি, বিএনপি যদি আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতেন, ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে মানববন্ধনের আয়োজন করা হতো এবং এ ধরনের আরও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হতো তাতেই সরকারের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হতো। দেশের বাইরেও তার প্রতিক্রিয়া বেশি হতো। বিএনপি একের পর এক হরতাল দিচ্ছে। তাতে সরকারের ওপর যতটা না তার চেয়ে ঢের বেশি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে জনগণের ওপর। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা হরতাল জনজীবন ও অর্থনীতির ক্ষতিকর বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আর বিরোধী দলে গেলেই বেমালুম সেটা ভুলে যায়। কিন্তু ভুক্তভোগী জনগণ জানে যে এ ধরনের কর্মসূচি আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষতি করে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায়, শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে রাখে। হরতালের কারণে এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ইতিমধ্যে দু'দিন স্থগিত করা হয়েছে। যদি আরও হরতাল দেওয়া হয় তাহলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ বিষয়টিকে বিএনপির সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা উচিত। হরতাল মানুষকে সহিংস করে। পার্কিং করা বাসে আগুন দিয়ে ভেতরে ঘুমন্ত চালককে পুড়িয়ে মারা, দুর্ঘটনায় আরেক ক্যাবচালকের মৃত্যু, ইলিয়াস আলীর নিজ উপজেলা বিশ্বনাথে দু'জনের মৃত্যু_ এসব প্রাণের দায়িত্ব কেউ নেবে না। তাদের পরিবারের পাশে সহানুভূতির হাত বাড়ানো হবে না। যে রাজনৈতিক কর্মসূচি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণ কেড়ে নেয়, মানুষকে সহিংস করে তোলে তার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে যে তারা জনগণের জন্য কাজ করছে। তাহলে এটা নিশ্চয়ই বোঝা উচিত। একটি সংবাদপত্রের ছবিতে দেখেছি, বিএনপির একজন মহিলা কর্মী ইট হাতে তেড়ে যাচ্ছেন একটি ইজিবাইকের দিকে। আমি নিশ্চিত যে, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সন্ত্রাসী নন। টেলিভিশন সংবাদচিত্রে দেখানো হয়েছে রামদা-লাঠি হাতে হরতাল সমর্থকরা ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করছে। তারা প্রতিদিন নিশ্চয়ই এ ধরনের সহিংস আচরণ করে না। হরতালের রাজনীতি গণতান্ত্রিক আচরণের পরিপন্থী। এ রাজনীতি সহিংস প্রতিশোধস্পৃহা ও ধ্বংসাত্মক। মঙ্গলবার টিভি পর্দায় একটি প্রাইভেট গাড়িতে আগুন দেওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এটা দেখে রাজনীতিকদের মনে নিশ্চয়ই বিমলানন্দ উদ্রেক হয় না। কিন্তু আমাদের এখন বিশ্বাস করতেই হয় যে এমন দৃশ্য তাদের প্রকৃত আনন্দ দেয়। তা না হলে হরতালের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে এসে জনসভা-মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি বেশি বেশি করে কেন গ্রহণ করা হয় না? তারা কি দেশপ্রেমের জন্য নাকি দল ও আত্মপ্রেমের রাজনীতি করেন? আদর্শ ও শুভচিন্তা ভুলে গিয়ে সহিংসতার পথে চললে তার বলি হতে হয় প্রথমত সাধারণ মানুষকে এবং এ প্রক্রিয়ায় কোনো এক সময়ে সেই নেতারাই এর শিকার হন। ২১ আগস্টের ঘটনাই সৃষ্টি করে ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' রহস্য। একটি থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। আমাদের রাজনীতি থেকে যদি গুম-অপহরণ-সন্ত্রাস দূর করতে চাই তাহলে অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে সহনশীল রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন। এ রাজনীতির ভিত্তি হবে আলোচনা-সংলাপ-সচল জাতীয় সংসদ। দলগুলোর পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সর্বোপরি গণতান্ত্রিক আচরণের বিকল্প নেই।
এখন শঙ্কা জাগে. এ পথে আপাতত চলার লক্ষণ দেখি না বলে। বরং হরতালের মতো সহিংস রাজনীতির চর্চা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। এমনকি ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' নাটকের কাঙ্ক্ষিত সমাধান হলেও ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না সেটা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিএনপির সিলেট জেলার সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান বা গুম হওয়ার ঘটনায় দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা একদিকে যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত তেমনি অবধারিত। অবধারিত বলছি এ কারণে যে, কয়েক মাস ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান অস্থিরতার সর্বশেষ ঢেউই বর্তমানের সংকট। সরকার যখন উচ্চ আদালতের রায়ের অংশবিশেষ বাস্তবায়ন করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তখনই বোঝা গিয়েছিল যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেটা মানবে না। এ ইস্যু নিয়ে তারা মাঠে নামবে এবং সেটা সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত চলবে। ইতিমধ্যে তারা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরুর ঘোষণাও দিতে থাকে। মাঝে বিএনপি এবং তার মিত্ররা জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী দীর্ঘ সময় ধরে তার বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পান। কিন্তু এ অবস্থান যে শুধুু জাতীয় সংসদ সদস্য পদ বজায় রাখার জন্য সেটা দেশবাসীর কাছে দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায়।
গত কয়েক মাস ধরেই সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীরা সভা-সমাবেশে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করছেন, যা এমনকি বিরোধীদের সংসদে সীমিত সময়ের উপস্থিতির সময়ও প্রকাশ পায় এবং তাতে শালীনতার সীমারেখা মানার কোনো পক্ষই চেষ্টা করেনি। এটা থেকেও স্পষ্ট হয় যে, দেশ চলেছে সংঘাতের পথে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে সুশীল সমাজ, এমনকি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মতো রাজনৈতিক নেতাও ফর্মুলা হাজির করেন। কিন্তু না সরকার, না বিরোধী দল_ কারও কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিএনপি মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় বড় ধরনের রাজনৈতিক সমাবেশ করেছিল। সেখান থেকে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য তিন মাসের আলটিমেটাম প্রদান করা হয়। আমার মতো অনেকেই ধরে নিই যে, এ সময়ের মধ্যে বিএনপি হয়তো বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদান করবে না। এর পরিবর্তে দেখা যাবে জেলা বা বিভাগ পর্যায়ে সভা-সমাবেশ এবং রোডমার্চের মতো জনবান্ধব কর্মসূচি।
ইতিমধ্যে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস এবং রেলের পদস্থ একজন কর্মকর্তার বিপুল অঙ্কের অর্থসহ পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে মধ্যরাতের নাটকীয় ঘটনা এবং রেলওয়েতে নিয়োগ-বাণিজ্য বিষয়ে তার জড়িত থাকার অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গন কয়েকদিন উত্তপ্ত ছিল। বিরোধী দল এ জন্য শুধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নয়, গোটা সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। প্রধানমন্ত্রী রেলমন্ত্রীকে গণভবনে ডেকে পদত্যাগ করতে বললে তিনি তাতে সম্মত হন এবং সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দিলে জনগণ তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করায় সরকারের ভাবমূর্তি প্রকৃতই পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটে_ রাজধানী থেকে ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যান। এ ঘটনার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ইস্যু সম্পর্কিত_ এমন অভিমত কোনো কোনো সংবাদপত্রে দেখেছি। এ মুহূর্তে এর সত্যাসত্য নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, তবে এমন যোগসূত্র থাকলে সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে মোটেই অসঙ্গত বা বেমানান মনে হবে না। একই সঙ্গে এটাও বলব যে, এর ফলে সুস্থ ধারায় রাজনীতির পথে উত্তরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি হলো এবং তা পরিবর্তনের জন্য নিশ্চিতভাবেই অনেক মূল্য শুধুু রাজনৈতিক দলগুলোকে নয়, দেশকেও দিতে হবে।
বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি নতুন নয় এবং ইলিয়াস আলীর গুম কিংবা অপহরণের মূলে সেটাই। এ প্রতিহিংসার অনেক ভয়ঙ্কর চিত্র নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের পর থেকেই আমরা দেখে অভ্যস্ত। এইচএম এরশাদের জমানার পতনের পর বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে ক্ষমতায় আসে। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে বিএনপি ফের ক্ষমতায় আসে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সক্রিয় জোট বেঁধে। এ সময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়াকে এক জনসভায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। একে একে ঘটে আরও ভয়ঙ্কর সব ঘটনা_ টঙ্গীর জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার খুন হন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ অন্তত ২৪ জন। সে সময়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আহত হন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিপুলসংখ্যক কর্মী ও সমর্থক। এর ধারাবাহিকতা চলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পরও। রাজধানীর সুপরিচিত বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। গুম-খুনের ঘটনা নিয়মিতই সংবাদপত্রে আসতে থাকে। তবে এসবের কোনোটিই ইলিয়াস আলীর ঘটনার মতো রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করেনি। এ ঘটনাটি আমাদের বিশেষভাবে শঙ্কিত করে। সমকাল ও যুগান্তরসহ আরও কোনো কোনো পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ইলিয়াস আলীকে সরকারেরই কোনো সংস্থা আটক রেখেছে। তাকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য কয়েক দফা শর্ত দেওয়া হয়েছে এবং এ নিয়ে পরিবার ও বিএনপির সঙ্গে দেনদরবার চলছে। ২৩ এপ্রিল বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ইলিয়াস আলী সরকারেরই কোনো সংস্থার জিম্মায় জীবিত ও সুস্থ রয়েছেন। আশা করব, দ্রুততম সময়ে এ নাটকের অবসান ঘটবে এবং তাতেই তার পরিবার ও দেশবাসীর স্বস্তি।
বাংলাদেশে যে কোনো ব্যক্তির সংবিধান ও প্রচলিত আইন-কানুন মেনে রাজনীতি করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ অধিকার যাতে প্রত্যেকে বাধাহীনভাবে প্রয়োগ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। দুই যুগ আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে দেখছি যে, সে অধিকার রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের এক শ্রেণীর নেতাকর্মীর অসহিষ্ণুতা ও জিঘাংসার কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। অনেকে অত্যাচারিত হয়েছেন ও হচ্ছেন এবং কেউ কেউ উধাও হয়ে গেছেন। নিরাপত্তার জন্য দেশান্তরী হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। কিন্তু নির্বাচনে ভোট দেয়নি, এ অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। সম্প্রতি সাতক্ষীরা এলাকায় সংখ্যালঘুদের মন্দির এবং সহায়সম্পদ আক্রান্ত হয়েছে এবং এর পেছনে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের সক্রিয়তা রয়েছে বলে সংবাদপত্রে দেখেছি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করছি, যখনই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অর্জন ঘটে, অর্থনীতি শক্তি সঞ্চয় এবং শান্তি ও স্থিতি বিরাজ করে তখনই বিভিন্ন অপশক্তি মাঠে নেমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে উঠেপড়ে লাগে। এসব অপশক্তির অস্তিত্ব-উপস্থিতি রাজনৈতিক দলের ভেতরে আছে, বাইরেও আছে। সরকারের কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, আইনের অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন সচেষ্ট হতে দেখি না। বরং নিজ দলের দুষ্কৃতকারীদের আশকারা দিয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনা পরিস্থিতিকে ক্রমশ খারাপের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। ইলিয়াস আলী অপহরণ বা গুম প্রমাণ করে, যে কোনো মাপের রাজনৈতিক নেতাকর্মীই এখন আর নিরাপদ নন। যদি এ ঘটনায় সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে সব দায় তাদেরই নিতে হবে। আর যদি এমন কোনো চক্র সরকারের অজ্ঞাতে এ অপরাধ সংঘটিত করে থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করা এবং জড়িতদের কঠোর শাস্তি বিধান করাও তাদেরই দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করে সরকার তার অপহরণের দায় এড়াতে চাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটি অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা। এ ঘটনায় দেশব্যাপী যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের একমাত্র উপায় তাকে খুঁজে বের করা।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ ঘটনাটিকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা পরপর তিনদিন হরতাল দিয়েছে এবং এর যুক্তি হচ্ছে সরকারকে চাপে রাখতে হবে। এভাবে মুক্তি ত্বরান্বিত করাও তাদের লক্ষ্য। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় হরতাল যে কার্যকর পন্থা নয়, নিতান্তই ধ্বংসাত্মক ও আত্মঘাতী সেটা বিএনপির নেতা-নেত্রীরা ভালো করেই জানেন। তারা ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক হরতাল-অবরোধ মোকাবেলা করেছেন। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনাও দুই দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আন্দোলনের চাপে তার সরকার কোনো ছাড় দেয়নি এবং এখনও দিচ্ছে না। তিনদিন হরতালের পরও তাদের তরফে এমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি, যা থেকে বলা যায় 'সফল হরতাল' কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা-সংলাপের প্রয়োজন ছিল, হরতাল নয়। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করলে তিনি 'নিখোঁজ' ঘটনায় সরকারের তরফে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আমি বিশ্বাস করি, বিএনপি যদি আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতেন, ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে মানববন্ধনের আয়োজন করা হতো এবং এ ধরনের আরও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হতো তাতেই সরকারের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হতো। দেশের বাইরেও তার প্রতিক্রিয়া বেশি হতো। বিএনপি একের পর এক হরতাল দিচ্ছে। তাতে সরকারের ওপর যতটা না তার চেয়ে ঢের বেশি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে জনগণের ওপর। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা হরতাল জনজীবন ও অর্থনীতির ক্ষতিকর বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আর বিরোধী দলে গেলেই বেমালুম সেটা ভুলে যায়। কিন্তু ভুক্তভোগী জনগণ জানে যে এ ধরনের কর্মসূচি আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষতি করে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায়, শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে রাখে। হরতালের কারণে এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ইতিমধ্যে দু'দিন স্থগিত করা হয়েছে। যদি আরও হরতাল দেওয়া হয় তাহলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ বিষয়টিকে বিএনপির সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা উচিত। হরতাল মানুষকে সহিংস করে। পার্কিং করা বাসে আগুন দিয়ে ভেতরে ঘুমন্ত চালককে পুড়িয়ে মারা, দুর্ঘটনায় আরেক ক্যাবচালকের মৃত্যু, ইলিয়াস আলীর নিজ উপজেলা বিশ্বনাথে দু'জনের মৃত্যু_ এসব প্রাণের দায়িত্ব কেউ নেবে না। তাদের পরিবারের পাশে সহানুভূতির হাত বাড়ানো হবে না। যে রাজনৈতিক কর্মসূচি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণ কেড়ে নেয়, মানুষকে সহিংস করে তোলে তার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে যে তারা জনগণের জন্য কাজ করছে। তাহলে এটা নিশ্চয়ই বোঝা উচিত। একটি সংবাদপত্রের ছবিতে দেখেছি, বিএনপির একজন মহিলা কর্মী ইট হাতে তেড়ে যাচ্ছেন একটি ইজিবাইকের দিকে। আমি নিশ্চিত যে, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সন্ত্রাসী নন। টেলিভিশন সংবাদচিত্রে দেখানো হয়েছে রামদা-লাঠি হাতে হরতাল সমর্থকরা ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করছে। তারা প্রতিদিন নিশ্চয়ই এ ধরনের সহিংস আচরণ করে না। হরতালের রাজনীতি গণতান্ত্রিক আচরণের পরিপন্থী। এ রাজনীতি সহিংস প্রতিশোধস্পৃহা ও ধ্বংসাত্মক। মঙ্গলবার টিভি পর্দায় একটি প্রাইভেট গাড়িতে আগুন দেওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এটা দেখে রাজনীতিকদের মনে নিশ্চয়ই বিমলানন্দ উদ্রেক হয় না। কিন্তু আমাদের এখন বিশ্বাস করতেই হয় যে এমন দৃশ্য তাদের প্রকৃত আনন্দ দেয়। তা না হলে হরতালের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে এসে জনসভা-মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি বেশি বেশি করে কেন গ্রহণ করা হয় না? তারা কি দেশপ্রেমের জন্য নাকি দল ও আত্মপ্রেমের রাজনীতি করেন? আদর্শ ও শুভচিন্তা ভুলে গিয়ে সহিংসতার পথে চললে তার বলি হতে হয় প্রথমত সাধারণ মানুষকে এবং এ প্রক্রিয়ায় কোনো এক সময়ে সেই নেতারাই এর শিকার হন। ২১ আগস্টের ঘটনাই সৃষ্টি করে ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' রহস্য। একটি থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। আমাদের রাজনীতি থেকে যদি গুম-অপহরণ-সন্ত্রাস দূর করতে চাই তাহলে অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে সহনশীল রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন। এ রাজনীতির ভিত্তি হবে আলোচনা-সংলাপ-সচল জাতীয় সংসদ। দলগুলোর পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সর্বোপরি গণতান্ত্রিক আচরণের বিকল্প নেই।
এখন শঙ্কা জাগে. এ পথে আপাতত চলার লক্ষণ দেখি না বলে। বরং হরতালের মতো সহিংস রাজনীতির চর্চা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। এমনকি ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' নাটকের কাঙ্ক্ষিত সমাধান হলেও ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না সেটা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments