চারদিক-শতবর্ষের পথচলা by এম আর আলম

আঠারো শতকের শেষ ভাগে সৈয়দপুরে গড়ে ওঠে উপমহাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। সৈয়দপুর কারখানায় চাকরি করতেন কলকাতার অনেক বাবু। পাশাপাশি এ কারখানায় অবিভক্ত ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা ও তামিলনাড়ু প্রদেশ থেকে বহু বাবু আসেন চাকরির সুবাদে।


ওই বাবুরা নিজেদের মধ্যে হিন্দি ও উর্দুতে ভাব বিনিময় করতেন। তাই শহরের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই সৈয়দপুরে গড়ে ওঠে নাচঘর ও ঘূর্ণন মঞ্চ। এসব মঞ্চে অবশ্য উর্দু সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে।
১৮৮৬ সালে সৈয়দপুরে ব্রিটিশরা ইংরেজি সংস্কৃতি ধারার প্রবেশ ঘটান। তখন এখানে গড়ে ওঠে বিশাল ইউরোপিয়ান ক্লাব, ব্যাকপাইপার ইনস্টিটিউট। এর বিশাল মঞ্চে টুইস্ট, বল ড্যান্স ও জ্যাজ হতো। কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তো প্রায় সবাই ছিলেন ব্রিটিশ-ইউরোপীয়। লোকশ্রুতি আছে, ইউরোপীয়দের ওই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই বাঙালি তথা এ জনপদের মানুষ অংশ নিতে পারত না। কলকাতার বাঙালি বাবুরা ইংরেজি ও উর্দু সংস্কৃতির সমান্তরালে নিজেদের সংস্কৃতির উদ্ভাসন চাইলেন। কেননা, এ সময় উর্দুর দাপটে বাংলা সংস্কৃতিকে বাঁচানোর দায়িত্ব পড়ে যায় যেন বাঙালিদের ওপর। ওই বাবুরাই ১৯১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সৈয়দপুরে গড়ে তোলেন বাঙালি চর্চা কেন্দ্র ‘দ্য নিউ ইউনিয়ন মিউজিক্যাল ক্লাব’। সেদিনের ওই ক্লাব আজকের শিল্প-সাহিত্য সংসদ।
শুরুতে শিল্প-সাহিত্য সংসদের জৌলুশ ছিল অন্য রকম। ৩০০ সদস্য ছিল সংগঠনটিতে। নিজেদের মধ্যে চার আনা, আট আনা চাঁদা দিয়ে চলত সাংগঠনিক কাজ। আর সদস্যদের এককালীন চাঁদায় গড়ে ওঠে সংগঠনের নাট্যমঞ্চ ও বিশাল অডিটোরিয়াম।
শিল্প-সাহিত্য সংসদের বর্তমান সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক আমিনুল হক। তিনি জানান, শিল্প-সাহিত্য সংসদকে এ অঞ্চলের মানুষ মিনি সংসদ নামে চেনে। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা রয়েছে এখানকার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে। এমনকি সংসদের বিভিন্ন পদে প্রতিনিধি নির্বাচনটাও গণতান্ত্রিকভাবে গোপন ব্যালটে হয়ে থাকে। সংসদে ২১ সদস্যের কমিটি কাজ করে নিজ নিজ শাখা নিয়ে।
আমিনুল হক বলেন, ‘শতবর্ষী এ সংসদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত থাকলেও এর ধারাবাহিক ইতিহাস খুঁজে ফেরা বেশ দুরূহ। অতীতের অনেক দলিল-দস্তাবেজ আমরা হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে লোপাট হয়েছে এসব। তবে ১৯৩৪ সালের পর থেকে শিল্প-সাহিত্য সংসদের কিছু কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের কাছে ধারণা আছে। ওই সময় সংসদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন করুণা বাবু। তিনি ছিলেন সৈয়দপুর হাইস্কুলের একজন শিক্ষক। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ডা. অচ্যুত লাল বাগচি। তিনি এ জনপদের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। শিল্প-সাহিত্য সংসদের বেশির ভাগ সদস্যই তখন ছিলেন হিন্দু সম্প্র্রদায়ের লোক। মুসলমান সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ।
ওই সময় মাসে কমপক্ষে দুটি নাটক মঞ্চায়ন হতো শিল্প-সাহিত্য সংসদের মঞ্চে। তখনো মেয়েরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসেননি। ফলে ছেলেদেরই মেয়ের অভিনয় করতে হতো। নাটকের আলোকসম্পাত করা হতো হ্যাজাক বাতিতে। সারা রাত চলত নাটক। এসব নাটক ছিল পৌরাণিক ধারায়। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ও রাজকীয় নাটক হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের মঞ্চে। বর্তমানে শিল্প-সাহিত্য সংসদের সদস্যসংখ্যা ১২০। তাঁদের মধ্যে মাত্র ২০ জন নারী।
সৈয়দপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে শিল্প-সাহিত্য সংসদ কাজ করে চলেছে। সংসদটির অডিটোরিয়ামে একটি সিনেমা হল চলে, চলে একটি সংগীত ও চিত্রাঙ্কন স্কুল। ওই হলের ভাড়ার আয় থেকে স্থানীয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের এককালীন বৃত্তি প্রদান এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিবছর।
মুক্তিযুদ্ধে শিল্প-সাহিত্য সংসদের সদস্যদের ছিল অনন্য অবদান। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ সংসদের সদস্যরা স্বাধীন বাংলার চেতনা ছড়িয়ে দিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। এ জন্য এ সংসদের সভাপতি ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) ডা. জিকরুল হককে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। আরও শহীদ হন ডা. বদিউজ্জামান, ডা. শামসুল হক, আতিয়ার রহমান, নূর মোহাম্মদ, আইয়ুব হোসেন, আবদুুর রব ভূঁইয়া, জহুরুল হক, আমিনুল হক, খন্দকার হুসনুর রহমান, হরিহর প্রসাদ ও মোবারক আলী। তাঁদের অপরাধ ছিল তাঁরা বাংলায় নাটক করেন, বাঙালি চেতনাকে শাণিত করতে তাঁরা ভূমিকা রেখেছিলেন।
বিনোদন পাক্ষিক আনন্দ আলোর সম্পাদক রেজানুর রহমান সৈয়দপুরের সন্তান হিসেবে শিল্প-সাহিত্য সংসদকে নিয়ে গর্ব করেন। তিনি অতীত হাতড়ে বলেন, ‘গেট পাস ছাড়া তো সংসদের নাটক দেখা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। অতীতে যে সংসদের নাটক দেখতে পেয়ে আমি অভিভূত হতাম, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সে প্রেক্ষাপটই নেই সংসদে। সাহিত্য সংগঠনে অবশ্যই সাহিত্যবোধ ও চেতনার সম্মিলন থাকা জরুরি। বিশ্বজুড়ে এখন ক্রিকেট উন্মাদনা। এই উন্মাদনার মধ্যেও শিল্প-সাহিত্য সংসদে চলছে শতবর্ষকে ঘিরে মাসব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন। হচ্ছে সংলাপ প্রতিযোগিতা, সাহিত্য প্রতিযোগিতা, নৃত্য-গানের প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। ২৮ ফেব্রুয়ারি এসবের সমাপনী হবে। অতঃপর শেষ হবে শতবর্ষের অনুষ্ঠানমালা।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রসঙ্গ আসতেই সৈয়দপুরের আরেক সংস্কৃতিকর্মী ইবরার টিপুর কথা এসে যায়। এবার বিশ্বকাপের ওয়েলকাম সংটা ছিল টিপুর সংগীতায়োজনে। তিনি বলেন, শিল্প-সাহিত্য সংসদ শতবর্ষ অতিক্রম করল, ভাবতেই ভালো লাগছে।

No comments

Powered by Blogger.