আরব বিদ্রোহ-বিপ্লবের ছায়া ও শরীর by আই এ রেহমান

আরব দুনিয়ায় স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে চলমান গণ-অভ্যুত্থানের ফলে পাকিস্তানে এখন ‘বিপ্লব’ শব্দটির ব্যবহার যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে। তবে আরব রাষ্ট্রগুলোতে কী ঘটছে, কিংবা পাকিস্তানে কেমন পরিবর্তন দরকার—তা বোঝার আন্তরিক চেষ্টাচরিত্রের ঘাটতি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।


নানা জনে ‘বিপ্লবের’ নানা মানে। অক্সফোর্ড অভিধানে রেভল্যুশন বা বিপ্লবের বেশ কয়েকটি অর্থ দেওয়া হয়েছে: (১) কোনো বিশেষ অবস্থা, পরিস্থিতি ইত্যাদির তাৎপর্যপূর্ণ বদল অথবা আমূল পরিবর্তনের কাল অথবা দৃষ্টান্ত; (২) এত দিন যারা কোনো প্রতিষ্ঠিত সরকার অথবা সমাজবিন্যাসের অধীনে বাস করেছে, তাদের দ্বারা তার পূর্ণাঙ্গ উচ্ছেদ; (৩) নতুন ধরনের সরকার জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা এবং (৪) শাসকশ্রেণীকে বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ এবং উৎপাদনের উপায়গুলো নিয়ন্ত্রণে এনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মাধ্যমে এত দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
অভিধানের মানে বাদ দিলেও রাজনীতির ছাত্রদের কাছে বিপ্লব হলো এক প্রচণ্ড আলোড়ন, যার মাধ্যমে বিদেশি অথবা দেশীয় স্বৈরশাসকদের হাত থেকে জনগণের স্রেফ সার্বভৌম অধিকারই ফেরত পাওয়া নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কও বদলে দেওয়া। তাই সত্যিকারের বিপ্লব সব সময় জনগণের নিজের অধিকার অর্জনের যাত্রায় আত্মসত্তার পূর্ণ উপলব্ধির পথে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো গোলযোগের ফলে যদি এসব অধিকার খর্ব হয়, তাহলে তা পশ্চাদপসরণ অথবা প্রতিবিপ্লব কিংবা অন্তত বিপ্লব-প্রচেষ্টা (অভ্যুত্থান) বলে গণ্য হয়।
এই মাপকাঠিতেই মার্কিন, ফরাসি, রুশ, চীনা, কিউবান, ইরানি ও দক্ষিণ আফ্রিকান বিপ্লব সত্যিকারের বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত এবং চিলিতে আলেন্দে সরকার উচ্ছেদ প্রতিবিপ্লব হিসেবে নিন্দিত। আর একইভাবে আইয়ুব খানের ‘শ্বেতবিপ্লব’ নিয়ে আসার দাবি নিষ্ঠুর মশকরা হিসেবে খারিজ হয়ে গেছে।
স্পষ্ট অভীষ্ট লক্ষ্য আর সফল হওয়ার রাস্তা খোলা থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্বের অভাবে বহু গণজাগরণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। এসব গণজাগরণে যেমন বলপ্রয়োগই করা হোক না কেন, আর তার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতার পাহারাদার পুরোপরি যদি বদলেও গিয়ে থাকে, তবু তা বিপ্লব বলে গণ্য হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিপ্লবী পরিবর্তনের বাসনাই তাতে ফুটে ওঠে।
পাকিস্তানেও আরব বিদ্রোহ চলে আসবে কি না, সেই ফয়সালার আগে আরব বিদ্রোহের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করা যাক। আরবের চলতি ঘটনাবলিকে ‘দ্বিতীয় আরব জাগরণ’ হিসেবে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার বিশেষ কারণ আছে। মূলত উসমানীয়দের বিরুদ্ধে সেই প্রথম বিদ্রোহের মাশুল এখনো দিতে হচ্ছে আরব জনগণকে। সেই জাগরণের নেতৃত্বদানকারীকে সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের বয়ানে হয়ে ওঠেন ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’। এই নামকরণ জয়ী হওয়া এলাকায় নিজেদের বীরের নাম জুড়ে দেওয়ার সাম্রাজ্যবাদী সামরিক তৎপরতার অংশ।
১৯১৮-১৯ সালের আরব বিদ্রোহে আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈধ বাসনায় কিছু মাত্রায় উদ্দীপিত হওয়ার ব্যাপার ছিল সন্দেহাতীতভাবেই। কিন্তু এর নেতৃত্ব দেশীয় ছিল না। আর সেটির রাজনৈতিক আদর্শ সংজ্ঞায়িত করার সময়ও তেমন পাওয়া যায়নি। তাতে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কোনো কথা বলা হয়নি।
সেই জাগরণ আরব জনগণকে কী দিয়েছিল? এক ক্রুর জালিম শাসকের হাত থেকে রেহাই পেল তারা। কিন্তু গিয়ে পড়ল পরিশীলিত স্বৈরতন্ত্রের কবলে। এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ কবজা করার যুদ্ধে বিজয়ী শক্তি শুধু তাদের নিজস্ব স্বার্থে বহু ভাগে ভাগ করে নিল সেই ভূমি। একদিকে যেমন বৃহৎ আরব পরিবারে অনৈক্যের বীজ বপণ করা হলো, অন্যদিকে ইসরায়েল সৃষ্টির পয়লা কদমও ফেলা হলো। বেলফোর ঘোষণা, ফিলিস্তিন বিভক্তকরণ পরিকল্পনা ও ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা—সবই হলো ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা হিসেবে নিয়ে নেওয়ার পরিণতি।
আরব বিশ্বের তথাকথিত দ্বিতীয় জাগরণে এখন পর্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো শক্তির দেখা মিলছে না, যে শক্তি ইতিবাচক বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। দশকব্যাপী দমন-পীড়ন ও মৌলিক অধিকার প্রত্যাখ্যানের প্রতি জনগণ অবাধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নিঃসন্দেহে। ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে বিপ্লব হওয়া সম্ভব ছিল কিন্তু বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তিউনিসিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধানকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু ব্যবস্থাটি অধরাই রয়ে গেছে। মিসরের ‘অজ্ঞাতনামা বিপ্লবে’ আসলে কোনো বিপ্লব ঘটেনি আর পরিবর্তনও অজ্ঞাতনামা নয়। যে সশস্ত্র বাহিনী এত দিন মোবারককে রক্ষা করেছে, ওই বাহিনী আর তাঁর পাশে থাকতে চায়নি। প্রথমে তারা তাহরির ময়দানে জনতার ওপর গুলি না চালিয়ে জনতার সঙ্গে মিলে আর তার পর মোবারককে চলে যাওয়ার হুকুম দিয়ে নিজেদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছে। সমস্ত আরব রাষ্ট্রে চলমান গণতান্ত্রিক উদ্দীপনার প্রথম সুবিধাভোগী হবে সশস্ত্র বাহিনী।
আরব অঞ্চলে বিক্ষোভের সত্যিকার তাৎপর্য পাকিস্তানি জনগণ সহজেই অনুধাবন করতে পারে। কেননা সেখানকার ঘটনাবলি মোটামুটিভাবে পাকিস্তানের বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের ছাঁচ অনুসরণ করছে। পাকিস্তানকে স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে দেখার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি যদি প্রত্যয়গতভাবে বিপ্লবী বলা হয়, তাহলে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করে ঔপনিবেশিক যোগসূত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল প্রতিবিপ্লবী উল্লম্ফন। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ আটকে দিতে ইস্কান্দার মির্জা সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন। আর আইয়ুবের অভ্যুত্থান ছিল দেশটিকে গণতন্ত্র-উত্তর যুগে ঠেলে দেওয়ার শামিল।
জনগণ রাজপথে ঠিকই নেমে এসেছিল ১৯৬৮-৬৯ ও ১৯৭৭ সালে। কিন্তু পরিবর্তনের চরিত্র তারা নির্ধারণ করেনি। উভয় ক্ষেত্রে ফলাফল ঠিক করেছিল সশস্ত্র বাহিনী। প্রথমবার আইয়ুব খান ও দ্বিতীয়বার জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে।
অসহনীয় দুর্দশায় নিপতিত জনগণের বিক্ষুব্ধতা আবারও তাদের ঠেলে দিচ্ছে বিপ্লবী পরিস্থিতির দিকে। কিন্তু তারা ময়দানে এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দেখতে পাচ্ছে না, যা তাদের স্বার্থের অনুকূলে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে। তথাকথিত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো শুধু জনগণকে সতর্ক করে বলছে, তাদের নেতাদের পরম শাসক হিসেবে মেনে না নিলে গণতান্ত্রিক অবয়ব ধসে পড়বে। ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে ধর্মবিচার সভার যুগে ফিরে যাওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তান ও আরব দেশগুলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের তত্ত্বের ফাঁদে পড়ে থাকার মাশুল দিয়ে যাচ্ছে এসব দেশের জনগণকে। রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তার খোঁজ করেছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি দমন করে শুধু সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র কিনে অথবা ধার করে। রাষ্ট্র নির্মমভাবে নিশ্চিহ্ন করেছে এমন সব উপাদান, যা জনমুখী বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারত। তারা শুধু এমন কতগুলো রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে অনুমোদন করেছে, যারা একে অন্যকে পরস্পরের ঘোরতর শত্রুজ্ঞান করে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জোশে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক দলকেও ধ্বংস করেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এসব রাষ্ট্র সশস্ত্র বাহিনীর দপ্তরের সহযোগী হিসেবে মসজিদ ও মাদ্রাসার উত্থান মেনে নিয়েছে, এমনকি তাতে সহায়তাও দিয়েছে।
পাকিস্তানে রাজনীতিকেরা প্রকৃত রাজনীতি থেকে এতটাই দূরে সরে গেছেন যে, কোনো এক গোষ্ঠীর অকার্যকরী প্রধানকে জনগণের উদ্দেশে বলতে শোনা গেছে, ‘বিপ্লবের নামে জেগে ওঠো জনতা, সশস্ত্র বাহিনী তোমাদের পাশে থাকবে।’ সুস্থ রাজনীতির ময়দানে অসুস্থ অনুশীলনের ফল গণতন্ত্রের সনদ ভুলে গিয়ে নব্বইয়ের দশকে প্রত্যাবর্তন—যখন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম লক্ষ্য ছিল বেসামরিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা। এই পথ নিশ্চিতভাবেই এক অভ্যুত্থানের পর আগের অভ্যুত্থানের জন্ম দেবে। আতঙ্কজনক সেই ভবিষ্যৎ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ জনগণকেই বিপ্লবের হাতিয়ার গড়তে দেওয়া। আর তা সত্যিকারের রাজনৈতিক দলগুলোতে কাজ করতে দেওয়া অথবা তার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আই এ রেহমান: পাকিস্তানের সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.