সরল গরল-আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠতা, না মেধার লড়াই! by মিজানুর রহমান খান
এই মুহূর্তে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট অনেকের মনে সাত ভাই চম্পার কথা স্মরণে এনে দিতে পারেন। আপিল বিভাগে আগে ছিলেন চারজন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ছুটিতে যান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। ২৩ ফেব্রুয়ারি শপথ অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রথম দেখা গেল।
চারজনের অভিষেকে তিনি শামিল হন। নবাগতদের একজন নারী। তাই বলি সাত ভাই এক বোন। তিনি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তিনিই আমাদের ইতিহাসের প্রথম নারী, যিনি হাইকোর্টের পরে আপিল বিভাগেও প্রথম হলেন। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে সান্দ্রা ডে ও’কন্নোর, ২০০৪ সালে ব্রিটেনের হাইকোর্টে লেডি ডেম ব্রেন্ডা হেল, ১৯৮৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফাতিমা বিবির পর এই গৌরবের উত্তরাধিকার হলো বাংলাদেশ; পাকিস্তান যা আজও পারেনি।
তবে আপিল বিভাগে সাত ভাই চম্পা প্রসঙ্গ ম্লান করে দিয়েছে কয়েকজন সংক্ষুব্ধ বিচারকের নেপথ্যে পদত্যাগের হুমকি, প্রকাশ্যে গণছুটিতে গমন এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের মনোভঞ্জনের ঘটনা। গণছুটি কাটিয়ে আগামীকাল পাঁচজন বিচারক কর্মস্থলে ফিরবেন। এ ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব? পাঁচজন বিচারকের ‘গণছুটি’ দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তা সত্ত্বেও চারজন নবনিযুক্তের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনেকটা নির্দলীয় ও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল। বার ও বেঞ্চ সমস্বরে তাঁদের স্বাগত জানান। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, অশুভ ঐক্য অটুট থাকছে। আদালত অঙ্গনের রথী-মহারথীরা নিয়োগনীতির প্রশ্নে আগের মতোই চুপ। গণছুটি বিচার প্রশাসনে কিছুটা বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের দৈনিক কজ লিস্ট এক দিন আগে চূড়ান্ত হয়। প্রধান বিচারপতির প্রশংসনীয় উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে কজ লিস্ট এখন আগের রাতেই পাওয়া যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার চারজন বিচারকের নিয়োগ আপিল বিভাগে পৌঁছানোর পর ক্ষুব্ধ বিচারকদের গণছুটির খবর রটে যায়। সে কারণে ২২ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টায় দেখি, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সম্ভাব্য ক্ষুব্ধ বিচারকদের কজ লিস্ট ছিল শূন্য। এই অবস্থা ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনমান বজায় থাকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের নাম কজ লিস্টে ছাপা হয়নি।
পত্রিকান্তরে খবর রটেছিল, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের কারণে পাঁচজন বিচারক গণছুটিতে যান। বিএনপির আমলে বাদ পড়া বহুল আলোচিত ১০ বিচারকের মামলায় জিতে ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ ১০ জনই স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁদের একজন অবসরে গেছেন। অবশ্য একই সময়ে বাদ পড়েছেন অথচ রিটে পক্ষ হননি, এমন একজনও ওই রায়ের সুবিধায় পুনর্বহাল হন। এখন তাঁরা ১০ জনই আছেন। তবে সবাই প্রধান বিচারপতির সুপারিশের বিরোধিতা করেননি। গণছুটি প্রশ্নে সবার দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়।
আন্দোলনরত এবং যে চারজন আপিল বিভাগে উন্নীত হলেন, তাঁরা সবাই বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পান। গণছুটিতে যাওয়া পাঁচজন বিচারকের সবার জন্য জ্যেষ্ঠতার প্রশ্ন খাটবে না। সে কারণেই আমাদের জিজ্ঞাসা, বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বহু কাঙ্ক্ষিত মেধা প্রতিযোগিতায়ও প্রবেশ করলেন কি না? আমরা মেধার জিগির তুলেছি। তাই আমরা সর্বাগ্রে নিষ্কলুষ চিত্তে ভালো চিন্তাটাই করব। ধরে নেব, আমাদের উচ্চ আদালতে মেধা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এমনটা প্রতীয়মান হবে?
আমরা ধরে নিই, বিএনপির আমলে তাঁরা কেউ বাদ পড়েননি। তাহলে জ্যেষ্ঠতা কী দাঁড়াত? এখানে মনে রাখতে হবে, হাইকোর্টে প্রথম যখন অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন জন্মতারিখ একটি ফ্যাক্টর। যেমন—কোনো একটি ব্যাচে পাঁচজন নিয়োগ পেলেন, তাঁদের জ্যেষ্ঠতার ক্রম ঠিক হয় জন্মতারিখের ভিত্তিতে। ওই দশজন বিচারকের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম হলেন বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। শুনেছি, দশজনের মধ্য থেকে দুজন বা শুধু জ্যেষ্ঠতমকেও যদি আপিল বিভাগে নেওয়া হতো, তাহলে অপ্রীতিকর অবস্থা এড়ানো সম্ভব হতো, বাদবাকিরা এক বা দুজনের জন্য বা অন্যায়ের শিকার হওয়া গ্রুপের স্বার্থ রক্ষায় আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। কারণ যা-ই হোক, বিষয়টি বিচারালয়ের জন্য অবমাননাকর। বিচারকদের সুউচ্চ নীতি-নৈতিকতার দিক থেকেও শোভন নয়।
বিএনপির আমলে তাঁরা বাদ না পড়লে জ্যেষ্ঠতার ক্রম দাঁড়াত এ রকম: ১. বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, ২. বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, ৩. বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, ৪. বিচারপতি এম এ হাই, ৫. বিচারপতি ফারুক আহমেদ, ৬. বিচারপতি মারযি উল হক, ৭. বিচারপতি মো. শামছুল হুদা, ৮. বিচারপতি আবদুর রাজ্জাক, ৯. বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, ১০. বিচারপতি ইমান আলী, ১১. বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, ১২. বিচারপতি শেখ রেজওয়ান আলী, ১৩. বিচারপতি খন্দকার মূসা খালেদ, ১৪. বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হক, ১৫. বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, ১৬. বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ১৭. বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক ও ১৮. বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। উল্লিখিত ১৮ জনই আওয়ামী লীগ আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার প্রথম সরকার কিন্তু নিতান্ত দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেয়নি। যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকেই তখন নিয়োগ পান। পরে রাজনীতির মান নিচে নেমেছে। সেই সঙ্গে দলীয় চোখে অনেক কিছু দেখার প্রবণতা তীব্র হয়েছে। জোট সরকারের ‘প্রলয়ের’ মধ্য দিয়ে বিচারক নিয়োগে ধস নামে। তবে এ লেখায় আমরা জ্যেষ্ঠতা ও মেধা কিংবা অন্যবিধ বিবেচনা কীভাবে কাজ করে, সেটা দেখব।
২৪ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে নিয়োগ পান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন, বিচারপতি সিনহা ও বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়া। তিনের ভাগ্য তিন রকম হলো। এই তিন রকম হওয়ার সঙ্গে জ্যেষ্ঠতা ও মেধার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। এখনো নেই। আমাদের বিচার বিভাগ এই যে পাঁকে আছেন, সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করতে হবে। তাঁকে বাঁচাতে হবে। একই তারিখে আওয়ামী লীগ আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি সিনহা অনেক আগেই আপিল বিভাগে গেলেন। বিচারপতি ওয়াহ্হাবের সঙ্গে বিচারপতি সিনহার বয়সের ব্যবধান মাত্র ১০ মাস। তিনি তরতরিয়ে এমনকি একই তারিখের সতীর্থ সিকদার মকবুল হককে ডিঙিয়ে দেড় বছর আগেই ওপরে গেলেন। এখন বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনের এই অনুভূতি হতে পারে যে তাঁর চেয়ে বয়সে দুই কনিষ্ঠের হলোটা কী? বিচারপতি সিনহা বয়সে তাঁর চেয়ে সাত বছরের কনিষ্ঠ। বিচারপতি ওয়াহ্হাবও সাত বছরের কনিষ্ঠ। বিএনপি তাঁকে বাদ না দিলে তাঁর আগে বিচারপতি সিনহার আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা নয়। অথচ বিচারপতি সিনহার নাম ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতি হিসেবেও শোনা যায়। এখন আবার একই তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি ওয়াহ্হাব তাঁর চেয়ে ঢের কনিষ্ঠ হয়েও আপিল বিভাগে চলে গেলেন।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ২৮ মে ২০০০ সালে নিয়োগ পান। তাঁর সঙ্গে একই ব্যাচে নিয়োগ পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে শুধু তাঁকেই বিএনপি স্থায়ী করেছিল। ওই পাঁচজনের একজন ছিলেন এ এফ এম মেসবাহ উদ্দিন। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন। ১০ জন বিচারকের মামলার পর তাঁকে হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। কয়েক দিন পরই শুনলাম, তাঁর জামাতা বিচারক হচ্ছেন। তাঁর জামাতা অ্যাটর্নি জেনারেলের কক্ষে ভাঙচুরে অংশ নিয়েছিলেন বলে বিতর্কিত হন। আওয়ামী লীগ মনোনীত একজন প্রধান বিচারপতি তাঁকে সে জন্য শপথ পাঠ করাননি। তবে শিগগিরই হয়তো আমরা দেখব, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে আন্দোলন করা নিষিদ্ধ করে একটি প্রস্তাব প্রধান বিচারপতি ফুলকোর্টে পেশ করছেন। আর সেই অভিযুক্ত অতিরিক্ত বিচারক তাতে সমর্থন দিচ্ছেন।
যা হোক, গণছুটিতে থাকা পাঁচজন বিচারকের একজনই কেবল আপিল বিভাগের সদ্য উন্নীত চারজনের তুলনায় নিয়োগের মূল তারিখের নিরিখে জ্যেষ্ঠ। বাকি চারজনের তিনজনই বিচারপতি ওয়াহ্হাব ও বিচারপতি নাজমুন আরার চেয়ে পরে নিয়োগ পেয়েছেন। এই তিনজন—বিচারপতি এম এ হাই, বিচারপতি ফারুক ও বিচারপতি হুদা ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালের একই তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। যদি আমরা ধরে নিই, তাঁরা শুধু বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন বা গ্রুপ বিবেচনায় নয়, সংহতির জন্য নয়, তাঁরাও আপিল বিভাগে যেতে চান। তাহলে আমরা ধরে নেব তাঁরা জ্যেষ্ঠতা নয়, মেধার বিষয়টিকেও সামনে আনছেন। আপিল বিভাগে উন্নীত হওয়া অন্য দুজন বিচারক বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি ইমান আলী তাঁদের সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালেই হাইকোর্টের বিচারক হন। তবে তাঁরা জন্মতারিখ হিসাবে মূল জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ওই তিনজন এবং আরও দুজনের কনিষ্ঠ ছিলেন।
লক্ষণীয়, গণছুটিতে থাকা কনিষ্ঠতম বিচারক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মূল নিয়োগ ৩ জুলাই ২০০১। একই তারিখে অপর আটজনের সঙ্গে অতিরিক্ত বিচারক হন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মো. নিজামুল হক। তিনি গণছুটিতে যোগ দেননি। তবে তাঁর সংহতি প্রতীয়মান হলেও হতে পারে। কারণ ওই পাঁচজনের আলোচিত গণছুটিতে যাওয়ার দিনটিতে তিনিও ছুটি নেন। তিনি এখন দুই সপ্তাহের ‘শ্রান্তি ও বিনোদন’ ছুটিতে আছেন। ওই ১০ জনের মধ্যে তাঁদের অবস্থান যথাক্রমে সাত ও আট। হাইকোর্টের বিদ্যমান জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ওই ১০ জনের ক্রমিক হলো ৪৬ থেকে ৫৫। একই সময়ে নিয়োগ পাওয়া অন্য সতীর্থরা অবশ্য জ্যেষ্ঠতার শীর্ষে।
আপিল বিভাগে সদ্য নিয়োগ পাওয়া চারজনই দীর্ঘ সময় থাকবেন। হয়তো সে কারণেও এবারে বঞ্চিতদের বেদনাভার তীব্র হয়েছিল। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চারজনই আপিল বিভাগে থাকবেন। আরেকটি বিবেচনা হলো, বিএনপি এলে তাঁদের আপিল বিভাগে যাওয়া কখনো হবে না। আর সরকার হয়তো অঙ্ক কষেছে। তারা দেখেছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসতে না পারলেও আপিল বিভাগ থেকে তাঁরা সহানুভূতি পাবেন। গণছুটিতে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনসহ তিনজন আগামী ডিসেম্বর, বিচারপতি মো. শামছুল হুদা (গোপালগঞ্জ নিবাসী) ডিসেম্বর ২০১২ এবং বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে অবসরে যাবেন। বিচারপতি নিজামুল হকের অবসরের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৭। শেষোক্ত তিনজন শুধুই মেধার লড়াইয়ে নেমেছিলেন ভাবতে পারলে বাধিত হতাম।
আপিল বিভাগ জাতির শেষ দুর্গ। আমরা এটা যদি আদৌ আগলাতে চাই, ভবিষ্যতে আরও ভঙ্গুর অবস্থা না দেখতে চাই, তাহলে এখনই সতর্ক হতে হবে। সংসদকে নতুন বিধান করতেই হবে। প্রধান বিচারপতির সুপারিশ মান্য হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু সার্বিকভাবে, বিশেষ করে যে অযাচিত বিলম্বে ও যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগের ঘটনা ঘটল, তা অস্বচ্ছ ও অনভিপ্রেত; আপিল বিভাগের রায়েরও পরিপন্থী। প্রায় দুই বছর ধরে আপিল বিভাগ রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। সর্বোচ্চ বিচারালয়ের ভাবমূর্তি ও বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল। আপাতত একটা গুমোট অবস্থার অবসান হয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
তবে আপিল বিভাগে সাত ভাই চম্পা প্রসঙ্গ ম্লান করে দিয়েছে কয়েকজন সংক্ষুব্ধ বিচারকের নেপথ্যে পদত্যাগের হুমকি, প্রকাশ্যে গণছুটিতে গমন এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের মনোভঞ্জনের ঘটনা। গণছুটি কাটিয়ে আগামীকাল পাঁচজন বিচারক কর্মস্থলে ফিরবেন। এ ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব? পাঁচজন বিচারকের ‘গণছুটি’ দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তা সত্ত্বেও চারজন নবনিযুক্তের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনেকটা নির্দলীয় ও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল। বার ও বেঞ্চ সমস্বরে তাঁদের স্বাগত জানান। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, অশুভ ঐক্য অটুট থাকছে। আদালত অঙ্গনের রথী-মহারথীরা নিয়োগনীতির প্রশ্নে আগের মতোই চুপ। গণছুটি বিচার প্রশাসনে কিছুটা বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের দৈনিক কজ লিস্ট এক দিন আগে চূড়ান্ত হয়। প্রধান বিচারপতির প্রশংসনীয় উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে কজ লিস্ট এখন আগের রাতেই পাওয়া যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার চারজন বিচারকের নিয়োগ আপিল বিভাগে পৌঁছানোর পর ক্ষুব্ধ বিচারকদের গণছুটির খবর রটে যায়। সে কারণে ২২ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টায় দেখি, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সম্ভাব্য ক্ষুব্ধ বিচারকদের কজ লিস্ট ছিল শূন্য। এই অবস্থা ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনমান বজায় থাকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের নাম কজ লিস্টে ছাপা হয়নি।
পত্রিকান্তরে খবর রটেছিল, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের কারণে পাঁচজন বিচারক গণছুটিতে যান। বিএনপির আমলে বাদ পড়া বহুল আলোচিত ১০ বিচারকের মামলায় জিতে ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ ১০ জনই স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁদের একজন অবসরে গেছেন। অবশ্য একই সময়ে বাদ পড়েছেন অথচ রিটে পক্ষ হননি, এমন একজনও ওই রায়ের সুবিধায় পুনর্বহাল হন। এখন তাঁরা ১০ জনই আছেন। তবে সবাই প্রধান বিচারপতির সুপারিশের বিরোধিতা করেননি। গণছুটি প্রশ্নে সবার দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়।
আন্দোলনরত এবং যে চারজন আপিল বিভাগে উন্নীত হলেন, তাঁরা সবাই বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পান। গণছুটিতে যাওয়া পাঁচজন বিচারকের সবার জন্য জ্যেষ্ঠতার প্রশ্ন খাটবে না। সে কারণেই আমাদের জিজ্ঞাসা, বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বহু কাঙ্ক্ষিত মেধা প্রতিযোগিতায়ও প্রবেশ করলেন কি না? আমরা মেধার জিগির তুলেছি। তাই আমরা সর্বাগ্রে নিষ্কলুষ চিত্তে ভালো চিন্তাটাই করব। ধরে নেব, আমাদের উচ্চ আদালতে মেধা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এমনটা প্রতীয়মান হবে?
আমরা ধরে নিই, বিএনপির আমলে তাঁরা কেউ বাদ পড়েননি। তাহলে জ্যেষ্ঠতা কী দাঁড়াত? এখানে মনে রাখতে হবে, হাইকোর্টে প্রথম যখন অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন জন্মতারিখ একটি ফ্যাক্টর। যেমন—কোনো একটি ব্যাচে পাঁচজন নিয়োগ পেলেন, তাঁদের জ্যেষ্ঠতার ক্রম ঠিক হয় জন্মতারিখের ভিত্তিতে। ওই দশজন বিচারকের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম হলেন বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। শুনেছি, দশজনের মধ্য থেকে দুজন বা শুধু জ্যেষ্ঠতমকেও যদি আপিল বিভাগে নেওয়া হতো, তাহলে অপ্রীতিকর অবস্থা এড়ানো সম্ভব হতো, বাদবাকিরা এক বা দুজনের জন্য বা অন্যায়ের শিকার হওয়া গ্রুপের স্বার্থ রক্ষায় আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। কারণ যা-ই হোক, বিষয়টি বিচারালয়ের জন্য অবমাননাকর। বিচারকদের সুউচ্চ নীতি-নৈতিকতার দিক থেকেও শোভন নয়।
বিএনপির আমলে তাঁরা বাদ না পড়লে জ্যেষ্ঠতার ক্রম দাঁড়াত এ রকম: ১. বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, ২. বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, ৩. বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, ৪. বিচারপতি এম এ হাই, ৫. বিচারপতি ফারুক আহমেদ, ৬. বিচারপতি মারযি উল হক, ৭. বিচারপতি মো. শামছুল হুদা, ৮. বিচারপতি আবদুর রাজ্জাক, ৯. বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, ১০. বিচারপতি ইমান আলী, ১১. বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, ১২. বিচারপতি শেখ রেজওয়ান আলী, ১৩. বিচারপতি খন্দকার মূসা খালেদ, ১৪. বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হক, ১৫. বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, ১৬. বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ১৭. বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক ও ১৮. বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। উল্লিখিত ১৮ জনই আওয়ামী লীগ আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার প্রথম সরকার কিন্তু নিতান্ত দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেয়নি। যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকেই তখন নিয়োগ পান। পরে রাজনীতির মান নিচে নেমেছে। সেই সঙ্গে দলীয় চোখে অনেক কিছু দেখার প্রবণতা তীব্র হয়েছে। জোট সরকারের ‘প্রলয়ের’ মধ্য দিয়ে বিচারক নিয়োগে ধস নামে। তবে এ লেখায় আমরা জ্যেষ্ঠতা ও মেধা কিংবা অন্যবিধ বিবেচনা কীভাবে কাজ করে, সেটা দেখব।
২৪ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে নিয়োগ পান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন, বিচারপতি সিনহা ও বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়া। তিনের ভাগ্য তিন রকম হলো। এই তিন রকম হওয়ার সঙ্গে জ্যেষ্ঠতা ও মেধার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। এখনো নেই। আমাদের বিচার বিভাগ এই যে পাঁকে আছেন, সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করতে হবে। তাঁকে বাঁচাতে হবে। একই তারিখে আওয়ামী লীগ আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি সিনহা অনেক আগেই আপিল বিভাগে গেলেন। বিচারপতি ওয়াহ্হাবের সঙ্গে বিচারপতি সিনহার বয়সের ব্যবধান মাত্র ১০ মাস। তিনি তরতরিয়ে এমনকি একই তারিখের সতীর্থ সিকদার মকবুল হককে ডিঙিয়ে দেড় বছর আগেই ওপরে গেলেন। এখন বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনের এই অনুভূতি হতে পারে যে তাঁর চেয়ে বয়সে দুই কনিষ্ঠের হলোটা কী? বিচারপতি সিনহা বয়সে তাঁর চেয়ে সাত বছরের কনিষ্ঠ। বিচারপতি ওয়াহ্হাবও সাত বছরের কনিষ্ঠ। বিএনপি তাঁকে বাদ না দিলে তাঁর আগে বিচারপতি সিনহার আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা নয়। অথচ বিচারপতি সিনহার নাম ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতি হিসেবেও শোনা যায়। এখন আবার একই তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি ওয়াহ্হাব তাঁর চেয়ে ঢের কনিষ্ঠ হয়েও আপিল বিভাগে চলে গেলেন।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ২৮ মে ২০০০ সালে নিয়োগ পান। তাঁর সঙ্গে একই ব্যাচে নিয়োগ পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে শুধু তাঁকেই বিএনপি স্থায়ী করেছিল। ওই পাঁচজনের একজন ছিলেন এ এফ এম মেসবাহ উদ্দিন। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন। ১০ জন বিচারকের মামলার পর তাঁকে হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। কয়েক দিন পরই শুনলাম, তাঁর জামাতা বিচারক হচ্ছেন। তাঁর জামাতা অ্যাটর্নি জেনারেলের কক্ষে ভাঙচুরে অংশ নিয়েছিলেন বলে বিতর্কিত হন। আওয়ামী লীগ মনোনীত একজন প্রধান বিচারপতি তাঁকে সে জন্য শপথ পাঠ করাননি। তবে শিগগিরই হয়তো আমরা দেখব, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে আন্দোলন করা নিষিদ্ধ করে একটি প্রস্তাব প্রধান বিচারপতি ফুলকোর্টে পেশ করছেন। আর সেই অভিযুক্ত অতিরিক্ত বিচারক তাতে সমর্থন দিচ্ছেন।
যা হোক, গণছুটিতে থাকা পাঁচজন বিচারকের একজনই কেবল আপিল বিভাগের সদ্য উন্নীত চারজনের তুলনায় নিয়োগের মূল তারিখের নিরিখে জ্যেষ্ঠ। বাকি চারজনের তিনজনই বিচারপতি ওয়াহ্হাব ও বিচারপতি নাজমুন আরার চেয়ে পরে নিয়োগ পেয়েছেন। এই তিনজন—বিচারপতি এম এ হাই, বিচারপতি ফারুক ও বিচারপতি হুদা ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালের একই তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। যদি আমরা ধরে নিই, তাঁরা শুধু বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন বা গ্রুপ বিবেচনায় নয়, সংহতির জন্য নয়, তাঁরাও আপিল বিভাগে যেতে চান। তাহলে আমরা ধরে নেব তাঁরা জ্যেষ্ঠতা নয়, মেধার বিষয়টিকেও সামনে আনছেন। আপিল বিভাগে উন্নীত হওয়া অন্য দুজন বিচারক বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি ইমান আলী তাঁদের সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালেই হাইকোর্টের বিচারক হন। তবে তাঁরা জন্মতারিখ হিসাবে মূল জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ওই তিনজন এবং আরও দুজনের কনিষ্ঠ ছিলেন।
লক্ষণীয়, গণছুটিতে থাকা কনিষ্ঠতম বিচারক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মূল নিয়োগ ৩ জুলাই ২০০১। একই তারিখে অপর আটজনের সঙ্গে অতিরিক্ত বিচারক হন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মো. নিজামুল হক। তিনি গণছুটিতে যোগ দেননি। তবে তাঁর সংহতি প্রতীয়মান হলেও হতে পারে। কারণ ওই পাঁচজনের আলোচিত গণছুটিতে যাওয়ার দিনটিতে তিনিও ছুটি নেন। তিনি এখন দুই সপ্তাহের ‘শ্রান্তি ও বিনোদন’ ছুটিতে আছেন। ওই ১০ জনের মধ্যে তাঁদের অবস্থান যথাক্রমে সাত ও আট। হাইকোর্টের বিদ্যমান জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ওই ১০ জনের ক্রমিক হলো ৪৬ থেকে ৫৫। একই সময়ে নিয়োগ পাওয়া অন্য সতীর্থরা অবশ্য জ্যেষ্ঠতার শীর্ষে।
আপিল বিভাগে সদ্য নিয়োগ পাওয়া চারজনই দীর্ঘ সময় থাকবেন। হয়তো সে কারণেও এবারে বঞ্চিতদের বেদনাভার তীব্র হয়েছিল। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চারজনই আপিল বিভাগে থাকবেন। আরেকটি বিবেচনা হলো, বিএনপি এলে তাঁদের আপিল বিভাগে যাওয়া কখনো হবে না। আর সরকার হয়তো অঙ্ক কষেছে। তারা দেখেছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসতে না পারলেও আপিল বিভাগ থেকে তাঁরা সহানুভূতি পাবেন। গণছুটিতে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনসহ তিনজন আগামী ডিসেম্বর, বিচারপতি মো. শামছুল হুদা (গোপালগঞ্জ নিবাসী) ডিসেম্বর ২০১২ এবং বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে অবসরে যাবেন। বিচারপতি নিজামুল হকের অবসরের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১৭। শেষোক্ত তিনজন শুধুই মেধার লড়াইয়ে নেমেছিলেন ভাবতে পারলে বাধিত হতাম।
আপিল বিভাগ জাতির শেষ দুর্গ। আমরা এটা যদি আদৌ আগলাতে চাই, ভবিষ্যতে আরও ভঙ্গুর অবস্থা না দেখতে চাই, তাহলে এখনই সতর্ক হতে হবে। সংসদকে নতুন বিধান করতেই হবে। প্রধান বিচারপতির সুপারিশ মান্য হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু সার্বিকভাবে, বিশেষ করে যে অযাচিত বিলম্বে ও যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগের ঘটনা ঘটল, তা অস্বচ্ছ ও অনভিপ্রেত; আপিল বিভাগের রায়েরও পরিপন্থী। প্রায় দুই বছর ধরে আপিল বিভাগ রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। সর্বোচ্চ বিচারালয়ের ভাবমূর্তি ও বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল। আপাতত একটা গুমোট অবস্থার অবসান হয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments