শ্রদ্ধাঞ্জলি-স্মৃতিতে উজ্জ্বল ফওজিয়া সামাদ by আসমা আব্বাসী

মাঝেমধ্যে এমন কিছু ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়, যাঁদের বলা চলে শতাব্দীর ফুল। বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা, দয়া-দাক্ষিণ্য, সেবা, করুণা, সহূদয়তায় প্রস্ফুটিত তাঁদের চরিত্র, সঙ্গে আছে স্বভাব ও চেহারার সহজাত সৌন্দর্য। বেগম ফওজিয়া সামাদ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র মহিলা সম্পাদক, যিনি মিনার নামক পত্রিকার সম্পাদনা করে জন্ম দিয়েছেন আমাদের বাংলাদেশের বহু জ্ঞান-গুণী সাহিত্যিকের।


১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে মিনার-এর প্রথম প্রকাশ। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, কুদরাত-এ-খুদা, সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশংকর রায়, কবি জসীমউদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, বেগম সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, কামরুল হাসান, রোকনুজ্জামান খান, ফারুক চৌধুরী, নূরুল হোসেন খান, সালমা চৌধুরী, বন্দে আলী মিয়া, হাবিবুর রহমান তাঁদের লেখা দিয়ে মিনারকে করে তুলতেন আকর্ষণীয়। এ পত্রিকাটির মধ্য দিয়েই কত সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়ে পাপড়ি মেলেছে ভাবতে গেলে শ্রদ্ধায় নুয়ে আসে হূদয়।
রেডিওতে উপস্থাপিকা হিসেবে আবির্ভাব হলো তাঁর। সহজ-সরল মনের অধিকারী, অনায়াস দক্ষতায় কাছে টেনে নেন। রেডিওতে ছোটদের আসর ‘খেলাঘর’ তাঁরই সাবলীল উপস্থাপনায় অগণিত শিশুমন জয় করে নিয়েছিল। একদিন নাজিমউদ্দিন রোডে রেডিও পাকিস্তানের ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘরে নিয়ে গেলেন আমাদের। অনেক বাচ্চার ভিড়ে বসে আছি দুই বোন। একসময় কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি আস্তে করে বললাম, ‘আমার নাম আসমা।’ ছোট বুবু আরও আস্তে বললেন, ‘আমার নাম নাজমা।’ সেই হলো আমার বেতার জগতের হাতেখড়ি।
পদ্মা মেঘনা যমুনা সুরমায় কত জল গড়াল। বর্ষপরিক্রমায় আমরা এখন ঢাকায় বাস করি। প্রায়ই যাই আনন্দের কানন বাড়িটিতে। সামাদ ভাই, ফওজিয়া ভাবি, পুত্র তৌহিদ, কন্যাত্রয় ফেন্সি-তমজু-মফফি যেন বিধাতার সযতনে গড়া পরিবার। এত হাসিখুশি, নম্র ওদের তুলনা দিই কার সঙ্গে। দরজা তাঁদের সদাই খোলা, ঘরের এবং মনের, যাঁর যখন খুশি ঢুকছেন, কোনো নিষেধ নেই।
মৌলভীবাজারের তাজপুরে মৌলভি সফর আলী ও বেগম আজিজুন্নেসার কন্যা ফওজিয়া সামাদ সমাজসেবায় এগিয়ে এলেন। ঢাকা লেডিস ক্লাব কী অসামান্য দক্ষতায় ও দৃঢ়তায় নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের সুরুচিসম্পন্ন মহিলাদের জন্য এক বিরাট আশ্রয়স্থল করে দিলেন। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর নিরলস কর্মতৎপরতা দিয়ে একে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে গেছেন। সমাজের দুস্থ মানুষের সেবা করার সংকল্প তাঁকে দিয়েছে সেই মনোবল, যাতে তিনি কোনো কিছুতেই পিছু ফিরে তাকাননি। একসময়ের ছোট্ট একটি ক্লাবের হাল ভাঙা নৌকায় হাল ধরে তিনি সমাজসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেন। দুস্থ-নিঃস্ব অসহায় শিশু-কিশোরদের জন্য আটটি অবৈতনিক স্কুল গড়ে উঠল। বন্যা, ত্রাণ, ঘূর্ণিঝড় যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে লেডিস ক্লাব এসেছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। শীতবস্তু বিতরণ, আর্সেনিকমুক্ত পানি, স্বল্প আয়ে গৃহনির্মাণ—কত না প্রকল্প ছিল তাঁর। আজিজুস সামাদ বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স করপোরেশনের কর্ণধার সুসাহিত্যিক, শিল্পানুরাগী, সমাজসেবক, তাই তাঁদের দুজনের মণিকাঞ্চন সম্মিলনে আমাদের সংস্কৃতি ভুবন হয়েছে সমৃদ্ধ।
ক্লাবটিতে সেলাই শেখার ক্লাস, বয়স্কদের শিক্ষাকেন্দ্র, সংগীতের ক্লাস, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি সবই আছে। দীর্ঘদিন ধরে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে তিনি ক্লাবের প্রতিটি ভালোমন্দকে নিজের করে নিয়েছিলেন। তাঁর যোগ্যতা, মেধা, সহনশীলতা, স্নেহ, মমতা ও পারদর্শিতায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন অগণিত ভক্ত বোন। তিনি ছিলেন এক বিরাট মহীরুহ, যাঁর ছায়ায় ক্লাবের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সদস্য সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। একদিকে নিয়ম-নিষ্ঠার ব্যাপারে কড়া প্রশাসক, অন্যদিকে মমতাময়ী মাতৃরূপ। সন্তানের মতো লালন করেছেন তিনি ক্লাবটিকে, মনে হতো প্রাঙ্গণের কোনো গাছের একটি পাতা পড়লেও তিনি জানতে পারবেন।
আজকাল কত প্রতিষ্ঠানে কত অনুষ্ঠান হয়, ভালোমন্দ মেশানো। সবখানেই শুনতে পাই কেউ না কেউ বলছেন, বেগম ফওজিয়া সামাদের মতো নেত্রী আমাদের যে এখন বড় প্রয়োজন, যিনি তাঁর সর্বনিম্ন বেতনের কর্মচারীর দৈনন্দিন জীবনেরও খবর রাখতেন, তাঁদের অসুস্থতায় চিকিৎসার সিংহভাগ ছিল তাঁরই পরিবারের এবং যোগ্য উত্তরসূরি তৌহিদ সামাদের পক্ষ থেকে। উচ্চবিত্তের তালিকা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন, তাই যেকোনো মানুষ যেকোনো মুহূর্তে তাঁর কাছে পৌঁছে যেত নিঃশঙ্কচিত্তে।
বিশ্বাস হয় না, আমাদের এত আদরের একজন মানুষ, এত সহসাই বিদায় নিলেন শত কোলাহল থেকে। বিশেষ করে যখন লেডিস ক্লাবে এখনো হয় বর্ষামঙ্গল, নববর্ষ, বসন্ত উৎসব ফওজিয়া সামাদের তৈরি সেন্ট্রাল হলটি, যেটি তাঁর নামেই উৎসর্গ করা, সেখানে সবই আছে, শুধু নেই সৌম্যকান্তি অসীম ধৈর্যশীল সেই মহীয়সী নেত্রী।
আসমা আব্বাসী

No comments

Powered by Blogger.