সময়ের প্রতিধ্বনি-রাজনীতির নামে অপরাজনীতি বন্ধ হোক by মোস্তফা কামাল

প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মন্তব্য দিয়েই শুরু করছি। তিনি বলেছেন, 'মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা চাপা দিতে ইলিয়াস আলী ইস্যু সৃষ্টি করা হয়েছে।' তিনি কালের কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আশা প্রকাশ করে বলেন, 'ইলিয়াস আলী জনসমক্ষে ফিরে আসবেন।


' উভয় পক্ষ কী তাহলে ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ রহস্য' সম্পর্কে অবগত? দেন-দরবারে মিলছে না বলেই কী ইলিয়াস আলীকে জনসমক্ষে হাজির করা হচ্ছে না?
প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলছে, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি পরিকল্পিত। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য তাঁর (ইলিয়াস আলী) নেত্রীর পরামর্শেই হয়তো তিনি আত্মগোপন করেছেন। এটা তাঁদের সাজানো নাটক। হারিছ চৌধুরীসহ বিএনপির অনেক নেতাই তো এখনো নিখোঁজ রয়েছেন!'
এর আগে অবশ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সরকার বিব্রত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন তাঁকে উদ্ধারের জন্য সময় চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে সান্ত্বনা জানাতে তিনি তাঁর বাসায় গেছেন। এর পরও কেন প্রধানমন্ত্রী ঘটনাটিকে বিএনপির সাজানো নাটক বললেন, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি আগবাড়িয়ে এই মন্তব্যটি না করলেও পারতেন! এমনিতেই মন্ত্রীদের বেফাঁস কথাবার্তায় সরকারকে প্রায়ই বিপদে পড়তে হয়! প্রধানমন্ত্রীও যদি বেফাঁস কথা বলে ফেলেন, তাহলে আর বের হওয়ার পথ কোথায়?
বিএনপি শুরু থেকেই বলে আসছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা আড়াল করতেই সরকার ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। তারা জীবিত ইলিয়াস আলীকে ফেরত চেয়েছে। অন্যথায় কঠোর আন্দোলন করবে বিএনপি। ইতিমধ্যেই জনগণের ওপর টানা তিন দিনের হরতাল চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বাসের সঙ্গে মানুষও পোড়ানো হয়েছে। তিন দিনের হরতালে প্রাণ দিয়েছেন আরো কয়েকজন সাধারণ মানুষ। দেশের অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক চাপ পড়ছে। মধ্য ও নিম্ন-আয়ের মানুষের হতাশা বাড়ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে বাড়ছে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা- না জানি কী হয়! বিএনপি আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছে। ভাবছে না পরীক্ষার্থীদের অনাগত ভবিষ্যতের কথা। একজন সাধারণ মানুষ নিখোঁজ হলে আন্দোলন তো দূরের কথা, একটা বিবৃতিও দেয় না। কদিন আগে ইলিয়াস আলীর গ্রামেরই দুজন নিখোঁজ হয়েছেন। অথচ এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি। এ বিষয়টিও ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রাজনীতিকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন ১৭ এপ্রিল রাতে। তার আগে তিনি রূপসী বাংলা হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করেছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমরা জানতে পারিনি। তবে টেলিভিশনে প্রচারিত এবং পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য র‌্যাব-পুলিশ অভিযানের পর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করতে পারেনি। অথচ দৈনিক সমকাল তিন দিন ধরে (২২, ২৩ ও ২৪ এপ্রিল) ইলিয়াস আলীকে নিয়ে যে হেডলাইন করছে তাতে অনেক রহস্য বেরিয়ে আসছে। ওই রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সরকারের লোকেরাই তাঁকে লুকিয়ে রেখেছে। এখন বিএনপির সঙ্গে তারা দেন-দরবার করছে। ১০টি শর্ত মেনে নিলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। শুরুতে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে বেশ কথাবার্তা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, 'সান্ত্বনা চাই না, স্বামীকে ফেরত চাই।' তিনি এও বলেছেন, 'সরকারি সংস্থার লোকেরাই আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে।' তাঁর সঙ্গে র‌্যাবের সদস্যরা একাধিকার সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁকে নিয়ে নাকি র‌্যাব-পুলিশ অভিযানেও গেছে। তারপর ইলিয়াসের স্ত্রী বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। হঠাৎ করেই তিনি গণমাধ্যমের সামনে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এর রহস্য কী? তাহলে কি বেগম জিয়া ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ রহস্য' সম্পর্কে অবগত? তাহলে কেন দেশের মানুষের ওপর হরতাল চাপিয়ে দেওয়া হলো? কেন আগুন জ্বালিয়ে মানুষ পোড়ানো হলো? কেন এই অপরাজনীতি? শুধুই কি একটা ইস্যু সৃষ্টির জন্য একজন ইলিয়াস আলীকে নিখোঁজ করা হলো?
এটা ঠিক যে হত্যা, গুম, অপহরণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। পত্রিকার পাতা খুললেই কোনো না কোনো দুঃসংবাদ, অঘটনের খবর চোখে পড়ে। টিভি পর্দায় ভেসে ওঠে নির্মমতার নানা দৃশ্য। সকালে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস দীর্ঘদিনের। কিন্তু এখন সকালে আতঙ্কে ঘুম ভাঙে। পত্রিকা হাতে নিতে ভয় লাগে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় একেবারে কুঁকড়ে যাই। একটা সময় দুঃসংবাদগুলো গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন কেন জানি আর সহ্য করতে পারি না। প্রায় দিনই সকালে বৃদ্ধ মা-বাবা ফোন করে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে কেমন আছি তা জানতে চান। আর আমি উদ্বিগ্ন থাকি আমার সন্তানদের নিয়ে। যে দেশে আট মাসের শিশুও নিজের ঘরে নিরাপদ নয়, সে দেশে পিতা-মাতারা তো আতঙ্কেই থাকবেন। আর এখন প্রত্যেক মানুষই গুম আতঙ্কে ভুগছেন। বিশেষ করে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর গণমাধ্যমের কল্যাণে (!) সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। 'এই বুঝি কেউ তুলে নিয়ে গেল'- এমন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে অসংখ্য মানুষের।
দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিধান করাই সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, 'কারো বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়। অথবা ইলিয়াস আলী তাঁর নেত্রীর নির্দেশে আত্মগোপন করেছেন।' তখন আর বলার কিছু থাকে না। তাহলে সরকারের দায়িত্ব কী? দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হলে নিশ্চয়ই সাংবাদিক সাগর-রুনি তাঁদের বেডরুমে নিহত হতেন না! আর ইলিয়াস আলী যদি আত্মগোপনই করবেন, তাহলে র‌্যাব-পুলিশ কী করছে? তারা তো তাঁকে খুঁজে বের করে বিএনপির ষড়যন্ত্র মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারে! তার মানে এটা নিয়েও 'রাজনৈতিক গেম' শুরু হয়েছে! ইলিয়াস আলী সেই রাজনৈতিক গেমের বলির পাঁঠা হবেন না তো? নাকি চট্টগ্রামের জামালউদ্দিনের মতো পরিণতি বরণ করতে হবে তাঁকে? ২৩ এপ্রিল ইত্তেফাকের রিপোর্টে তো সে রকম ইঙ্গিতই পাওয়া গেল!
আসলে পর্দার আড়ালে কী ঘটছে তা ধারণা করাও কঠিন। সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইলিয়াস আলীকে নিয়ে যেসব রিপোর্ট বেরিয়েছে তার বেশির ভাগই নাকি কল্পকাহিনী। সরকারি প্রেসনোটেও কিছু পত্রিকার রিপোর্টকে কল্পকাহিনী বলেছে। তাহলে সত্যটা কী সেটা বলুন! সব কিছুই কেমন যেন ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। তবে ইলিয়াস আলীর ঘটনাটি যে রাজনীতিকে ঘোলাটে করে তুলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ইস্যুতে সরকারই বেকায়দায় পড়েছে। এটা যে বিএনপির সাজানো নাটক, তা কেউ বিশ্বাস করছে না। মানুষ মনে করে, সরকারই ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রেখেছে। মানুষের মনের এই সন্দেহ দূর করতে সরকারকে নতুন নাটক সাজাতে হবে।
রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ষড়যন্ত্রের নাটক, কল্পিত নাটক দেখতে দেখতে মানুষ রীতিমতো হতাশ। দেশের মানুষ এসব আর দেখতে চায় না। এর থেকে মুক্তি চায়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরকে শত্রু মনে না করে প্রতিপক্ষ ভাবতে হবে। তা না হলে রাজনীতি কলুষিত হতেই থাকবে। রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনীতির নামে অপরাজনীতি জনগণ আর দেখতে চায় না।
পরিশেষে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মন্তব্য দিয়েই শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী আজ আছে কাল নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে যতটুকু জানি, তিনি সংলাপে বসবেন না, এটা হতে পারে না। সংলাপে বেগম জিয়ার আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু শেখ হাসিনার আপত্তি থাকার কথা নয়।'
ব্যারিস্টার হক যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাটি বলেছেন সেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে চাই, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেবেন। তিনি বেগম জিয়াকে টেলিফোন করে বলবেন, কী সমস্যা- আসুন, আমরা আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করি। বেগম জিয়াও তাতে সায় দেবেন। দুই নেত্রীই কিছু ছাড় দিয়ে সমঝোতার পন্থা বের করবেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতিও বঙ্গভবনে দুই নেত্রীকে চায়ের দাওয়াত দিতে পারেন। সেখানেই তাঁরা আলোচনা করে ঠিক করবেন, আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে? সময় কিন্তু বেশি নেই। উদ্যোগটা এখনই নিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.