বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৭৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, বীর প্রতীক কুশলী এক যোদ্ধার কথা মোহাম্মদ আব্দুস সালামসহ এক দল মুক্তিযোদ্ধা শেষ রাতে নিঃশব্দে হাজির হলেন একটি সেতুর ধারে। সেখানে আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী এক দল মিলিশিয়া ও রাজাকার।
কৌশলে তাদের আটক করলেন তাঁরা। তারপর বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিলেন সেতু। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের।
এই অপারেশনের বর্ণনা শোনা যাক মোহাম্মদ আব্দুস সালামের বয়ানে: ‘সময়টা আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। সে সময় একদিন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) ক্যাম্পে এলেন। শায়েস্তাগঞ্জের পূর্ব পাশে কেরাঙ্গী নদীর ওপর দারাগাঁও রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিং দিলেন। তাঁর ব্রিফিং শেষ হওয়া মাত্র আমি বলে উঠলাম, এই অপারেশন আমি করতে পারব।
‘পরে সাব-সেক্টর কমান্ডার আমাকে নিয়ে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তৈরি করে কত জনবল দরকার, কারা কারা যাবেন ইত্যাদির তালিকা করলেন। বিস্ফোরক কীভাবে লাগাতে হবে সে বিষয়ে আমরা বিশদ জেনে নিলাম। সেতু ভাঙতে ৪০০ পাউন্ড হাই এক্সপ্লোসিভ দরকার হবে। আমরা মোট ৪০ জন অপারেশনে যাব। দলের প্রত্যেকে ১০ পাউন্ড করে নিলে ৪০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ হয়।
‘আমাদের ক্যাম্প থেকে অপারেশনস্থল প্রায় ২৫ মাইল দূরে। সময় হিসাব করে বেলা ১২টার দিকে আশ্রমবাড়ির ক্যাম্প থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও একটি ট্রাক্টরে আমরা সিন্দুরখান সীমান্তে যাই। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে হাঁটতে থাকি। পাহাড়ি পথ। কখনো ৩০০ ফুট উঁচুতে উঠতে হয়, কখনো সমতলে নামতে হয়। এভাবে বিকেল তিনটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হেঁটে আমরা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছি।
‘সেতুর দুই পাশেই পাহারা। মিলিশিয়া ও রাজাকার মিলে ১২ জন। সেতুটি ৬০-৭০ গজ দীর্ঘ। সেখানে ঘূর্ণমান সার্চলাইট জ্বালানো। আমরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হলাম। একটি দল গেল পশ্চিম পাশে। একটি দল পূর্ব পাশে। একটি দল থাকল বিস্ফোরক লাগানোর জন্য।
‘ক্রলিং করে সেতুর কাছে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাহারারত দুই মিলিশিয়াকে কৌশলে আমরা আটক করলাম। বাকিরা ঘরের ভেতর তাস খেলছিল। তাদেরও আমরা একই কায়দায় আটক করলাম। আমাদের সংকেত পেয়ে এক্সপ্লোসিভ দল সেতুতে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে শুরু করল। এক্সপ্লোসিভ লাগানো শেষ। এমন সময় দেখি দুই রাজাকার চা নিয়ে আসছে। তাদের আমরা গুলি করে মেরে ফেললাম। আগে আটক করা ব্যক্তিদের সেতুর মাঝখানে বেঁধে রাখা হলো।
সেফটি কর্ডে আগুন দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল। মনে হলো আকাশ ভেঙে বজ্রপাত হচ্ছে। ভেঙে পড়তে থাকল লোহার গার্ডার। লোহার কিছু টুকরো উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল।’
মোহাম্মদ আব্দুস সালাম ১৯৭১ সালে ঢাকার জিন্নাহ (বর্তমান তিতুমীর) কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ি সাব-সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ আব্দুস সালামকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৪১। গেজেটে নাম আব্দুস সালাম।
মোহাম্মদ আব্দুস সালামের পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার বরায়া উত্তরভাগ গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে কর্নেল হিসেবে অবসর নেন। তাঁর বাবার নাম এইচ এম আলী, মা মোমেনা খানম। স্ত্রী নূরনাহার সালাম। তাঁদের এক ছেলে।
সূত্র: মোহাম্মদ আব্দুস সালামের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন রাফিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
এই অপারেশনের বর্ণনা শোনা যাক মোহাম্মদ আব্দুস সালামের বয়ানে: ‘সময়টা আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। সে সময় একদিন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) ক্যাম্পে এলেন। শায়েস্তাগঞ্জের পূর্ব পাশে কেরাঙ্গী নদীর ওপর দারাগাঁও রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিং দিলেন। তাঁর ব্রিফিং শেষ হওয়া মাত্র আমি বলে উঠলাম, এই অপারেশন আমি করতে পারব।
‘পরে সাব-সেক্টর কমান্ডার আমাকে নিয়ে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তৈরি করে কত জনবল দরকার, কারা কারা যাবেন ইত্যাদির তালিকা করলেন। বিস্ফোরক কীভাবে লাগাতে হবে সে বিষয়ে আমরা বিশদ জেনে নিলাম। সেতু ভাঙতে ৪০০ পাউন্ড হাই এক্সপ্লোসিভ দরকার হবে। আমরা মোট ৪০ জন অপারেশনে যাব। দলের প্রত্যেকে ১০ পাউন্ড করে নিলে ৪০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ হয়।
‘আমাদের ক্যাম্প থেকে অপারেশনস্থল প্রায় ২৫ মাইল দূরে। সময় হিসাব করে বেলা ১২টার দিকে আশ্রমবাড়ির ক্যাম্প থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও একটি ট্রাক্টরে আমরা সিন্দুরখান সীমান্তে যাই। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে হাঁটতে থাকি। পাহাড়ি পথ। কখনো ৩০০ ফুট উঁচুতে উঠতে হয়, কখনো সমতলে নামতে হয়। এভাবে বিকেল তিনটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হেঁটে আমরা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছি।
‘সেতুর দুই পাশেই পাহারা। মিলিশিয়া ও রাজাকার মিলে ১২ জন। সেতুটি ৬০-৭০ গজ দীর্ঘ। সেখানে ঘূর্ণমান সার্চলাইট জ্বালানো। আমরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হলাম। একটি দল গেল পশ্চিম পাশে। একটি দল পূর্ব পাশে। একটি দল থাকল বিস্ফোরক লাগানোর জন্য।
‘ক্রলিং করে সেতুর কাছে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাহারারত দুই মিলিশিয়াকে কৌশলে আমরা আটক করলাম। বাকিরা ঘরের ভেতর তাস খেলছিল। তাদেরও আমরা একই কায়দায় আটক করলাম। আমাদের সংকেত পেয়ে এক্সপ্লোসিভ দল সেতুতে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে শুরু করল। এক্সপ্লোসিভ লাগানো শেষ। এমন সময় দেখি দুই রাজাকার চা নিয়ে আসছে। তাদের আমরা গুলি করে মেরে ফেললাম। আগে আটক করা ব্যক্তিদের সেতুর মাঝখানে বেঁধে রাখা হলো।
সেফটি কর্ডে আগুন দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল। মনে হলো আকাশ ভেঙে বজ্রপাত হচ্ছে। ভেঙে পড়তে থাকল লোহার গার্ডার। লোহার কিছু টুকরো উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল।’
মোহাম্মদ আব্দুস সালাম ১৯৭১ সালে ঢাকার জিন্নাহ (বর্তমান তিতুমীর) কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ি সাব-সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ আব্দুস সালামকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৪১। গেজেটে নাম আব্দুস সালাম।
মোহাম্মদ আব্দুস সালামের পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার বরায়া উত্তরভাগ গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে কর্নেল হিসেবে অবসর নেন। তাঁর বাবার নাম এইচ এম আলী, মা মোমেনা খানম। স্ত্রী নূরনাহার সালাম। তাঁদের এক ছেলে।
সূত্র: মোহাম্মদ আব্দুস সালামের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন রাফিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments