চট্টগ্রাম বন্দর দিবস-আধুনিক ও গতিশীল বন্দর চাই by মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী

ভবিষ্যতের চাহিদা এবং অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় এনে ভূমি সদ্ব্যবহারের দূরদর্শী পরিকল্পনা নেওয়া হলে অসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে নিশ্চিত হোক বন্দরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ভূমিসম্পদের আর নয় অপচয়, অপব্যবহার ও অপদখল।


বন্দর প্রশাসনের মিশন হোক ভূমির সদ্ব্যবহার, ভিশন হোক বন্দরের উন্নয়ন

জাতীয় অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর ১২৫তম বছরে পদার্পণ করেছে আজ। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রফতানি পণ্যের ৮০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। বন্দরের বার্ষিক আয় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বন্দরের মাধ্যমে কাস্টমস আয় করে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা নিশ্চিত করছে জাতীয় অর্থনীতির সচলতা, শিল্প উৎপাদনের স্বাভাবিকতা এবং বিনিয়োগের নিশ্চয়তা। ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল কাঠের জেটি ও ঘাট নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১২৫ বছরের বিবর্তনে আজ তা আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ এক কনটেইনার বন্দরে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর মূলত প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়। প্রায় ২৩০০ একর আয়তনের এক বিশাল ভূমি সাম্রাজ্যের অধিকারী চট্টগ্রাম বন্দর। এসব জমিতে কনটেইনার ইয়ার্ড, ট্রাক ও ট্রেইলার টার্মিনাল, শিপইয়ার্ড, ওয়্যার হাউসসহ শিল্প-বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে বিপুল পরিমাণ ভূমি হুকুমদখল করা হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব আয়ত্তে এনে কাজে লাগাতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের বিপুল পরিমাণ ভূমি ছিল ভূমিদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে। ভূমির সদ্ব্যবহার না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের হাজার কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা হারিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমার যোগদানের আগে (২০০০ সাল পর্যন্ত) ভূমি সেক্টরে বাস্তবে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বন্দরের ভূমি ব্যবস্থাপনা করুণ অবহেলার শিকার হয়ে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার রাহুগ্রাসে নিমজ্জিত হয়। ফলে বন্দর চরম আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। বন্দরের ভূমি সেক্টরে অনেক বছর ধরে চলে আসা অনিয়মের উল্লেখযোগ্য হলো : ১. সুষ্ঠু নজরদারির অভাবে ভূমির বেপরোয়া দখল; ২. বিপুল পরিমাণ ভূমি ব্যবহার-অনুপযোগী রাখা; ৩. ভূমির লিজ-লাইসেন্স প্রদানে বহুমাত্রিক অনিয়ম; ৪. ভূমি ব্যবস্থাপনায় কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও উদাসীনতা; ৫. লিজকৃত ভূমির অবৈধ সাবলিজ-বেআইনি হস্তান্তর; ৬. ভূমির রেকর্ডপত্র যথাযথ সংরক্ষণের অভাব; ৭. ভূমি বিষয়ক মামলা নিয়ে জটিলতা; ৮. ভূমির লিজ-লাইসেন্স ফি যুগোপযোগী না করা; ৯. ভূমির সুষ্ঠু ব্যবহার পরিকল্পনার অভাব; ১০. ভূমি ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত জনবলের অভাব।
বন্দরের অবৈধ দখলকৃত ভূমির সুবিধাভোগীরা হলো প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংগঠন ও শ্রমিক নেতা, যারা অর্থ ও পেশিতে শক্তিশালী। ভূমির অবৈধ দখল বন্দরের নিরাপত্তার জন্যও হুমকির কারণ। অবৈধ দখলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চোরাচালান, পরিবেশদূষণ, মাদক ব্যবসা, পণ্য পাচারসহ নানা অপরাধমূলক তৎপরতা। ২০০১ থেকে জুলাই ২০০৩ এবং ফেব্রুয়ারি ২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত পৃথক দুই মেয়াদে বন্দর ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনকালে পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ভূমি উদ্ধারে বিরামহীন অভিযান চালাতে হয়েছিল। এ সময়ে ৫ সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বেদখল হওয়া প্রায় ১৪৫ একর মূল্যবান ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। যার মধ্যে অর্ধশতাব্দীকালের বেদখলকৃত ভূমি এবং ভবনও ছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বন্দরের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী জানতেন না, বন্দরের এত বিপুল পরিমাণ জমি কোথায় এবং কী অবস্থায় পড়ে আছে। ম্যাজিস্ট্রেসির মাধ্যমে অভিযানে ভূমিদস্যুদের কব্জা থেকে হাজার কোটি টাকার ভূমি উদ্ধারের পাশাপাশি অবৈধ দখলের অপরাধে ক্ষতিপূরণ ও জরিমানাও আদায় করা হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ৭টি ক্রাইম জোনও উচ্ছেদ করে বন্দর এলাকায় মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, পরিবেশদূষণ ও পণ্য পাচারের ঘটনা কমিয়ে বন্দরের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সুসংহত করা হয়েছিল। বন্দরের ভূমি উদ্ধার ও ভূমিসম্পদের সুরক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেসির এমন সুদৃঢ় ছত্রছায়া ইতিপূর্বে বন্দর কর্তৃপক্ষ কখনও পায়নি। শুধু ভূমি উদ্ধার নয়, ম্যাজিস্ট্রেসির অনমনীয় ও কঠোর ভূমিকা বন্দরের অপারেশনাল কাজে গতিশীলতা এনেছিল এবং বন্দর প্রশাসনকে অনেক ইস্যুতে শক্তিশালী করেছিল। এর সুফল হিসেবে ভূমি খাতে দুর্নীতি হ্রাস পায় এবং বন্দরের ভূমি রাজস্ব আয় পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। কঠোর উদ্যম, চরম ঝুঁকি এবং অনমনীয় ভূমিকার মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ভূমি সেক্টরে বন্দরের ব্যর্থতার পাল্লা এতই ভারী যে, তা বন্দরের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অনেক সোনালি সুযোগকে হাতছাড়া করেছে। দীর্ঘ সময়ের অমার্জনীয় অবহেলা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার ফলে বন্দরের অনেক মূল্যবান জমিতে অনেক সরকারি দফতর-সংস্থা স্থায়ী দখল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ভূমি উদ্ধার বা ফিরে পাওয়ার আশা সুদূরপরাহত। সময় এসেছে অবহেলায় ফেলে রাখা বিপুল পরিমাণ ভূমিসম্পদকে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে নির্ধারণ করার। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও সম্ভব নয় বন্দরের উন্নয়ন, যদি পর্যাপ্ত ভূমিসম্পদ না থাকে। বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নির্ভর করছে ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহারের ওপর। পোর্ট শিপিং সেক্টরে আগামী শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সব ভূমিতে পরিকল্পনামাফিক অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে অব্যবহৃত জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রযুক্তিগত সুবিধা তৈরি করতে হবে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বছরে অন্তত অর্ধসহস্র কোটি টাকা আয় করতে পারে।
ভবিষ্যতের চাহিদা এবং অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় এনে ভূমি সদ্ব্যবহারের দূরদর্শী পরিকল্পনা নেওয়া হলে অসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে নিশ্চিত হোক বন্দরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ভূমিসম্পদের আর নয় অপচয়, অপব্যবহার ও অপদখল। বন্দর প্রশাসনের মিশন হোক ভূমির সদ্ব্যবহার, ভিশন হোক বন্দরের উন্নয়ন। চট্টগ্রাম বন্দর পরিণত হোক অফুরন্ত সম্ভাবনাময় আধুনিক মহাবন্দরে_ বন্দর দিবসে এ প্রত্যাশা সবার।

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী : সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম বন্দর; বর্তমানে পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদফতর, সদর দফতর, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.