রাজনীতি-হায় সংসদ! হায় গণতন্ত্র! by সোহরাব হাসান
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬০টিরও বেশি আসন পেল। তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন কোরামের অভাবে নবম সংসদের অধিবেশন মূলতবি হয়ে যাবে? ভাবেননি।
সব সম্ভবের এই দেশে ভাবনারও অতীত ঘটনা ঘটে। নেতা-নেত্রীরা ঘটান। সাংসদেরা ঘটান। কেবল জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা তাঁরা পূরণ করেন না।
সব সম্ভবের এই দেশে ভাবনারও অতীত ঘটনা ঘটে। নেতা-নেত্রীরা ঘটান। সাংসদেরা ঘটান। কেবল জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা তাঁরা পূরণ করেন না।
নবম জাতীয় সংসদের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল ভালোভাবেই। বিরোধী দল সংসদে এল, সরকারি দল তাদের অভিবাদন জানাল। কিন্তু তার পরই একটার পর একটা অঘটন ঘটতে থাকে। বিরোধী দল বলল, ‘প্রথম সারিতে আরও আসন চাই।’ সরকারি দল বলল, ‘তোমাদের যা প্রাপ্য, তারচেয়ে বেশি আসন দিয়েছি।’ অর্থ নয়, কীর্তি নয়, দেশ নয়, জনগণের স্বার্থ নয়, আসন নিয়ে যুদ্ধ। কেউ কারে নাহি ছাড়ে সূচ্যগ্র মেদিনী।
তারপর বিরোধী দল রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়, ‘মাধবীর মতো এসেই বলে যাই’। গত বছরের ৩ জুন থেকে তারা সেই যে সংসদবিমুখ হলো, আর ওদিকে পা বাড়ায়নি। বিরোধী দলের এক দফা এক দাবি, ‘আমরা সংসদে যেতে চাই। কিন্তু সংসদে যাওয়ার পরিবেশ নেই।’
দুই দশক ধরে সংসদ চলছে কানামাছি খেলার মতো। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ সংসদের বাইরে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সংসদের বাইরে। তারা কেউ নিজেকে বিরোধী দলে দেখতে চায় না। ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক আছে। ক্ষমতার বাইরে গেলেই যত বাহানা। কিন্তু সরকারি দলের, সরকারে স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদে কেউ পদত্যাগ করে না। সংসদ হলো ক্ষমতা, সংসদ হলো শক্তি, সংসদ হলো মর্যাদা, সংসদ হলো সাধারণ থেকে নিজেকে আলাদা করার সীমারেখা। সংসদে না থাকলে সবুজ পাসপোর্ট লাল হয় না (এই লাল পাসপোর্টের জোরে বিএনপি আমলে এক সাংসদ অন্যের ছেলেকে নিজের ছেলে বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে)।
যেই বিএনপি পরিবেশ না থাকার অজুহাতে সংসদ বর্জন করে চলেছে, সেই বিএনপি ৯০ দিনের আগেই সুড়সুড় করে সংসদে যাবে। সরকারি দলের অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ জানাতে নয়, সদস্যপদ রক্ষা করতে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না, সদস্যপদ রক্ষার মহড়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় কোরাম সংকটের কারণে অধিবেশন রোববার পর্যন্ত মূলতবি করতে বাধ্য হন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। কোরামের জন্য ন্যূনতম ৬০ জন সাংসদ থাকতে হয়। ৩৪৫ জনের সংসদে তাও ছিল না। অনেক সংগ্রাম, প্রাণহানি ও কারাবাসের বিনিময়ে পাওয়া গণতন্ত্রের এই পরিণাম!
মহামান্য সাংসদেরা মনে করেন, জনগণ তাঁদের ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছেন। এই পাঁচ বছরে তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেনন না। এই পাঁচ বছর সচিব, ডিসি, এসপি, ইউএনও প্রকৌশলী মায় আমজনতা সালাম দিতে বাধ্য। এখানে ঠিকাদারদের নাম ইচ্ছে করেই বললাম না। কেননা, ঠিকাদারকে সালাম নিতে হলে নিজের পুত্র-কন্যা, স্ত্রী কিংবা শ্যালকের নাম আসে। সাংসদেরা তাঁদের নামেই ঠিকাদারি ব্যবসা চালান। এই পাঁচ বছরে সংসদে না গিয়েও বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়া যাবে, অফিস ভাড়া, টেলিফোন বিল—সব।
এটি তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের ও জনগণের কর্তব্য। কেননা, তাঁরা জনপ্রতিনিধি। তাহলে আর কষ্ট করে সংসদে যাওয়া কেন?
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল অভিযোগ করেছেন, সংসদ এখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। কিন্তু তিনি যে কথাটি বলেননি তা হলো, ব্যবসাও এখন আর ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। সাংসদেরাই ঠিকাদার-ব্যবসায়ী বনে গেছেন। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি রাজনীতি করলে ব্যবসাও পিছু নেয়। আবার ব্যবসায়ীরা-রাজনীতিকেরাও মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে দলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। দলে যে যত বেশি চাঁদা দেবেন, তাঁর গুরুত্বও তত বেশি।
বাংলাদেশে বিরোধী দল হরতাল পালন ও সংসদ বর্জন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এবং বিএনপি আওয়ামী লীগকে কঠিনভাবে অনুসরণ করছে, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে।
সবকিছুই নাকি হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষা এবং উদ্ধারের জন্য। ক্ষমতাসীনদের জন্য গণতন্ত্র রক্ষা এবং বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র উদ্ধার ফরজ। তাতে ভোটারদের দুর্ভোগ-দুর্গতি বাড়লে কিংবা দেশ অচল হলে তাদের কিছু আসে-যায় না।
আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার। জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদদের দেখা না হলেও মতিঝিলে বা গুলশান বনানীতে ঠিকই তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়। দুই দলের অনেক নেতা একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। কোম্পানি করেন। শেয়ার ব্যবসায় দাও মারেন। বিদেশি কূটনীতিকদের সভায় একসঙ্গে খানাপিনা করেন। এমনকি ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতেও আপত্তি নেই। যত বিপত্তি সংসদে একসঙ্গে বসতে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাঝেমধ্যেই কোরামের অভাবে সংসদ অধিবেশন দেরিতে শুরু হতো। এ নিয়ে টিআইবি একাধিক রিপোর্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে এ কারণে রাষ্ট্রের কত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা জোর গলায় বলতেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরাই যখন সংসদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, তখন আমরা সেখানে গিয়ে কী করব?’
এখন বিএনপির নেতারা যদি সে কথাটিই তাঁদের ফিরিয়ে দেন, আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সাংসদেরা কী বলবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
তারপর বিরোধী দল রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়, ‘মাধবীর মতো এসেই বলে যাই’। গত বছরের ৩ জুন থেকে তারা সেই যে সংসদবিমুখ হলো, আর ওদিকে পা বাড়ায়নি। বিরোধী দলের এক দফা এক দাবি, ‘আমরা সংসদে যেতে চাই। কিন্তু সংসদে যাওয়ার পরিবেশ নেই।’
দুই দশক ধরে সংসদ চলছে কানামাছি খেলার মতো। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ সংসদের বাইরে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সংসদের বাইরে। তারা কেউ নিজেকে বিরোধী দলে দেখতে চায় না। ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক আছে। ক্ষমতার বাইরে গেলেই যত বাহানা। কিন্তু সরকারি দলের, সরকারে স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদে কেউ পদত্যাগ করে না। সংসদ হলো ক্ষমতা, সংসদ হলো শক্তি, সংসদ হলো মর্যাদা, সংসদ হলো সাধারণ থেকে নিজেকে আলাদা করার সীমারেখা। সংসদে না থাকলে সবুজ পাসপোর্ট লাল হয় না (এই লাল পাসপোর্টের জোরে বিএনপি আমলে এক সাংসদ অন্যের ছেলেকে নিজের ছেলে বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে)।
যেই বিএনপি পরিবেশ না থাকার অজুহাতে সংসদ বর্জন করে চলেছে, সেই বিএনপি ৯০ দিনের আগেই সুড়সুড় করে সংসদে যাবে। সরকারি দলের অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ জানাতে নয়, সদস্যপদ রক্ষা করতে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না, সদস্যপদ রক্ষার মহড়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় কোরাম সংকটের কারণে অধিবেশন রোববার পর্যন্ত মূলতবি করতে বাধ্য হন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। কোরামের জন্য ন্যূনতম ৬০ জন সাংসদ থাকতে হয়। ৩৪৫ জনের সংসদে তাও ছিল না। অনেক সংগ্রাম, প্রাণহানি ও কারাবাসের বিনিময়ে পাওয়া গণতন্ত্রের এই পরিণাম!
মহামান্য সাংসদেরা মনে করেন, জনগণ তাঁদের ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছেন। এই পাঁচ বছরে তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেনন না। এই পাঁচ বছর সচিব, ডিসি, এসপি, ইউএনও প্রকৌশলী মায় আমজনতা সালাম দিতে বাধ্য। এখানে ঠিকাদারদের নাম ইচ্ছে করেই বললাম না। কেননা, ঠিকাদারকে সালাম নিতে হলে নিজের পুত্র-কন্যা, স্ত্রী কিংবা শ্যালকের নাম আসে। সাংসদেরা তাঁদের নামেই ঠিকাদারি ব্যবসা চালান। এই পাঁচ বছরে সংসদে না গিয়েও বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়া যাবে, অফিস ভাড়া, টেলিফোন বিল—সব।
এটি তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের ও জনগণের কর্তব্য। কেননা, তাঁরা জনপ্রতিনিধি। তাহলে আর কষ্ট করে সংসদে যাওয়া কেন?
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল অভিযোগ করেছেন, সংসদ এখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। কিন্তু তিনি যে কথাটি বলেননি তা হলো, ব্যবসাও এখন আর ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। সাংসদেরাই ঠিকাদার-ব্যবসায়ী বনে গেছেন। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি রাজনীতি করলে ব্যবসাও পিছু নেয়। আবার ব্যবসায়ীরা-রাজনীতিকেরাও মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে দলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। দলে যে যত বেশি চাঁদা দেবেন, তাঁর গুরুত্বও তত বেশি।
বাংলাদেশে বিরোধী দল হরতাল পালন ও সংসদ বর্জন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এবং বিএনপি আওয়ামী লীগকে কঠিনভাবে অনুসরণ করছে, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে।
সবকিছুই নাকি হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষা এবং উদ্ধারের জন্য। ক্ষমতাসীনদের জন্য গণতন্ত্র রক্ষা এবং বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র উদ্ধার ফরজ। তাতে ভোটারদের দুর্ভোগ-দুর্গতি বাড়লে কিংবা দেশ অচল হলে তাদের কিছু আসে-যায় না।
আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার। জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদদের দেখা না হলেও মতিঝিলে বা গুলশান বনানীতে ঠিকই তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়। দুই দলের অনেক নেতা একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। কোম্পানি করেন। শেয়ার ব্যবসায় দাও মারেন। বিদেশি কূটনীতিকদের সভায় একসঙ্গে খানাপিনা করেন। এমনকি ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতেও আপত্তি নেই। যত বিপত্তি সংসদে একসঙ্গে বসতে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাঝেমধ্যেই কোরামের অভাবে সংসদ অধিবেশন দেরিতে শুরু হতো। এ নিয়ে টিআইবি একাধিক রিপোর্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে এ কারণে রাষ্ট্রের কত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা জোর গলায় বলতেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরাই যখন সংসদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, তখন আমরা সেখানে গিয়ে কী করব?’
এখন বিএনপির নেতারা যদি সে কথাটিই তাঁদের ফিরিয়ে দেন, আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সাংসদেরা কী বলবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments