বাতায়ন পথে নিরীক্ষণঃ সুন্দর হে সুন্দর by আতাউর রহমান
আজকাল অনেক গভীর বিষয়ে খুব হাল্কা প্রবন্ধ পড়ে মন বিগড়ে যায়। নামকরা একটি ইংরেজি পত্রিকা একটি সাময়িকী বের করে। সেখানে হঠাত্ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরে লেখা এক প্রবন্ধ পাঠ করলাম। এ ধরনের প্রবন্ধ পাঠ করে মনে হয় ক্লাস রুমের বক্তৃতা ছাড়া আর কিছু না।
প্রথমেই ভুল একটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। আসলে ব্যাপারটা তা নয়, রবীন্দ্রনাথ উগ্র-জাতীয়বাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যা তার ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি একাধারে ছিলেন ভারতীয় ও বাঙালি এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথের লেখা সহজ-পাঠ্য নয়, কিছুটা মন লাগিয়ে পড়তে হয়, অনেক সময় সব বোধগম্য না হলেও এক ধরনের ভালো লাগা পেয়ে বসে। মহত্ সাহিত্যের সব লক্ষণ তার সব ধরনের লেখায় বিরাজমান। যে কোনো প্রবন্ধ বা নিবন্ধে যদি লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন না ঘটে, আমার ধারণায় সে লেখা পাঠে বৃথা সময় নষ্ট হয়। অবশ্য শিক্ষানবিসদের জন্য উপকারী হতে পারে। আমি গত কয়েকদিন ধরে একটি বর্ণনাসহ রবীন্দ্রসংগীতের সিডি ক্রমাগত শুনছি, বিরক্তি এখনও আসেনি। বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনা এবং গানগুলো গেয়েছেন শ্রীকান্ত আচার্য। শুনতে শুনতে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন যে তার বহুমুখী সৃজন যদি কালের দীর্ঘ পথযাত্রায় হারিয়েও যায়; কিন্তু বাঙালি এই পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকবে, তার গান তাদের শুনতে হবে। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ একমত যে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও সুরারোপিত গান বাঙালির কাছে চিরকাল গ্রহণীয় ও আদরণীয় হয়ে থাকবে। আমার এই যথেষ্ট দীর্ঘ জীবনে দেখেছি যে যারা রবীন্দ্রনাথের ভাষা ও ভাষার দ্যোতনা হুবহু বোঝে না, তারাও রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ওরা রবীন্দ্রসংগীত কেন শোনে, তার উত্তরে বলে, সব না বুঝলেও মাঝে মধ্যে হৃদয়ের একূল-ওকূল দুই কূলই ভেসে যায়। রবীন্দ্রসংগীত এক ধরনের ভালো লাগায় আবিষ্ট করে, নিদেনপক্ষে হৃদয়ের তন্ত্রীতে ছোট্ট একটা টঙ্কার তোলে। যেই সিডিটি আমি শুনছি, তা থেকে যা জানা যায় তা হলো, রবীন্দ্রনাথের সকণ্ঠে গীত গান অভূতপূর্ব সুন্দর ছিল অথচ আমরা রেকর্ডিংয়ের দোষে রবীন্দ্রনাথের বিকৃত কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সে গুলোর হয় রেকর্ডিং দুর্বল ছিল, না হয় রবীন্দ্রনাথের বেশি বয়সে গীত অথবা পঠিত। রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জবানীতে জানা যায় যে উনি রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গে বলছেন —‘বাবার গলা তখনও নষ্ট হয়নি। অর্থাত্ রবীন্দ্রনাথের গলা একটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। খালি গলায় উচ্চৈঃস্বরে শিলাইদহে পদ্মার বোটে গান গেয়ে ৫০ বছরের পরে তার কণ্ঠে আগের দিপ্তী ছিল না। শুনেছি, জার্মানির মিউনিখে ধারণকৃত রেকর্ডে তার গান ও কবিতা আবৃত্তির কিছুটা হলেও অবিকৃত প্রতিভাস পাওয়া যায়। শিল্পাচার্য অবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্দ্বিধায় বলেছেন যে তার রবিকাকা যখন গান গাইতেন তখন একই কণ্ঠে সহস্র পাখির কল-কাকলি শোনা যেত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা শুনতে পেলেন তার কিশোরপুত্র রবি অনেক গান লিখেছে এবং নিজ কণ্ঠে গেয়ে বেড়ায়। একদিন ডাক পড়ল রবি ও তার পিঠাপিঠি বড় ভাই জ্যোতি ঠাকুরের। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আদেশ করলেন রবিকে গান শোনাতে। জ্যোতি ঠাকুর হারমনিয়াম বাজাতে শুরু করলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একের পর এক গান পিতাকে শোনাতে শুরু করলেন। কোনো কোনো গান তিনি একাধিকবার শুনলেন, তবুও যেন মনের সাধ মেটে না। উনি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, দেশের রাজা যদি বাংলা ভাষা বুঝতেন এবং পাশাপাশি সংগীতপ্রেমিক হতেন তা হলে হয়ত রবিকে অত্যাশ্চর্য কোনো পুরস্কারে ভূষিত করতেন। দেশের রাজা অর্থাত্ ব্রিটিশ সরকার যখন কাজটি করতে অপারগ, তখন মহর্ষিই দেশের রাজার দায়িত্বের বোঝা হাল্কা করার জন্য পকেট থেকে ৫০০ টাকার একটি চেক রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিলেন। আজ থেকে প্রায় ১৩৫ বছর আগে ৫০০ টাকা আজকের ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন গণনায় কত টাকা হবে তা আমার ধারণার বাইরে। একদিন শান্তি নিকেতনের পথে তাকে মত্ত অবস্থায় হাঁঠতে দেখা গেল, বিড়বিড় করে কিছু বলছেন বা গাইছেন। বিশ্বচরাচরের কোনো কিছুর প্রতি তার দৃষ্টি নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসার দিকে ছুটছেন। দীনু ঠাকুরও রবীন্দ্রনাথকে এই উন্মত্ত অবস্থায় দেখে বললেন, রবিদা নিশ্চয় কোনো গান কণ্ঠ নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। পরে জানা গেল, গানের সুরটি পাছে উনি ভুলে যান সে জন্য উনি দীনু ঠাকুরের কণ্ঠে সুরটি তুলে দেবার জন্য পাগলের মতো দৌড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রধান গানের কাণ্ডারি ছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনিই তার কথা ও সুরের প্রধান ধারক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিখ্যাত সংগীত স্রষ্টা অতুলপ্রসাদ সেন গুপ্ত সমসাময়িক ছিলেন। একদিন রাতে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তার সদ্য রচিত ও সুরারোপিত একটি গান শুনে অতুলপ্রসাদ এমনই মুগ্ধ হলেন যে বারবার তাকে একই গান গাইতে অনুরোধ করতে লাগলেন। বারবার শুনেও তার তৃষ্ণা যেন মেটে না। গানটি ছিল—‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর। পুণ্য হলো অঙ্গ মন, ধন্য অন্তর সুন্দর হে সুন্দর।’ এই গানটি আগে থাকতেই আমার শোনা ছিল। জগতের আনন্দ নিকেতনে যেখানেই আমি গিয়েছি, সেখানে এই গানটি মনে পড়েছে। এমনকি গাছের নিচে বসে, হলুদ রংয়ের পাখি দেখে, চিড়িয়াখানায় বাঘ, সিংহ এমনকি ওরাংওটাং দেখে মনে মনে বলেছি, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।’ আমি সমগ্র জাগতিক বিশ্বকে উদ্দেশ করে বলতে চাই—তুমি ভারি সুন্দর, তোমায় সান্নিধ্য আমার জীবনকে ধন্য করেছে। লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments