লন্ডনে টুকরো টুকরো বাংলাদেশ by ফারুক যোশী

এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রতি গ্রীষ্মেই ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করে এক দিনের জন্য হলেও একটি মেলা জমে ওঠে। হাজারো মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাসে ব্রিকলেন হয়ে যায় বাঙালিদের মিলনমেলা। প্রাণের উচ্ছ্বাস আর মিলনমেলাকে সে জন্যই আমরা ইউরোপের সর্ববৃহৎ নটিংহিল কার্নিভালের ছায়া হিসেবে আখ্যায়িত করতে পেরেছি।


কারণ নটিংহিল মেলাটি এমন এক মেলা, যা বলতে গেলে ব্রিটেনের প্রাণকেন্দ্র নটিংহিলে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। আফ্রো-ক্যারিবীয়দের এই মেলাটি তাদের সংস্কৃতির অংশ। এই মেলার মাধ্যমে প্রতিবছর তারা জানিয়ে দেয় তাদের শৃঙ্খলমুক্তির কথা। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে এই ব্রিটেনের অভিবাসী কালো মানুষগুলো ভুগছিল। বর্ণবাদী থাবায় তারা হাঁফিয়ে উঠেছিল। কর্মক্ষেত্রে তারা ছিল অবহেলিত। সুযোগ ছিল না কাজের। আবাসিক সমস্যায় তারা জীবন নির্বাহ করত বলতে গেলে মানবেতর। নাচ-গান তাদের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও এগুলো থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। আর হয়তো এ কারণেই জীবনের এক অনিবার্য তাগিদ তাদের বাইরে নিয়ে আসে। মুক্তাঙ্গনে নাচতে আর গাইতে গাইতেই তারা বেরিয়ে এসেছিল। আর সেই যে বেরিয়ে আসা, ত্রিনিদাদের সেই সংস্কৃতিকে ধারণ করে আজও তারা গেয়ে যায়, জড়ো হয়। যৌবনময় উদ্দাম। ১৯৬৪ থেকে শুরু করে সময়ের পরিক্রমায় এখন বলতে গেলে এটা ব্রিটিশ মাল্টিকালচারাল সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে গেছে। আগস্টের শেষ দুটো দিন তারা কাটায় পৃথিবীর ভিন্ন ভাষাভাষী আর ভিন্ন সংস্কৃতির প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিয়ে এই নটিংহিলে।
এই নটিংহিলের ছায়া-দেখা আমাদের মেলা। এ মেলা ব্রিকলেনে প্রতিবছর বৈশাখের গন্ধ নিয়ে আসে। এ মেলায় আমরা খোঁজ পাই, যেখানে আমাদের শিকড়। এমনকি সেই নটিংহিলের মতো আমরাও মনে করতাম, এ এক বিজয়গাথা আমাদের। বর্ণবাদ আমাদের এই ব্রিটেনে ধুঁকে ধুঁকে জ্বালিয়েছে। শৃঙ্খলমুক্তির প্রয়োজনে এখানে আমাদের পূর্বসূরিদের রক্তে ব্রিটেনের ইতিহাস হয়েছে কালিমালিপ্ত। আমাদের হারাতে হয়েছে আলতাব আলীর মতো তরুণকে। আর কিছু নয়, শুধু জাতি হিসেবে টিকে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় হয়েও জাতি আর নিজস্ব শক্ত অবস্থানকে জানান দিতে আলতাব আলীকে এই ব্রিটেনে দিতে হয়েছে আত্মাহুতি। একটি পরিবারে এই মৃত্যু দিয়ে গেছে বিশাল এক ক্ষত। কিন্তু এই মৃত্যু আমাদের দিয়ে গেছে টিকে থাকার দৃপ্ত শপথ। আমাদের টিকে থাকা সারা পৃথিবীতেই যেন রক্তের সিঁড়ি বেয়ে। আমরা টিকে গেছি। এখন আমাদের এগোনোর পালা। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এগোচ্ছি। এই ব্রিটেনে। বিশ্বাস আর প্রত্যয় নিয়ে তাই তো চেতনার অগি্নমশাল জ্বালিয়ে আমাদের একটি প্রজন্ম জানান দিচ্ছে আমাদের অতীতের কথা, আমাদের ভবিষ্যৎ টিকে থাকার কথা। ওই প্রজন্মের দৃঢ়তায় সময়ে সময়ে ব্রিকলেনের মেলা হয়েছে প্রসারিত। ব্রিকলেন থেকে শুরু করে সমগ্র ইউরোপ, প্রতিটি বছরই মানুষ অপেক্ষায় থাকে একটি দিনের। এই দিনটিকে কেন্দ্র করেই বেড়েছে অনেক কিছু। মাটির গন্ধ নিয়ে এই দিনটিতে বাংলাদেশ থেকে উড়ে আসেন সুরের মূর্ছনা নিয়ে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা। উদ্দাম-উদ্বেল আমাদের এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা বাউলের কণ্ঠে ধরে গান। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
লন্ডনের বৈশাখী মেলায় লক্ষাধিক মানুষ মিলিত হয়। উপলক্ষ_আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক বৈশাখীকে বরণ করে নেওয়া, লক্ষ প্রাণের উচ্ছলতায় একটি দিনকে একান্ত বাঙালির স্বকীয়তার মধ্যে নিয়ে আসা, কিংবা আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের শিকড়ের বন্ধন আরো দৃঢ় করা। প্রতিবছরই এই আয়োজন পহেলা বৈশাখে হয়ে ওঠে না। আবহাওয়া এপ্রিলে ভালো যায় না তাই। গত বছরের আয়োজন চলাকালে কড়কড়ে রোদ্দুর ছিল। লন্ডনের উইভার্স ফিল্ড পার্কের বিশাল আয়োজনে ছিল চোখ ধাঁধানো অবস্থা। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে মানুষের উপস্থিতি। স্থানীয় টিভি চ্যানেল রিপোর্ট করেছিল, এক লাখ ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে। আরো বেশি হতো। প্রচার ভালো হয়নি। পত্রপত্রিকায় কিংবা স্থানীয় টিভি চ্যানেলে যে প্রচার ছিল, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। যেহেতু দেশের মতো নির্ধারিত দিনে (পহেলা বৈশাখ) এ অনুষ্ঠান হয় না, সেহেতু এর প্রচার শুরু হওয়া উচিত অনেক আগে থেকেই। এবার অবশ্য ঘোষণা এসেছে মাসখানেক আগেই। লন্ডনে ৮ মে হচ্ছে বৈশাখী মেলা।
রং-বেরঙের বাঙালি পোশাক পরা নারী-পুরুষ-শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা অংশ নেয় বৈশাখের আমেজমাখা উদ্বোধনী শোভাযাত্রায়। তাদের হাতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যিক ঢোল-বাঁশি, হাতপাখা, কোলা-কলস প্রভৃতি। শোভাযাত্রায় থাকে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির স্মারক। বাঙালির সেই বৈশাখী মেলা এখন পশ্চিমের আকাশে যেন বেগ পেয়েছে। ব্রিটেনের শহরগুলো এখন বৈশাখের জন্য তৈরি হয়। বিশেষ করে যেখানে আছে বাঙালি, সেখানে যেন বৈশাখী এক অনিবার্য নাম। কিশোর-কিশোরী আর নারী-পুরুষের কোলাহলে তাই তো জেগে ওঠে ম্যানচেস্টার। বৈশাখের আয়োজন হয় বার্মিংহামে, ওল্ডহ্যাম কিংবা হাইডের মতো ছোট্ট শহরেও। যদিও এসব আয়োজনে এখনো শোভাযাত্রা করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু জেগে ওঠে শহরগুলো। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে ওই মেলাগুলো। আর তাই তো বাঙালি সংস্কৃতিকে না বোঝা তরুণ-তরুণীটিও যেন বলে দিতে পারে, কেনই বা ওই বৈশাখ কিংবা কী-ই বা বৈশাখী মেলা। ক্রমেই মেলাকে আরো বিস্তৃত আর ব্যাপক করতে পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় কাউন্সিলগুলো থেকে অর্থ অনুদানও নিয়ে আসা হচ্ছে। এভাবেই ব্রিটেনের সংস্কৃতিতে এখন বৈশাখ হয়ে যাচ্ছে যেন আরেকটি নাম। অচিরেই ভিন্ন সংস্কৃতির ব্রিটেনের আরেক অনিবার্য অংশ হয়ে যাবে এই বৈশাখ_এ প্রত্যাশা অমূলক নয়।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী, সাংবাদিক, faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.