প্রসূতির করুণ মৃত্যু-এখনও গেল না আঁধার
শতবর্ষ আগে আলোর পথে যাত্রা শুরু করলেও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা অন্ধকার এখনও কতটা গাঢ়, নোয়াখালীর ফারজানা নূর সুখীর মৃত্যু তার সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। তিনি দেশের উচ্চতম বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, সন্তান জন্ম দিয়ে পালন করতে চেয়েছেন সংসারধর্ম। যে কোনো বিবেচনাতেই তার এ জীবন দেদীপ্যমান।
তারপরও অমানিশাই তাকে গ্রাস করে নিল। ফারজানা নিজেই দেখিয়েছিলেন, সুনাম ও প্রতিষ্ঠা অর্জনে লিঙ্গ পরিচয় এখন আর বাধা নয়। নিয়তির পরিহাস হচ্ছে, কন্যাসন্তান জন্মদানের 'দায়ে' তাকেই জীবন দিতে হলো। সদ্য প্রসূতি সুখীকে জোর করে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও খাবার না দিয়ে তার শ্বশুর পরিবার চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। এই মৃত্যুর দায় তারা এড়াতে পারেন না। সুখীর শাশুড়ি একজন নারী হয়েও যে পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির পরিচয় দিয়েছেন, তা অমার্জনীয়। প্রসূতি সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই-বা কেন ছাড়পত্র দিল খতিয়ে দেখা দরকার। আর্থিক বিবেচনা প্রধান করে দেখার যে দুর্নাম বেসরকারি চিকিৎসালয়গুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে, এ ঘটনা সেটাকে জোরদারই করবে। আমরা আশা করি, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হবে। কিন্তু এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে হলে কেবল আইনি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। কন্যাসন্তানকে স্বাগত জানানোর সর্বজনীন মানসিকতা গড়ে তুলতে হলে এ সংক্রান্ত প্রচার জোরদার করা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ নাগরিককেও। বস্তুত ফারজানার শ্বশুর পরিবার আমাদের সমাজে বিদ্যমান অন্ধকারেরই মূর্ত প্রতীক। এর দায় আমরাও এড়াতে পারি না। যৌতুকের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় আমরা যে সহনশীলতা প্রদর্শন করে এসেছি, কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা তারই চরমতম পরিণতি। আমরা সবাই যদি সাধ্যমতো আলো নিয়ে এগিয়ে আসি, আঁধার কাটবে না কেন?
No comments