সমসময়-অস্থির বিশ্ব, অশান্ত বাংলাদেশ! by আতাউস সামাদ
এই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে নতুন করে রাজনৈতিক জটিলতা আর সৃষ্টি না করা। একতরফা এবং তাড়াহুড়ো করে সংবিধান পরিবর্তন করে মহাজোট সরকার খুব ভুল কাজ করেছে। এটা শোধরাতে হবে। আর বিরোধী দলের ওপর জেল-জুলুম বন্ধ করতে হবে।
এসব দেশকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে দাগি সন্ত্রাসীরা না সমাজের ওপর তাদের 'রাজ' পুরোপুরি কায়েম করে বসে
সমস্যা আর সংঘাত ইদানীং বারবার দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও। কোনো কোনো সমস্যা নানা ধরনের কষ্ট সৃষ্টি করে সারা পৃথিবীতে। আবার একই সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশে যেসব সংঘাত, বিদ্রোহ ও সংঘর্ষ চলে আসছিল তার কয়েকটির তীব্রতা বেড়ে গিয়ে অনেক মানুষকে নতুন করে বাস্তুচ্যুত করেছে, খাদ্যাভাবে পতিত করেছে, পরিবারের সদস্যদের একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, নারীদের সতত ইজ্জতহানির ভয়ের মধ্যে রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার যেসব আরব দেশে স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো জনগণকে দাবিয়ে রাখতে চাইছে সেসবখানে সরকারি বাহিনীর গুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছে প্রতিদিন। বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধমক বা কোনো কোনো দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপও চটজলদি সমাধান দিতে পারছে না।
আলাদা আলাদাভাবে দেখলে এসব যুদ্ধবিগ্রহ, বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভ স্থানীয় সমস্যা বলে মনে হতে পারে; কিন্তু সংঘাতগুলো যত লোকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যত মানুষকে সরাসরি বিপদে ফেলেছে তা হিসাব করলে সংখ্যাটা বিশাল হয়ে যায়। এসব যুদ্ধবিগ্রহের ভৌগোলিক ব্যাপ্তিও ছোট নয়। বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন ১২-১৪টি দেশেই তো বর্তমানে যুদ্ধ, বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসী হামলা চলছে। সন্ত্রাসকবলিত দেশ হিসেবে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান দুটিকেই চিহ্নিত করা যায়। পাকিস্তানে চলছে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও সে দেশের সামরিক বাহিনীগুলোর গোপন সংস্থাদের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব। ভারতে আছে মাওবাদী বাহিনী এবং কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর স্বাধীনতাকামী গেরিলারা। আর আফগানিস্তানে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দখলদার ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের লড়াই। এই দুই শক্তির মধ্যে পড়ে আফগানিস্তানে আর যেসব স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা ছিল তারা প্রায় বিলুপ্ত। তাদের ধ্বংসা করতে ওসামা বিন লাদেন ও তার আল কায়দার গুপ্ত ঘাতকরাও বড় ভূমিকা রেখেছিল। ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কথা বাংলাদেশকে মনে রাখতেই হবে এ জন্য যে, ওইসব দেশের অশান্তি এ দেশের গায়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলে। যেমন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতার সময় যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়, আদালতের কাছে পুলিশের রুজু করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে যে, তাতে ব্যবহার করা গ্রেনেডগুলো বাংলাদেশি একটি ইসলামী উগ্রবাদী দলকে দিয়েছিল পাকিস্তানে আশ্রয়প্রাপ্ত ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের মুক্তিকামী একটি উগ্রপন্থি গোষ্ঠী। আসামের বিদ্রোহী উলফা সদস্যদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের সমরাস্ত্র চালান দিতে সহায়তা করার অভিযোগ তুলে ভারত সরকার বাংলাদেশের সাবেক জোট সরকারের ওপর মহাখাপ্পা ছিল_ আর তা এতই যে সেই সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নয়াদিলি্লর সরকার জানিয়েই দিয়েছিল যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী (সেই সময়ে ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি) তাকে সাক্ষাৎকার দেবেন না। এখন যে ভারতের কংগ্রেসী শাসকদের মিত্র আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে আছে তাতেও কি রেহাই আছে। যথা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই সেদিন বললেন যে, বাংলাদেশে বহু ভারতবিদ্বেষী আছে, তাদের ওপর পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রভাব আছে এবং তারা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক (এই জামায়াতে ইসলামী, সবাই জানেন, ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধী)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার প্রতি তার সন্দেহের কথা প্রকাশ করার কয়েকদিন পর বন্দরনগরী, ব্যবসা কেন্দ্র ও ভারতীয় সিনে সেলিব্রিটিদের শহর মুম্বাইয়ে এক সঙ্গে তিন জায়গায় বোমা ফাটল। তার দিনকয়েক পরই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ভারত সফরে এলেন এবং সেখানে বললেন যে, পাকিস্তান এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দারা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের সেনা প্রশিক্ষণের শহর এবোটাবাদে আবিষ্কার করা ও তারপর মার্কিনি মেরিন বাহিনীর বিশেষ দল গোপন অভিযান চালিয়ে সেখানে তাকে হত্যা করার পর থেকে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ সরকার দুটির মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে। এতে শঙ্কিত হয়ে মার্কিনিরা ভারতকে তাদের আলিঙ্গনে এখনকার চেয়ে গভীরভাবে বাঁধতে চাইছে। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভাষায় এখন তিব্বতকে চীনের হাত থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনে নেপালে তাদের সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এ জন্য তাদের অবশ্যই ভারত সরকারের সমর্থন দরকার। এ রকম কিছু হলে নেপালের মাওবাদীরা ও চীন কি বসে থাকবে? এখানেও বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এখান থেকে (যে ক'জন) উলফা নেতাকে তাড়িয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছিল তারা ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও উলফার সামরিক শাখার নেতা পরেশ বড়ূয়া ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। শোনা যায়, তিনি চীন ও মিয়ানমারে যাওয়া-আসা করছেন। তিনি উলফার সশস্ত্র গেরিলাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওই সশস্ত্র গেরিলাদের অস্তিত্ব যে বিলীন হয়ে যায়নি সম্প্রতি তার দুটি প্রমাণ মিলেছে। এর প্রথমটি হলো, আসামে আবার বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর দ্বিতীয়টি হলো, ভারতের আসাম প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গগৈ তার দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের সঙ্গে সম্প্রতি দিলি্লতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উলফার সঙ্গে শান্তি আলোচনার সময় ওই সংগঠনের গেরিলারা নিরাপদে থাকতে পারে এ রকম বিশেষভাবে চিহ্নিত এলাকা (উবংরমহধঃবফ ধৎবধ) প্রতিষ্ঠা করা যায় চীন সেই প্রশ্নটি আলোচনা করেছে। এ খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে। তাহলে বলা যায়, আত্মসমর্পণ করেনি এমন বেশ কিছু উলফা গেরিলা সক্রিয় আছে বলেই তো তাদের চিহ্নিত বিশেষ এলাকায় শিবির করে থাকার সুবিধা দেওয়ার কথা উঠেছে। কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে, আসাম এবং ভারতের অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে যেসব বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল তার বেশ কিছু এখনও ধিকিধিকি করে জ্বলছে।
একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে নতুন বিপদ। চীন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলার দরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে দমিয়ে রাখতে চাইছে। আর তা তারা চাইবেই। কারণ, চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তার অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরই। প্রযুক্তির দিক থেকে চীন এতটাই এগিয়েছে যে, তারা মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান বানাতে পারে। মার্কিনিদের জন্য এসবই দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই তারা যেমন চাইছে নেপালে ঢুকতে, তেমনি চাইছে ভারত যেন তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। দরকার পড়লে তারাও সেখানে যাবে।
এই ভারত-মার্কিন অক্ষশক্তি বনাম চীন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই মুহূর্তে তার প্রথমটি হলো, বাংলাদেশ যে ভারতকে ট্রানজিট/করিডোর সুবিধা দিতে ব্যগ্র তা বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিরোধপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে দেওয়া কি ঠিক হবে? আমরা কি অযথাই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর জনগণকে এবং চীনকে আমাদের শত্রুতে পরিণত করতে যাচ্ছি না? সবচেয়ে বড় কথা, ভারত কি এই ট্রানজিট/করিডোর সুবিধা সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য ব্যবহার করবে না? তা যে করবে না সেই নিশ্চয়তা কোথায় এবং তা পাব কীভাবে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তখন ইওওঝ (বিস)-এ এক আলোচনায় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে ভারত কি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমরাস্ত্র আনা-নেওয়া করবে? উত্তরে তিনি বলেননি যে, ভারত তা করবে না। তিনি বরঞ্চ বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম নেওয়ার প্রয়োজন হবে না তার দেশের। কারণ ভারত-চীন সীমান্তে এখন গুলি চলে না, সেখানে শান্তি বিরাজ করছে। এ ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন হলো, যখন ভারত-চীন সীমান্তে শান্তি থাকবে না বা তা যদি না থাকে তখন কী হবে? তখন যদি ভারত সমরাস্ত্র বহন করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে? অথবা ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য ভারত যদি সামরিক সরঞ্জাম নেয় ভারতের মধ্য দিয়ে? তাহলে তো বাংলাদেশ চীন অথবা ভারতীয় বিদ্রোহীদের শত্রু বলে গণ্য হবে এবং তখন তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে! আর এখন ট্রানজিট চুক্তিতে সমরাস্ত্র চালান নিষেধ থাকলেও নয়াদিলি্ল সরকারের প্রয়োজনে যদি তারা 'বিশেষ সুবিধা' দাবি করে ট্রানজিটকে তাদের সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করে, বাংলাদেশ কি তাতে বাধা দিতে পারবে তখন? আরেকটা বড় বিবেচ্য বিষয় হলো, ভারতের আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতির ওপর কি আস্থা রাখা যায়। যেমন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গত পরশু (মঙ্গলবার) আবার একজন বাংলাদেশিকে খুন করেছে। অথচ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা তো ঢাকায় বলেছিলেন, বিএসএফকে এ রকম হত্যা করতে মানা করা হবে। তার প্রতিশ্রুতি তো তিনি দিলি্ল প্রত্যাবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে গেছে! কাজেই ভারতকে বা মার্কিনিদের কোনো কৌশলগত (ংঃৎধঃবমরপ) সুবিধা দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে পঞ্চাশবার ভাবতে হবে, এর ফলে আমরা চীনের মতো অন্য কোনো বন্ধুকে বা আমাদের অপর প্রতিবেশী মিয়ানমারকে শত্রু বানাচ্ছি কি-না। এসব কথা অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ এখন আর নেই।
শিরোনামে বলছিলাম, 'বিশ্ব অশান্ত, অস্থির বাংলাদেশ।' মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ অশান্ত হওয়ায় সেসব দেশে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশিকে যে প্রাণ হাতে করে চলে আসতে হয়েছে তা তো আমরা দেখেছি। এসব দেশে সংঘাত চলতে থাকলে এরা তো আগের কাজে ফেরত যেতে পারবেন না বটেই, বিদেশে নতুন কর্মসংস্থান করাও কঠিন হয়ে পড়বে। যুদ্ধকবলিত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যও কমে যাবে। থাকবে না অর্থনৈতিক সহযোগিতা। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের নাজুক অর্থনীতির জন্য বাড়বে সামাজিক অবক্ষয়।
এদিকে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নতুন করে বা পরপর দ্বিতীয় দফায় শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। সেসব দেশে ব্যাংক ফেল করছে। বড় বড় কোম্পানি হাজার হাজার কর্মচারী ছাঁটাই করছে। শেয়ারবাজারে মূল্যপতন ঘটছে। নানা সরকার ঋণ শোধ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামও পড়ে যাচ্ছে। এসবের ফলে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে ভাটার টান লেগেছে। এখানেও কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে। এই সঙ্গে বিদেশে শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের মধ্য যদি বাংলাদেশিরা পড়ে যায়, তাহলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশি বেকারের সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্যের অবস্থা টালমাটাল থাকলে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্য পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলে জনগণের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগের অন্ত নেই। এই নাজুক পরিস্থিতির কয়েকটি লক্ষণের একটি হলো, সারাবিশ্বে যখন মার্কিন ডলারের দাম কমছে, তখন আমাদের দেশে তার দাম বাড়ছে। আরেকটি লক্ষণ হলো, নতুন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। চিনির দাম আগের উচ্চমূল্যের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ভোজ্যতেলেরও দাম বেড়েছে। দাম বাড়ছে কাপড়চোপড়ের। এসব মূল্যবৃদ্ধির অনেকখানি ঘটেছে বিরোধী দলগুলোর হরতাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর।
এই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে নতুন করে রাজনৈতিক জটিলতা আর সৃষ্টি না করা। একতরফা এবং তাড়াহুড়ো করে সংবিধান পরিবর্তন করে মহাজোট সরকার খুব ভুল কাজ করেছে। এটা শোধরাতে হবে। আর বিরোধী দলের ওপর জেল-জুলুম বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে দলীয় দাগি অপরাধীদের মাপ করে দিয়ে সরকার যে খারাপ নজির সৃষ্টি করছে তারও অবসান দরকার। এসব দেশকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে দাগি সন্ত্রাসীরা না সমাজের ওপর তাদের 'রাজ' পুরোপুরি কায়েম করে বসে।
আতাউস সামাদ :সাংবাদিক ও
কলাম লেখক
সমস্যা আর সংঘাত ইদানীং বারবার দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও। কোনো কোনো সমস্যা নানা ধরনের কষ্ট সৃষ্টি করে সারা পৃথিবীতে। আবার একই সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশে যেসব সংঘাত, বিদ্রোহ ও সংঘর্ষ চলে আসছিল তার কয়েকটির তীব্রতা বেড়ে গিয়ে অনেক মানুষকে নতুন করে বাস্তুচ্যুত করেছে, খাদ্যাভাবে পতিত করেছে, পরিবারের সদস্যদের একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, নারীদের সতত ইজ্জতহানির ভয়ের মধ্যে রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার যেসব আরব দেশে স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো জনগণকে দাবিয়ে রাখতে চাইছে সেসবখানে সরকারি বাহিনীর গুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছে প্রতিদিন। বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধমক বা কোনো কোনো দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপও চটজলদি সমাধান দিতে পারছে না।
আলাদা আলাদাভাবে দেখলে এসব যুদ্ধবিগ্রহ, বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভ স্থানীয় সমস্যা বলে মনে হতে পারে; কিন্তু সংঘাতগুলো যত লোকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যত মানুষকে সরাসরি বিপদে ফেলেছে তা হিসাব করলে সংখ্যাটা বিশাল হয়ে যায়। এসব যুদ্ধবিগ্রহের ভৌগোলিক ব্যাপ্তিও ছোট নয়। বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন ১২-১৪টি দেশেই তো বর্তমানে যুদ্ধ, বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসী হামলা চলছে। সন্ত্রাসকবলিত দেশ হিসেবে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান দুটিকেই চিহ্নিত করা যায়। পাকিস্তানে চলছে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও সে দেশের সামরিক বাহিনীগুলোর গোপন সংস্থাদের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব। ভারতে আছে মাওবাদী বাহিনী এবং কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর স্বাধীনতাকামী গেরিলারা। আর আফগানিস্তানে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দখলদার ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের লড়াই। এই দুই শক্তির মধ্যে পড়ে আফগানিস্তানে আর যেসব স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা ছিল তারা প্রায় বিলুপ্ত। তাদের ধ্বংসা করতে ওসামা বিন লাদেন ও তার আল কায়দার গুপ্ত ঘাতকরাও বড় ভূমিকা রেখেছিল। ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কথা বাংলাদেশকে মনে রাখতেই হবে এ জন্য যে, ওইসব দেশের অশান্তি এ দেশের গায়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলে। যেমন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতার সময় যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়, আদালতের কাছে পুলিশের রুজু করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে যে, তাতে ব্যবহার করা গ্রেনেডগুলো বাংলাদেশি একটি ইসলামী উগ্রবাদী দলকে দিয়েছিল পাকিস্তানে আশ্রয়প্রাপ্ত ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের মুক্তিকামী একটি উগ্রপন্থি গোষ্ঠী। আসামের বিদ্রোহী উলফা সদস্যদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের সমরাস্ত্র চালান দিতে সহায়তা করার অভিযোগ তুলে ভারত সরকার বাংলাদেশের সাবেক জোট সরকারের ওপর মহাখাপ্পা ছিল_ আর তা এতই যে সেই সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নয়াদিলি্লর সরকার জানিয়েই দিয়েছিল যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী (সেই সময়ে ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি) তাকে সাক্ষাৎকার দেবেন না। এখন যে ভারতের কংগ্রেসী শাসকদের মিত্র আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে আছে তাতেও কি রেহাই আছে। যথা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই সেদিন বললেন যে, বাংলাদেশে বহু ভারতবিদ্বেষী আছে, তাদের ওপর পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রভাব আছে এবং তারা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক (এই জামায়াতে ইসলামী, সবাই জানেন, ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধী)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার প্রতি তার সন্দেহের কথা প্রকাশ করার কয়েকদিন পর বন্দরনগরী, ব্যবসা কেন্দ্র ও ভারতীয় সিনে সেলিব্রিটিদের শহর মুম্বাইয়ে এক সঙ্গে তিন জায়গায় বোমা ফাটল। তার দিনকয়েক পরই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ভারত সফরে এলেন এবং সেখানে বললেন যে, পাকিস্তান এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দারা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের সেনা প্রশিক্ষণের শহর এবোটাবাদে আবিষ্কার করা ও তারপর মার্কিনি মেরিন বাহিনীর বিশেষ দল গোপন অভিযান চালিয়ে সেখানে তাকে হত্যা করার পর থেকে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ সরকার দুটির মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে। এতে শঙ্কিত হয়ে মার্কিনিরা ভারতকে তাদের আলিঙ্গনে এখনকার চেয়ে গভীরভাবে বাঁধতে চাইছে। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভাষায় এখন তিব্বতকে চীনের হাত থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনে নেপালে তাদের সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এ জন্য তাদের অবশ্যই ভারত সরকারের সমর্থন দরকার। এ রকম কিছু হলে নেপালের মাওবাদীরা ও চীন কি বসে থাকবে? এখানেও বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এখান থেকে (যে ক'জন) উলফা নেতাকে তাড়িয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছিল তারা ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও উলফার সামরিক শাখার নেতা পরেশ বড়ূয়া ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। শোনা যায়, তিনি চীন ও মিয়ানমারে যাওয়া-আসা করছেন। তিনি উলফার সশস্ত্র গেরিলাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওই সশস্ত্র গেরিলাদের অস্তিত্ব যে বিলীন হয়ে যায়নি সম্প্রতি তার দুটি প্রমাণ মিলেছে। এর প্রথমটি হলো, আসামে আবার বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর দ্বিতীয়টি হলো, ভারতের আসাম প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গগৈ তার দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের সঙ্গে সম্প্রতি দিলি্লতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উলফার সঙ্গে শান্তি আলোচনার সময় ওই সংগঠনের গেরিলারা নিরাপদে থাকতে পারে এ রকম বিশেষভাবে চিহ্নিত এলাকা (উবংরমহধঃবফ ধৎবধ) প্রতিষ্ঠা করা যায় চীন সেই প্রশ্নটি আলোচনা করেছে। এ খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে। তাহলে বলা যায়, আত্মসমর্পণ করেনি এমন বেশ কিছু উলফা গেরিলা সক্রিয় আছে বলেই তো তাদের চিহ্নিত বিশেষ এলাকায় শিবির করে থাকার সুবিধা দেওয়ার কথা উঠেছে। কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে, আসাম এবং ভারতের অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে যেসব বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল তার বেশ কিছু এখনও ধিকিধিকি করে জ্বলছে।
একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে নতুন বিপদ। চীন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলার দরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে দমিয়ে রাখতে চাইছে। আর তা তারা চাইবেই। কারণ, চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তার অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরই। প্রযুক্তির দিক থেকে চীন এতটাই এগিয়েছে যে, তারা মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান বানাতে পারে। মার্কিনিদের জন্য এসবই দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই তারা যেমন চাইছে নেপালে ঢুকতে, তেমনি চাইছে ভারত যেন তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। দরকার পড়লে তারাও সেখানে যাবে।
এই ভারত-মার্কিন অক্ষশক্তি বনাম চীন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই মুহূর্তে তার প্রথমটি হলো, বাংলাদেশ যে ভারতকে ট্রানজিট/করিডোর সুবিধা দিতে ব্যগ্র তা বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিরোধপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে দেওয়া কি ঠিক হবে? আমরা কি অযথাই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর জনগণকে এবং চীনকে আমাদের শত্রুতে পরিণত করতে যাচ্ছি না? সবচেয়ে বড় কথা, ভারত কি এই ট্রানজিট/করিডোর সুবিধা সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য ব্যবহার করবে না? তা যে করবে না সেই নিশ্চয়তা কোথায় এবং তা পাব কীভাবে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তখন ইওওঝ (বিস)-এ এক আলোচনায় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে ভারত কি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমরাস্ত্র আনা-নেওয়া করবে? উত্তরে তিনি বলেননি যে, ভারত তা করবে না। তিনি বরঞ্চ বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম নেওয়ার প্রয়োজন হবে না তার দেশের। কারণ ভারত-চীন সীমান্তে এখন গুলি চলে না, সেখানে শান্তি বিরাজ করছে। এ ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন হলো, যখন ভারত-চীন সীমান্তে শান্তি থাকবে না বা তা যদি না থাকে তখন কী হবে? তখন যদি ভারত সমরাস্ত্র বহন করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে? অথবা ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য ভারত যদি সামরিক সরঞ্জাম নেয় ভারতের মধ্য দিয়ে? তাহলে তো বাংলাদেশ চীন অথবা ভারতীয় বিদ্রোহীদের শত্রু বলে গণ্য হবে এবং তখন তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে! আর এখন ট্রানজিট চুক্তিতে সমরাস্ত্র চালান নিষেধ থাকলেও নয়াদিলি্ল সরকারের প্রয়োজনে যদি তারা 'বিশেষ সুবিধা' দাবি করে ট্রানজিটকে তাদের সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করে, বাংলাদেশ কি তাতে বাধা দিতে পারবে তখন? আরেকটা বড় বিবেচ্য বিষয় হলো, ভারতের আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতির ওপর কি আস্থা রাখা যায়। যেমন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গত পরশু (মঙ্গলবার) আবার একজন বাংলাদেশিকে খুন করেছে। অথচ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা তো ঢাকায় বলেছিলেন, বিএসএফকে এ রকম হত্যা করতে মানা করা হবে। তার প্রতিশ্রুতি তো তিনি দিলি্ল প্রত্যাবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে গেছে! কাজেই ভারতকে বা মার্কিনিদের কোনো কৌশলগত (ংঃৎধঃবমরপ) সুবিধা দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে পঞ্চাশবার ভাবতে হবে, এর ফলে আমরা চীনের মতো অন্য কোনো বন্ধুকে বা আমাদের অপর প্রতিবেশী মিয়ানমারকে শত্রু বানাচ্ছি কি-না। এসব কথা অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ এখন আর নেই।
শিরোনামে বলছিলাম, 'বিশ্ব অশান্ত, অস্থির বাংলাদেশ।' মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ অশান্ত হওয়ায় সেসব দেশে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশিকে যে প্রাণ হাতে করে চলে আসতে হয়েছে তা তো আমরা দেখেছি। এসব দেশে সংঘাত চলতে থাকলে এরা তো আগের কাজে ফেরত যেতে পারবেন না বটেই, বিদেশে নতুন কর্মসংস্থান করাও কঠিন হয়ে পড়বে। যুদ্ধকবলিত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যও কমে যাবে। থাকবে না অর্থনৈতিক সহযোগিতা। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের নাজুক অর্থনীতির জন্য বাড়বে সামাজিক অবক্ষয়।
এদিকে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নতুন করে বা পরপর দ্বিতীয় দফায় শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। সেসব দেশে ব্যাংক ফেল করছে। বড় বড় কোম্পানি হাজার হাজার কর্মচারী ছাঁটাই করছে। শেয়ারবাজারে মূল্যপতন ঘটছে। নানা সরকার ঋণ শোধ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামও পড়ে যাচ্ছে। এসবের ফলে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে ভাটার টান লেগেছে। এখানেও কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে। এই সঙ্গে বিদেশে শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের মধ্য যদি বাংলাদেশিরা পড়ে যায়, তাহলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশি বেকারের সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্যের অবস্থা টালমাটাল থাকলে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্য পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলে জনগণের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগের অন্ত নেই। এই নাজুক পরিস্থিতির কয়েকটি লক্ষণের একটি হলো, সারাবিশ্বে যখন মার্কিন ডলারের দাম কমছে, তখন আমাদের দেশে তার দাম বাড়ছে। আরেকটি লক্ষণ হলো, নতুন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। চিনির দাম আগের উচ্চমূল্যের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ভোজ্যতেলেরও দাম বেড়েছে। দাম বাড়ছে কাপড়চোপড়ের। এসব মূল্যবৃদ্ধির অনেকখানি ঘটেছে বিরোধী দলগুলোর হরতাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর।
এই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে নতুন করে রাজনৈতিক জটিলতা আর সৃষ্টি না করা। একতরফা এবং তাড়াহুড়ো করে সংবিধান পরিবর্তন করে মহাজোট সরকার খুব ভুল কাজ করেছে। এটা শোধরাতে হবে। আর বিরোধী দলের ওপর জেল-জুলুম বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে দলীয় দাগি অপরাধীদের মাপ করে দিয়ে সরকার যে খারাপ নজির সৃষ্টি করছে তারও অবসান দরকার। এসব দেশকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে দাগি সন্ত্রাসীরা না সমাজের ওপর তাদের 'রাজ' পুরোপুরি কায়েম করে বসে।
আতাউস সামাদ :সাংবাদিক ও
কলাম লেখক
No comments