স্মরণ-বজলুর রহমান: পান্থজনের সখা by মুহম্মদ সবুর
তাঁর কাছে এলে পাওয়া যেত বৃক্ষের ছায়া, পুষ্পের ছোঁয়া, অপত্যস্নেহমাখা হাসির ঝিলিকে প্রাণ হতো চঞ্চল, কথার জাদুমালা নিবিষ্ট শ্রোতায় পরিণত করত, জীবনের নানা বিষয়ে পাওয়া যেত সুপরামর্শ, বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে পাড়ি দেওয়া যেত সাঁকো কিংবা মিলত অভিভাবকত্বের সসীম স্নেহাবিষ্ট মুখ। তিনি ছিলেন আত্মার আত্মীয়। আলোকের ঝরনাধারায় ধুইয়ে দিতে চাইতেন সব অন্ধকার, কুসংস্কার আর অজ্ঞতা।
সুদর্শন, সুশোভন বজলুর রহমানকে যতবারই দেখেছি, ততবারই নতুন করে প্রাণ পেয়েছি। স্বপ্ন দেখার সিঁড়ি শুধু খোঁজা নয়, তা সত্যি করার নিরলস প্রয়াস রেখেছেন সান্নিধ্যজনের জন্যও। তাঁর সান্নিধ্য জ্ঞানের পরিধি বাড়াত। শিশুদের জন্য সংগঠনও গড়েছেন তিনি যৌবনের উষ্ণীষ উড়িয়ে। রাজনীতিতেও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকা বের করেছেন। সংগঠন করেছেন শান্তির জন্য। আড্ডা বা আলোচনায় নানা বিষয় এসে জড়ো হতো। বিশ্বপাঠশালার ছাত্রের মতো কত অজানাকে যে তুলে ধরতেন, কত অচেনাকে চেনাতেন, অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানা ঘটনার সারি। শিক্ষকসুলভতায় নয়, বন্ধুবৎসলতায় রেখেছেন নৈকট্যে; উদ্দীপ্ত করেছেন সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন হতে।
বয়স কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলেই সান্নিধ্যে, নৈকট্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ বা জড়তা এসে ধরা দিত না। বন্ধুর মতো, স্বজনের মতো দ্রবীভূত করে দিতেন তরুণ, অতি তরুণকেও। তারুণ্যের আবেগকে কখনো দমাতে চাননি, বরং তাদের সান্নিধ্য পেতে কখনো বেগ পেতে হতো না। ব্যক্তিজীবনের সমস্যা অকপটে বলা যেত, মিলে যেত সমাধানও। সব বর্ণ-ধর্ম-মত ও পেশার মানুষের সঙ্গেই মিশেছেন অবলীলায়। মুক্তবুদ্ধির মানুষ বলেই মানুষ তাঁর কাছে পেত মর্যাদা। কর্মের মধ্যে যে মানুষের মুক্তি নিহিত আছে, সেই উপলব্ধিটুকুও তাঁরই সহজাত।
নির্ভীক সাংবাদিক বজলুর রহমান, আমাদের প্রাণাধিক বজলু ভাই, অমরত্বের সাধনা করেননি। তাঁর অনুপস্থিতি বড় বেশি বেদনার, বিষাদের। এমনই মানুষ তিনি, যাঁর সান্নিধ্য কখনো পরিণত হয়নি অভিমান, ভারবাহী কিংবা বিষাদে। বরং ব্যস্ত মানবের সান্নিধ্যের সময়টুকু কেড়ে নেওয়াও কম দুষ্কর ছিল না। তাঁর সান্নিধ্য, নৈকট্য এক গৌরবময় অধ্যায়, জীবনের পরমতম প্রাপ্তি। অভিভূত করে রেখেছিলেন, যত দিন কাছে ও দূরে ছিলাম।
এক আদর্শবান, নির্লোভ, নির্মোহ ও নিরহংকার মানব ছিলেন বজলুর রহমান। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশের প্রথম কবিতার কবি প্রয়াত মাহবুব উল আলম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বজলুর রহমান নিজে একজন দক্ষ সংগঠক হওয়ার কারণে খেলাঘরকে প্রগতিশীল ধারায় নির্মাণ করেছেন। এই খেলাঘর বহুদিন যাবৎ নানা কর্মকাণ্ড, অনুষ্ঠান, আন্দোলন, মিছিলের মাধ্যমে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক নাগরিকের জন্ম দিয়েছে। বজলুর রহমান অত্যন্ত প্রগতিশীল দৃষ্টির অধিকারী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো স্বদেশ এবং দুনিয়াকে দেখেন।’
আমাদের বজলু ভাই, সংবাদপত্রে যিনি নিজেও কাজ করেছেন অনেক বড় মাপের মানুষ আহমদুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, শহীদ সাবের, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, তোয়াব খান, মতিউর রহমানসহ আরও অনেকের সঙ্গে। রাজনীতিতেও পেয়েছিলেন ত্যাগী মানুষদের সংস্পর্শ।
বাঙালির জীবনযাপনের যে আবহ, বজলুর রহমান তাতেও ছিলেন একনিষ্ঠ। অতি নাগরিকতা তাঁকে টানেনি বলেই চিরায়ত বাংলার রূপটুকু ধরে রাখতে চেয়েছেন সব সময়। গ্রামীণ জীবন, সমাজ ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের তীব্রতা ধরা পড়ত তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায়। সব মতামতকেই গুরুত্ব দিতেন। নিজস্ব মতামত কখনো চাপিয়ে দিতেন না। তবে তাঁর যুক্তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াত যে তাঁর মতামতটিই হতো সঠিক। আধুনিক, রুচিমান ও বিশুদ্ধ মানবের প্রতিকৃতি মিলত তাঁরই মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের চৌকস ও মেধাবী ছাত্রটি সাহসে ভর করে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন। প্রায় অর্ধশত বছরে নিজেই পরিণত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানে। নিষ্ঠা তাঁকে শিখরে পৌঁছিয়েছে। নানা বিষয়ে আগ্রহ, দূরদর্শিতা এসবই অনুপ্রাণিত করত সান্নিধ্যজনকে। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, মানবকল্যাণ ধারণ করে সম্পন্ন মানবে পরিণত বজলুর রহমান যে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে গেছেন, তাঁর অবর্তমানে তা প্রজ্বালিত রাখার দুরূহ দায়িত্ব অবলীলায় বর্তে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
কী চেয়েছিলেন বজলুর রহমান? কী স্বপ্ন তাঁর ফুল হয়ে ফুটত, সবই উঠে আসত লেখায়। ক্ষুরধার লেখাগুলো চিন্তার খোরাক শুধু নয়, দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের চেয়ারকেও নাড়িয়ে দিত। সাংবাদিকতায় নিয়মনীতি যতটা সম্ভব রক্ষা করে কাজ করেছেন সামরিক-বেসামরিক আমলে। লেখার কোনো কোনো অংশ নিয়ে প্রশ্ন করে আমার কাছে মতামতও জানতে চাইতেন। ভ্রমণকালে সফরসঙ্গী হিসেবে দেখেছি মোহমুগ্ধতায় তাঁকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে।
অকুতোভয় বজলুর রহমান অপত্যস্নেহ আর ভালোবাসায় সিক্ত করে গেছেন স্বজন, অনুরাগী ও গুণমুগ্ধদের। ফুলের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র টান। দেশ-বিদেশে ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে দেখেছি, যেখানেই যেতেন সেখানকার গাছপালা, ফুল-ফসল সম্পর্কে খোঁজ নিতেন। ‘পুষ্প বনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে’। আধুনিকতায় এবং বাঙালিয়ানায় সমৃদ্ধ মানুষটি আমাদের অন্তরাত্মায় গভীরভাবে ঠাঁই করে নিয়েছেন। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও আমাদের নিত্যদিনের জীবনে পাথেয় হয়েই থাকবেন।
সীমার মাঝে অসীম হয়ে বজলুর রহমান বেঁচে থাকবেন তাঁর শ্রম ও কর্মের ফসলে। আগামী দিনগুলোয় আরও বেশি অনুভূত হবে শূন্যতা।
বয়স কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলেই সান্নিধ্যে, নৈকট্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ বা জড়তা এসে ধরা দিত না। বন্ধুর মতো, স্বজনের মতো দ্রবীভূত করে দিতেন তরুণ, অতি তরুণকেও। তারুণ্যের আবেগকে কখনো দমাতে চাননি, বরং তাদের সান্নিধ্য পেতে কখনো বেগ পেতে হতো না। ব্যক্তিজীবনের সমস্যা অকপটে বলা যেত, মিলে যেত সমাধানও। সব বর্ণ-ধর্ম-মত ও পেশার মানুষের সঙ্গেই মিশেছেন অবলীলায়। মুক্তবুদ্ধির মানুষ বলেই মানুষ তাঁর কাছে পেত মর্যাদা। কর্মের মধ্যে যে মানুষের মুক্তি নিহিত আছে, সেই উপলব্ধিটুকুও তাঁরই সহজাত।
নির্ভীক সাংবাদিক বজলুর রহমান, আমাদের প্রাণাধিক বজলু ভাই, অমরত্বের সাধনা করেননি। তাঁর অনুপস্থিতি বড় বেশি বেদনার, বিষাদের। এমনই মানুষ তিনি, যাঁর সান্নিধ্য কখনো পরিণত হয়নি অভিমান, ভারবাহী কিংবা বিষাদে। বরং ব্যস্ত মানবের সান্নিধ্যের সময়টুকু কেড়ে নেওয়াও কম দুষ্কর ছিল না। তাঁর সান্নিধ্য, নৈকট্য এক গৌরবময় অধ্যায়, জীবনের পরমতম প্রাপ্তি। অভিভূত করে রেখেছিলেন, যত দিন কাছে ও দূরে ছিলাম।
এক আদর্শবান, নির্লোভ, নির্মোহ ও নিরহংকার মানব ছিলেন বজলুর রহমান। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশের প্রথম কবিতার কবি প্রয়াত মাহবুব উল আলম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বজলুর রহমান নিজে একজন দক্ষ সংগঠক হওয়ার কারণে খেলাঘরকে প্রগতিশীল ধারায় নির্মাণ করেছেন। এই খেলাঘর বহুদিন যাবৎ নানা কর্মকাণ্ড, অনুষ্ঠান, আন্দোলন, মিছিলের মাধ্যমে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক নাগরিকের জন্ম দিয়েছে। বজলুর রহমান অত্যন্ত প্রগতিশীল দৃষ্টির অধিকারী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো স্বদেশ এবং দুনিয়াকে দেখেন।’
আমাদের বজলু ভাই, সংবাদপত্রে যিনি নিজেও কাজ করেছেন অনেক বড় মাপের মানুষ আহমদুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, শহীদ সাবের, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, তোয়াব খান, মতিউর রহমানসহ আরও অনেকের সঙ্গে। রাজনীতিতেও পেয়েছিলেন ত্যাগী মানুষদের সংস্পর্শ।
বাঙালির জীবনযাপনের যে আবহ, বজলুর রহমান তাতেও ছিলেন একনিষ্ঠ। অতি নাগরিকতা তাঁকে টানেনি বলেই চিরায়ত বাংলার রূপটুকু ধরে রাখতে চেয়েছেন সব সময়। গ্রামীণ জীবন, সমাজ ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের তীব্রতা ধরা পড়ত তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায়। সব মতামতকেই গুরুত্ব দিতেন। নিজস্ব মতামত কখনো চাপিয়ে দিতেন না। তবে তাঁর যুক্তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াত যে তাঁর মতামতটিই হতো সঠিক। আধুনিক, রুচিমান ও বিশুদ্ধ মানবের প্রতিকৃতি মিলত তাঁরই মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের চৌকস ও মেধাবী ছাত্রটি সাহসে ভর করে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন। প্রায় অর্ধশত বছরে নিজেই পরিণত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানে। নিষ্ঠা তাঁকে শিখরে পৌঁছিয়েছে। নানা বিষয়ে আগ্রহ, দূরদর্শিতা এসবই অনুপ্রাণিত করত সান্নিধ্যজনকে। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, মানবকল্যাণ ধারণ করে সম্পন্ন মানবে পরিণত বজলুর রহমান যে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে গেছেন, তাঁর অবর্তমানে তা প্রজ্বালিত রাখার দুরূহ দায়িত্ব অবলীলায় বর্তে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
কী চেয়েছিলেন বজলুর রহমান? কী স্বপ্ন তাঁর ফুল হয়ে ফুটত, সবই উঠে আসত লেখায়। ক্ষুরধার লেখাগুলো চিন্তার খোরাক শুধু নয়, দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের চেয়ারকেও নাড়িয়ে দিত। সাংবাদিকতায় নিয়মনীতি যতটা সম্ভব রক্ষা করে কাজ করেছেন সামরিক-বেসামরিক আমলে। লেখার কোনো কোনো অংশ নিয়ে প্রশ্ন করে আমার কাছে মতামতও জানতে চাইতেন। ভ্রমণকালে সফরসঙ্গী হিসেবে দেখেছি মোহমুগ্ধতায় তাঁকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে।
অকুতোভয় বজলুর রহমান অপত্যস্নেহ আর ভালোবাসায় সিক্ত করে গেছেন স্বজন, অনুরাগী ও গুণমুগ্ধদের। ফুলের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র টান। দেশ-বিদেশে ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে দেখেছি, যেখানেই যেতেন সেখানকার গাছপালা, ফুল-ফসল সম্পর্কে খোঁজ নিতেন। ‘পুষ্প বনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে’। আধুনিকতায় এবং বাঙালিয়ানায় সমৃদ্ধ মানুষটি আমাদের অন্তরাত্মায় গভীরভাবে ঠাঁই করে নিয়েছেন। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও আমাদের নিত্যদিনের জীবনে পাথেয় হয়েই থাকবেন।
সীমার মাঝে অসীম হয়ে বজলুর রহমান বেঁচে থাকবেন তাঁর শ্রম ও কর্মের ফসলে। আগামী দিনগুলোয় আরও বেশি অনুভূত হবে শূন্যতা।
No comments