আলোয় ভুবন ভরাঃ ছাত্ররা দলীয় রাজনীতি করবে না by কাজী জহিরুল ইসলাম
মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়। আজ আমার সেই রকম মন খারাপ। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা পাহাড়ের ওপর, প্রকাণ্ড পাহাড়ি শিমুলটার নিচে গিয়ে বসে পড়ি। লেগুন থেকে ঝিরিঝিরি হাওয়া আসছে। ক’দিন ধরে বেশ গরম পড়েছে।
আবিদজান মূলত আটলান্টিকের সৈকতে গড়ে ওঠা এক শহর। সৈকতের উত্তপ্ত বালু থেকে ভাপ উঠছে। লেগুন থেকে উঠে আসা ঝিরিঝিরি হাওয়াটা বেশ আরাম লাগছে। আমি আরামে চোখ বুজি। ওমা, এরই মধ্যে ঝুপ করে সূর্যটা নেমে গেল লেগুনে। নীল লেগুনে তখন আগুন লেগেছে। লেগুনটা যেখানে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মহাসাগরের কোলে, সেই মোহনাটা পেরিয়ে আটলান্টিকের বুকে ডুবে যাচ্ছে ৩ ফেব্রুয়ারির সূর্য। প্রবাসকারার আরও একটি দিন ফুরিয়ে গেল। সারাদিন কাজ সেরে ঘরে ফিরি। ঘরে ঢুকেই মনে হয় থরে থরে সাজানো আসবাবপত্রের ফাঁকে ফাঁকে হাঁটছে এক গভীর শূন্যতা। পূর্ণতার গভীরে এই শূন্যতার হাঁটাচলাকে উপেক্ষা করে প্রার্থনায় নিমগ্ন হই। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে হাত তুলি। নিজের, পরিবারের, বন্ধুদের কল্যাণ কামনার পাশাপাশি এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমার প্রার্থনার অবধারিত অংশ। সারাক্ষণ উত্কর্ণ থাকি দেশ থেকে কোনো শুভ সংবাদ শোনার জন্য। ১৫ হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব ঘোচাতে ল্যাপটপের বুতাম টিপি। খবরের কাগজ খুলি। ৬ ঘণ্টা পিছিয়ে থাকার কারণে সন্ধ্যা ৭টার পরপরই পরদিনের সব কাগজ অন-লাইনে চলে আসে। ৪ ফেব্রুয়ারির কাগজ খুলে এক গভীর হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মন। একে একে পড়তে থাকি আমার দেশ, ইত্তেফাক, যুগান্তর .... সব কাগজেই অত্যন্ত গুরুত্ব গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী তরুণের করুণ এবং মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর।
কি দোষ আবু বকরের? কেন কৃষক বাবা রুস্তম আলী আর গৃহিণী মা রাবেয়া খাতুনের স্বপ্ন কাফনের মোড়কে আবৃত? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর? আবু বকর এক মেধাবী তরুণ, দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। বড় ভাই তরিতরকারির ব্যবসা করে ভাইকে লেখাপড়া করাচ্ছেন একবুক আশা নিয়ে। আর তো মাত্র ক’টা দিন। আবু বকর এমএ পাস করে বের হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। শুধু দারিদ্র্যই ঘুচে যাবে না রুস্তম আলীর পরিবারের, গ্রামে তাদের মান-মর্যাদাও বেড়ে যাবে। একজন মাত্র মানুষ একটি পরিবারকে সুদূর টাঙ্গাইলের গোলাবাড়ি গ্রাম থেকে টেনে তুলে আনতে পারে রাজধানীর এলিট শ্রেণীতে। আজকের বাংলাদেশের বিখ্যাত মানুষ যারা, তাদের এক/দুই জেনারেশন পেছনে তাকালে তো আমরা এই দৃশ্যই দেখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিয়ার রহমানের আত্মজীবনীমূলক এক লেখা পড়ে জেনেছি তার কৃষক পিতার দারিদ্র্যের কথা। কিন্তু তার সন্তানেরা নিশ্চয়ই একদিন গর্ব করে বলবেন, তাদের পিতা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এমনি এক সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থেকে কৃষক রুস্তম আলীর পরিবার চিরদিনের মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল। এ ক্ষতি অপূরণীয়।
কেন এমন ঘটনা ঘটে? খোঁজ নিয়ে জানতে পারি টিভি চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাত্কারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকী বলেছেন, ‘আমি সব সময় ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে, তবে মাস্তানির পক্ষে নই।’ জনাব সিদ্দিকী, আপনি কোন রাজনীতির কথা বলছেন? আমি কম করে হলেও ৫০টি দেশ ভ্রমণ করেছি, কোথাও দেখিনি ছাত্ররা দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে। উন্নত দেশগুলোতে তো টেরই পাওয়া যায় না ছাত্রদের মধ্যে কোনো রাজনীতির ছিটেফোঁটাও আছে। তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে দেখেছি, ছাত্ররা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে, মিছিল করে। সে ক্ষেত্রে সব ছাত্রের একটাই দল, একটাই দাবি, ছাত্রদের মধ্যে কোনো বিভক্তির দেয়াল দেখিনি। ছাত্রধর্ম হলো লেখাপড়া করা, ভালো রেজাল্ট করা, নিজেকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এতে যদি কোনো বাধা আসে সেটা নিয়ে তারা কথা বলতে পারে। জাতীয় কোনো দুর্যোগে ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়লে ছাত্ররা প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করবে, যেটা একাত্তরে করেছে। ছাত্ররা সত্যের, ন্যায়ের, মানবতার, দেশ রক্ষার রাজনীতি করবে ঐক্যবদ্ধ থেকে। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে দ্বিধাবিভক্তির রাজনীতিতে ছাত্ররা কখনওই যুক্ত হবে না, হওয়া উচিত নয়।
এই ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই ক্ষুব্ধতাটা যেন সাময়িক না হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দিন। এখন তো আপনার দল সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রয়োজনে আইন করে ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি করা নিষিদ্ধ করে দিন। ’৭১ পরবর্তী সময়ে ছাত্ররাজনীতি এ দেশকে কিছুই দেয়নি। উপরন্তু অসংখ্য মায়ের বুক খালি হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন ’৯০-এ স্বৈরাচার হটিয়েছে ছাত্ররা। আমি সেই ইস্যুটিকে একটি জাতীয় ইস্যু মনে করি। এই রকম জাতীয় সমস্যা তৈরি হলে সব ছাত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করবে, এটাই স্বাভাবিক, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিভক্তির রাজনীতি, কোনো দলীয় ব্যানারের রাজনীতি ছাত্ররা করবে না। যদি করে তাহলে এমনি করে আরও অনেক রাবেয়া খাতুন পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাবেন, অনেক কৃষক রুস্তম আলীর বুক খালি হবে, অনেক আব্বাসকে ভাইয়ের লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হবে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
কি দোষ আবু বকরের? কেন কৃষক বাবা রুস্তম আলী আর গৃহিণী মা রাবেয়া খাতুনের স্বপ্ন কাফনের মোড়কে আবৃত? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর? আবু বকর এক মেধাবী তরুণ, দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। বড় ভাই তরিতরকারির ব্যবসা করে ভাইকে লেখাপড়া করাচ্ছেন একবুক আশা নিয়ে। আর তো মাত্র ক’টা দিন। আবু বকর এমএ পাস করে বের হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। শুধু দারিদ্র্যই ঘুচে যাবে না রুস্তম আলীর পরিবারের, গ্রামে তাদের মান-মর্যাদাও বেড়ে যাবে। একজন মাত্র মানুষ একটি পরিবারকে সুদূর টাঙ্গাইলের গোলাবাড়ি গ্রাম থেকে টেনে তুলে আনতে পারে রাজধানীর এলিট শ্রেণীতে। আজকের বাংলাদেশের বিখ্যাত মানুষ যারা, তাদের এক/দুই জেনারেশন পেছনে তাকালে তো আমরা এই দৃশ্যই দেখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিয়ার রহমানের আত্মজীবনীমূলক এক লেখা পড়ে জেনেছি তার কৃষক পিতার দারিদ্র্যের কথা। কিন্তু তার সন্তানেরা নিশ্চয়ই একদিন গর্ব করে বলবেন, তাদের পিতা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এমনি এক সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থেকে কৃষক রুস্তম আলীর পরিবার চিরদিনের মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল। এ ক্ষতি অপূরণীয়।
কেন এমন ঘটনা ঘটে? খোঁজ নিয়ে জানতে পারি টিভি চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাত্কারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকী বলেছেন, ‘আমি সব সময় ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে, তবে মাস্তানির পক্ষে নই।’ জনাব সিদ্দিকী, আপনি কোন রাজনীতির কথা বলছেন? আমি কম করে হলেও ৫০টি দেশ ভ্রমণ করেছি, কোথাও দেখিনি ছাত্ররা দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে। উন্নত দেশগুলোতে তো টেরই পাওয়া যায় না ছাত্রদের মধ্যে কোনো রাজনীতির ছিটেফোঁটাও আছে। তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে দেখেছি, ছাত্ররা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে, মিছিল করে। সে ক্ষেত্রে সব ছাত্রের একটাই দল, একটাই দাবি, ছাত্রদের মধ্যে কোনো বিভক্তির দেয়াল দেখিনি। ছাত্রধর্ম হলো লেখাপড়া করা, ভালো রেজাল্ট করা, নিজেকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এতে যদি কোনো বাধা আসে সেটা নিয়ে তারা কথা বলতে পারে। জাতীয় কোনো দুর্যোগে ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়লে ছাত্ররা প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করবে, যেটা একাত্তরে করেছে। ছাত্ররা সত্যের, ন্যায়ের, মানবতার, দেশ রক্ষার রাজনীতি করবে ঐক্যবদ্ধ থেকে। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে দ্বিধাবিভক্তির রাজনীতিতে ছাত্ররা কখনওই যুক্ত হবে না, হওয়া উচিত নয়।
এই ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই ক্ষুব্ধতাটা যেন সাময়িক না হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দিন। এখন তো আপনার দল সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রয়োজনে আইন করে ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি করা নিষিদ্ধ করে দিন। ’৭১ পরবর্তী সময়ে ছাত্ররাজনীতি এ দেশকে কিছুই দেয়নি। উপরন্তু অসংখ্য মায়ের বুক খালি হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন ’৯০-এ স্বৈরাচার হটিয়েছে ছাত্ররা। আমি সেই ইস্যুটিকে একটি জাতীয় ইস্যু মনে করি। এই রকম জাতীয় সমস্যা তৈরি হলে সব ছাত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করবে, এটাই স্বাভাবিক, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিভক্তির রাজনীতি, কোনো দলীয় ব্যানারের রাজনীতি ছাত্ররা করবে না। যদি করে তাহলে এমনি করে আরও অনেক রাবেয়া খাতুন পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাবেন, অনেক কৃষক রুস্তম আলীর বুক খালি হবে, অনেক আব্বাসকে ভাইয়ের লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হবে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments