বিরোধী নেত্রীর চা চক্র by শাহ আহমদ রেজা
বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে এক চা চক্রে মিলিত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল সব চিন্তা ও মতের সম্পাদক, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিকদের উপস্থিতি।
তাদের অনেকেই সরবে অংশ নিয়েছেন মতবিনিময়ে, খালেদা জিয়াকে হাসতে হাসতে খোঁচাও তারা কম দেননি। কথাটা উল্লেখ করার কারণ হলো, মাত্র কয়েকদিন আগে এসব সম্পাদক, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিকেরই বিরাট অংশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও মিলিত হয়েছিলেন। প্রচণ্ড শীতের বিকালে খোলা আকাশের নিচে আয়োজিত সে অনুষ্ঠানে সরকারবিরোধী কোনো একটি দৈনিকের সম্পাদক বা সাংবাদিককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এসব দৈনিকের রিপোর্টাররাও সেখানে ঢুকতে পারেননি। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের প্রতি এতটা বৈষম্যমূলক আচরণের পরও অংশগ্রহণকারীদের কেউই প্রতিবাদ করেছেন বলে জানা যায়নি। প্রত্যেককে বরং প্রধানমন্ত্রীর গুণকীর্তন করতেই বেশি উত্সাহী দেখা গেছে।
সেই একই সম্পাদক, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিকদেরই কয়েকজনকে সেদিনের চা চক্রে খালেদা জিয়ার সঙ্গে খোলামনে কথা বলতে দেখলাম। তারা মতও প্রকাশ করেছেন দ্বিধাহীনভাবে, নির্ভয়ে তো বটেই! সবচেয়ে বেশি বলেছেন তারা সংসদে যাওয়ার বিষয়ে। এখানেও পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, কোনো একজনই সংসদে সরকারি দলের অভদ্র আচরণের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে টানাটানি কিংবা ‘কুটনি বুড়ি’ ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করারও নিন্দা জানাননি। তাদের প্রত্যেকে শুধু খালেদা জিয়াকে ‘হেদায়েত’ করতে চেয়েছেন—যেন সংসদ খুঁড়িয়ে চলার জন্য তিনিই একমাত্র দায়ী! খালেদা জিয়াকে ‘যত দোষ’ সংক্রান্ত প্রবাদের ‘নন্দ ঘোষ’ বানাতে গিয়ে তারা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাও ছিল বিচিত্র। যেমন—প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, আন্দোলনের সময় সরকারের বাধার মুখে যেভাবে রাজপথে শুয়ে পড়েন, তেমনি সরকার সংসদে যেতে যতই বাধা দিক না কেন, সংসদ আঁকড়ে থাকুন। ওখানে কথা বলতে বাধা দিলে প্রয়োজনে শুয়ে পড়বেন, তাও সংসদ ছাড়বেন না। অথচ খালেদা জিয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা বা নেত্রীই কখনও রাজপথে ‘শুয়ে’ পড়েছেন বলে আমার অন্তত মনে পড়েনি। তাছাড়া ‘শুয়ে’ পড়া তো বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর অনেকাংশে একচেটিয়া কৌশল! সে কথা হঠাত্ খালেদা জিয়াকে শোনানো কেন—এমন প্রশ্ন অনেককেই নাড়া দিয়েছিল। যুগান্তর সম্পাদক সালমা ইসলাম এমপি আবার ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ শুনিয়ে ‘আপাকে’ সংসদে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া সংসদে তাদের নাকি ভালো লাগছে না!
সবাই যে বিশেষ দু’জন সম্পাদকের দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন, সে কথা সম্ভবত না বললেও চলে। তাদের একজন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, আপনারা যেসব কারণে সংসদ বয়কট করেছেন সেসব আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের পরামর্শ হিসেবে মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘যাওয়ার পরিবেশ না থাকলেও সংসদে যান’। এরপর এক পর্যায়ে এসেছিল প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের পালা। আলোচিত এই দ্বিতীয় সম্পাদক অবশ্য নিজ থেকে বলেননি—আসলে বলতে চানই-নি। কিন্তু সমস্যা বাধিয়েছিলেন দৈনিক আমার দেশ’র সাবেক উপদেষ্টা সম্পাদক এবং প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সোজা গিয়ে মতিউর রহমানকে পাকড়াও করেছিলেন। ফলে মুখ না খুলে উপায় পাননি আলোচিত এই সম্পাদক। তিনিও সংসদে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। অনুরোধ করেছেন, বিএনপি যাতে হরতাল-অবরোধ ও ছাত্র ধর্মঘট না করে। করলে তিনি যে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে লিখবেন, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন মতিউর রহমান।
ওদিকে অল্প কথায় চমক লাগিয়েছেন ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দিন। জাতির ঘাড়ে আবারও যাতে কোনো অসাংবিধানিক শাসন চেপে বসতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিতে গিয়ে কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ১/১১ ঘটানোর জন্য যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তারা এখনও তত্পর রয়েছে। তারা ‘এই হলের ভেতরে আছে, দলের ভেতরে আছে এবং টেলিভিশনেও আছে!’ ইনকিলাব সম্পাদকের কথাগুলো ছিল খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ, শুনে অনেকেরই চোখ পড়েছিল আলোচিত দুই সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের দিকে। এভাবে চোখ পড়ার কারণ নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। মাত্র সেদিন পর্যন্তও বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ওপর তাদের প্রভাব নিয়ে অনেক কথা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রয়েছে সেনাবাহিনীকে দিয়ে রাজনীতি করানোর এবং দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ। বলা হয়, মূলত তাদের উস্কানিতেই চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠেছিল। অন্তরালে দেশ ও বিদেশের কিছু বিশেষ শক্তির সমর্থন থাকায় পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারও করেছিলেন তারা যথেচ্ছভাবে। একথাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দেশ আসলে তারা এবং তাদের সঙ্গীরাই চালাচ্ছেন। প্রকাশ্যেও তারা বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার তাদেরই ‘চিন্তা ও চেষ্টার ফসল’ ছিল!
এ শুধু কথার কথা নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও দুই সম্পাদকের দাবি ও ঘোষণার সত্যতা দেখা গেছে। নিজেদের দৈনিকে এবং টিভি চ্যানেলের টকশোতে তারা যা কিছু করতে বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, সেভাবেই ব্যবস্থা নিয়েছে ফখরুদ্দীনের সরকার। যেমন—২০০৮ সালের জানুয়ারিতে কোনো এক টিভি চ্যানেলের টকশোতে দু’তিনজন উপদেষ্টার ব্যাপারে মতিউর রহমান আপত্তি জানিয়েছিলেন। এর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই চার-চারজন উপদেষ্টাকে ‘পদত্যাগ’ করতে হয়েছিল। দেখা গেছে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতেই দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন তারা। প্রতিবারই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাইরে যাওয়া চলবে না। যেমন—২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে যখন রেফারেন্ডাম, জাতীয় সরকার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তখনই দুই সম্পাদক তেড়ে উঠেছিলেন। নির্দেশের সুরে মতিউর রহমান লিখেছিলেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে হবে সময়মত।... সেনাবাহিনীকেও এ কাজে সহায়তা করতে হবে।’ কথাগুলো স্মরণ করলে হঠাত্ মনে হতে পারে যেন সংসদ নির্বাচনের জন্য দুই সম্পাদক উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে সত্য ছিল অন্য রকম। নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পূর্বশর্ত যে রাজনৈতিক দল, সে দলগুলোকেই দু’জনে তুলোধুনো করে ছেড়েছেন। কারণ তারা দেখেছেন, ‘অনেকেরই চোখে-মুখে’ নাকি ১১ জানুয়ারির পূর্ব-অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ‘চিহ্ন অস্পষ্ট নয়’! অন্য এক উপলক্ষে মতিউর রহমান লিখেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যাতে কোনো রকম ‘সুযোগ’ না নিতে পারে সে ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে ‘লক্ষ্য’ রাখতে ও ‘ব্যবস্থা’ নিতে হবে। তিনি সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও ক্ষমতা দখল না করতে সতর্ক করেছিলেন। তার নির্দেশনা ছিল, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করে’ সেনাবাহিনীকে নিজেদের ‘ক্ষেত্রে’ ফিরে যেতে হবে।
প্রশ্ন উঠেছিল, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে’ পালন করার যে দায়িত্বের কথা মতিউর রহমান বলেছেন, সে ‘দায়িত্ব’টা আসলে কী? এটা কি দুই সম্পাদকের সমন্বয়ে ‘সুশীল’ নামধারী কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের ‘ক্ষেত্রে’ ফিরে যাওয়া? এমন প্রশ্নের একটি কারণ হলো, মতিউর রহমান বারবার ‘আমরা’ এবং ‘আমাদের’ ব্যবহার করেছিলেন—যা থেকে স্পষ্ট হয়েছিল, হত্যা-সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়াসহ ১/১১-মুখী ঘটনাপ্রবাহের পেছনে আসলে কাদের কালোহাত ছিল। কালোহাতও দূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই ব্যবহার করা হয়েছিল। এসবের মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল—১. প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে; এবং ২. রাজনৈতিক নেতৃত্ব উত্খাতের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করলেও সেনাবাহিনী যাতে ক্ষমতা দখল না করতে পারে। মূল উদ্দেশ্য এখানে পরিষ্কারই ছিল—‘সুশীল’ সমাজের আড়ালে তারা সম্ভবত নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা এবং রাজনীতি যোগ-বিয়োগ ধরনের সহজ অংক নয়। কথাটা মইন উ’দের মতো দুই সম্পাদককেও হাড়ে হাড়ে বুঝতে হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার মধ্য দিয়ে কিছুদিন মাত্র ‘জোয়ার’ সৃষ্টি করতে পারলেও খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে তারা ‘মাইনাস’ করতে পারেননি। সংস্কারের ‘ট্যাবলেট’ গেলেনি জনগণ, দেশকেও প্রচলিত রাজনীতির বাইরে ঠেলে দেয়া সম্ভব হয়নি। বছর দেড়েকের মাথায় এসেই মতিউর রহমানকে বরং স্বীকার করতে হয়েছিল, ‘এতকিছুর পরও বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে দুই নেত্রীর প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।... বাস্তবতা হচ্ছে, এখন তারাই দেশের প্রধান দুই দলের মূল নেতা। ভবিষ্যতে তারাই দলকে পরিচালনা করবেন। আগামী নির্বাচনেও তারাই সামনে থাকবেন।...’
কথাগুলো অবশ্য খুব খুশি মনে বলেননি মতিউর রহমান। না বলার কারণ বুঝতে হলে ১/১১-এর পূর্ববর্তী দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে হবে। দুই সম্পাদক শুধু নন, তাদের গোষ্ঠীর প্রতিটি সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল সে সময় জটিলতা ও ঝামেলা বাড়ানোর একই উদ্দেশ্য নিয়ে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়া তো বটেই, ২২ জানুয়ারির নির্বাচনও যাতে অনুষ্ঠিত না হতে পারে সেটাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের মিলিত চাপের মুখে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে ‘অপারগতা’ প্রকাশ করতে হয়েছিল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এমএ আজিজও ‘ছুটি’ নিয়ে কেটে পড়েছিলেন। দুই সম্পাদক ও তাদের সঙ্গী-সাথীরা সবচেয়ে বেশি লেগেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পেছনে। শেষ পর্যন্ত তারা ১/১১ ঘটিয়ে ছেড়েছিলেন।
তবে ১/১১-পরবর্তী দিনগুলোতে সবই যে সব সময় ঠিকঠাকমত চলেছে, তা অবশ্য নয়। কখনও কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থানরত কারও কারও সঙ্গে দুই সম্পাদকের মতানৈক্য ঘটতেও দেখা গেছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর উদ্দেশে তেড়ে উঠেছেন তারা। নির্বাচন নস্যাত্ করে দেয়ার কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর ‘কার্যকর ভূমিকার’ প্রশংসা করলেও মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘তবে দেশ পরিচালনায় সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ বা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের ফল ভালো হয় না। এটা বিশ্বের কোথাও হয়নি।’ এরপর এসেছে তাদের মনের কথা—‘তারা (সেনাবাহিনী) যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করে নিজেদের ক্ষেত্রে ফিরে যায় তাহলে তা বিশ্বের সামনে একটা নতুন নজির সৃষ্টি করবে।’ সে সময় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল শেষের কথাটুকুতে। বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক নামের সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর মধ্য দিয়ে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’-এর দলভুক্ত দুই সম্পাদকের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল মাত্র। এ সাফল্যের ভিত্তিতে এরপর ‘তারা’ অনেক বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে পা বাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে মতানৈক্য ঘটেছিল। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, ১/১১-এর পরপর ২০০৭ সালের ২ এপ্রিল পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পঠিত মূল নিবন্ধে তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ বাংলাদেশের জন্য ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার এবং ক্ষমতায় সেনাপ্রধানকে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। পরদিনই এক সম্পাদকীয়র মাধ্যমে মইন উ’কে প্রথমে কষে ধরেছিলেন মাহফুজ আনাম। মতিউর রহমানও ‘অতীতকে ফিরিয়ে আনা যাবে না’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন প্রথম পৃষ্ঠায়। দুই সম্পাদক আক্রমণও চালিয়েছিলেন একই লাইন ধরে। ফলে বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কোনো বিশেষ কেন্দ্রের নির্দেশেই তারা সেনাপ্রধান-বিরোধী আক্রমণকে শাণিত করেছিলেন। দুই সম্পাদকের কথাগুলোও ছিল খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। যেমন মাহফুজ আনাম লিখেছিলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী রাজনীতিতে জড়াবে না। অর্পিত দায়িত্ব পালন শেষে ব্যারাকে ফিরতে হবে তাদের।’ লক্ষণীয় যে, ‘ব্যারাকে ফিরে যাওয়া উচিত’ ধরনের কোনো পরামর্শ দেয়ার পরিবর্তে মাহফুজ আনাম হুকুমের সুরে বলেছিলেন, ‘ব্যারাকে ফিরতে হবে তাদের।’ মতিউর রহমানও সরাসরি হুমকি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘লে. জেনারেল মইন উ আহমেদ নিশ্চয় তার পূর্বসুরিদের ইতিহাস জানেন। জনগণ চায় না, সেই অতীত ফিরে আসুক।’ সে সময় আলোচনাও বেশ জমে উঠেছিল। বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রক্ষমতার আশপাশ থেকে সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্য নিয়েই কথাগুলো বলেছিলেন দুই প্রতিবেশী সম্পাদক। আর এর কারণ, তারা যে বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করছিলেন, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সে গোষ্ঠীর ‘কাজ উদ্ধার’ হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থ হয়েছিল, নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এজন্যই সেনাবাহিনীকে সঙ্গে রাখার প্রয়োজনও তখন ফুরিয়ে গিয়েছিল। দুই সম্পাদকের গোষ্ঠী তখন নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তেমন কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের পথে প্রধান এবং একমাত্র সক্ষম প্রতিবন্ধক ছিল সেনাবাহিনী, জেনারেল মইন উ’র মুখ দিয়ে সে সম্ভাবনার কথাই উচ্চারিত হয়েছিল। দুই সম্পাদকও সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন একই কারণে। এজন্যই বারবার তারা সেনাবাহিনীকে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘দায়িত্ব’ পালন করে নিজেদের ‘ক্ষেত্রে’ তথা ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে দুই সম্পাদকের চাওয়াটাও অস্পষ্ট থাকেনি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘না’ বলার এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরোধিতা করার পর বাকি থেকেছে শুধু একটি বিকল্পই—সেটা ওই সম্পাদকদের সমন্বয়ে ‘সুশীল’ নামধারী কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া। এ কাজটুকুও তারা সেনাবাহিনীকে দিয়েই করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের কথামত মাঝপথে থেমে পড়তে সম্মত হচ্ছিল না বলেই তেড়ে উঠেছিলেন দুই সম্পাদক।
খালেদা জিয়ার চা চক্রের অনুষ্ঠানে ইনকিলাব সম্পাদকের মন্তব্যে এবং অন্য কয়েকজনের কথায়ও এসব বিষয়ই নতুন করে মনে পড়েছে সবার। কেউ কেউ একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, হুবহু ১/১১-এর স্টাইলে না হলেও নতুন কৌশলে অসাংবিধানিক শাসন চাপানোর ষড়যন্ত্র এখনও পুরোদমেই চলছে।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
সেই একই সম্পাদক, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিকদেরই কয়েকজনকে সেদিনের চা চক্রে খালেদা জিয়ার সঙ্গে খোলামনে কথা বলতে দেখলাম। তারা মতও প্রকাশ করেছেন দ্বিধাহীনভাবে, নির্ভয়ে তো বটেই! সবচেয়ে বেশি বলেছেন তারা সংসদে যাওয়ার বিষয়ে। এখানেও পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, কোনো একজনই সংসদে সরকারি দলের অভদ্র আচরণের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে টানাটানি কিংবা ‘কুটনি বুড়ি’ ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করারও নিন্দা জানাননি। তাদের প্রত্যেকে শুধু খালেদা জিয়াকে ‘হেদায়েত’ করতে চেয়েছেন—যেন সংসদ খুঁড়িয়ে চলার জন্য তিনিই একমাত্র দায়ী! খালেদা জিয়াকে ‘যত দোষ’ সংক্রান্ত প্রবাদের ‘নন্দ ঘোষ’ বানাতে গিয়ে তারা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাও ছিল বিচিত্র। যেমন—প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, আন্দোলনের সময় সরকারের বাধার মুখে যেভাবে রাজপথে শুয়ে পড়েন, তেমনি সরকার সংসদে যেতে যতই বাধা দিক না কেন, সংসদ আঁকড়ে থাকুন। ওখানে কথা বলতে বাধা দিলে প্রয়োজনে শুয়ে পড়বেন, তাও সংসদ ছাড়বেন না। অথচ খালেদা জিয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা বা নেত্রীই কখনও রাজপথে ‘শুয়ে’ পড়েছেন বলে আমার অন্তত মনে পড়েনি। তাছাড়া ‘শুয়ে’ পড়া তো বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর অনেকাংশে একচেটিয়া কৌশল! সে কথা হঠাত্ খালেদা জিয়াকে শোনানো কেন—এমন প্রশ্ন অনেককেই নাড়া দিয়েছিল। যুগান্তর সম্পাদক সালমা ইসলাম এমপি আবার ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ শুনিয়ে ‘আপাকে’ সংসদে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া সংসদে তাদের নাকি ভালো লাগছে না!
সবাই যে বিশেষ দু’জন সম্পাদকের দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন, সে কথা সম্ভবত না বললেও চলে। তাদের একজন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, আপনারা যেসব কারণে সংসদ বয়কট করেছেন সেসব আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের পরামর্শ হিসেবে মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘যাওয়ার পরিবেশ না থাকলেও সংসদে যান’। এরপর এক পর্যায়ে এসেছিল প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের পালা। আলোচিত এই দ্বিতীয় সম্পাদক অবশ্য নিজ থেকে বলেননি—আসলে বলতে চানই-নি। কিন্তু সমস্যা বাধিয়েছিলেন দৈনিক আমার দেশ’র সাবেক উপদেষ্টা সম্পাদক এবং প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সোজা গিয়ে মতিউর রহমানকে পাকড়াও করেছিলেন। ফলে মুখ না খুলে উপায় পাননি আলোচিত এই সম্পাদক। তিনিও সংসদে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। অনুরোধ করেছেন, বিএনপি যাতে হরতাল-অবরোধ ও ছাত্র ধর্মঘট না করে। করলে তিনি যে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে লিখবেন, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন মতিউর রহমান।
ওদিকে অল্প কথায় চমক লাগিয়েছেন ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দিন। জাতির ঘাড়ে আবারও যাতে কোনো অসাংবিধানিক শাসন চেপে বসতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিতে গিয়ে কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ১/১১ ঘটানোর জন্য যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তারা এখনও তত্পর রয়েছে। তারা ‘এই হলের ভেতরে আছে, দলের ভেতরে আছে এবং টেলিভিশনেও আছে!’ ইনকিলাব সম্পাদকের কথাগুলো ছিল খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ, শুনে অনেকেরই চোখ পড়েছিল আলোচিত দুই সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের দিকে। এভাবে চোখ পড়ার কারণ নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। মাত্র সেদিন পর্যন্তও বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ওপর তাদের প্রভাব নিয়ে অনেক কথা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রয়েছে সেনাবাহিনীকে দিয়ে রাজনীতি করানোর এবং দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ। বলা হয়, মূলত তাদের উস্কানিতেই চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠেছিল। অন্তরালে দেশ ও বিদেশের কিছু বিশেষ শক্তির সমর্থন থাকায় পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারও করেছিলেন তারা যথেচ্ছভাবে। একথাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দেশ আসলে তারা এবং তাদের সঙ্গীরাই চালাচ্ছেন। প্রকাশ্যেও তারা বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার তাদেরই ‘চিন্তা ও চেষ্টার ফসল’ ছিল!
এ শুধু কথার কথা নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও দুই সম্পাদকের দাবি ও ঘোষণার সত্যতা দেখা গেছে। নিজেদের দৈনিকে এবং টিভি চ্যানেলের টকশোতে তারা যা কিছু করতে বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, সেভাবেই ব্যবস্থা নিয়েছে ফখরুদ্দীনের সরকার। যেমন—২০০৮ সালের জানুয়ারিতে কোনো এক টিভি চ্যানেলের টকশোতে দু’তিনজন উপদেষ্টার ব্যাপারে মতিউর রহমান আপত্তি জানিয়েছিলেন। এর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই চার-চারজন উপদেষ্টাকে ‘পদত্যাগ’ করতে হয়েছিল। দেখা গেছে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতেই দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন তারা। প্রতিবারই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাইরে যাওয়া চলবে না। যেমন—২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে যখন রেফারেন্ডাম, জাতীয় সরকার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তখনই দুই সম্পাদক তেড়ে উঠেছিলেন। নির্দেশের সুরে মতিউর রহমান লিখেছিলেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে হবে সময়মত।... সেনাবাহিনীকেও এ কাজে সহায়তা করতে হবে।’ কথাগুলো স্মরণ করলে হঠাত্ মনে হতে পারে যেন সংসদ নির্বাচনের জন্য দুই সম্পাদক উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে সত্য ছিল অন্য রকম। নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পূর্বশর্ত যে রাজনৈতিক দল, সে দলগুলোকেই দু’জনে তুলোধুনো করে ছেড়েছেন। কারণ তারা দেখেছেন, ‘অনেকেরই চোখে-মুখে’ নাকি ১১ জানুয়ারির পূর্ব-অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ‘চিহ্ন অস্পষ্ট নয়’! অন্য এক উপলক্ষে মতিউর রহমান লিখেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যাতে কোনো রকম ‘সুযোগ’ না নিতে পারে সে ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে ‘লক্ষ্য’ রাখতে ও ‘ব্যবস্থা’ নিতে হবে। তিনি সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও ক্ষমতা দখল না করতে সতর্ক করেছিলেন। তার নির্দেশনা ছিল, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করে’ সেনাবাহিনীকে নিজেদের ‘ক্ষেত্রে’ ফিরে যেতে হবে।
প্রশ্ন উঠেছিল, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে’ পালন করার যে দায়িত্বের কথা মতিউর রহমান বলেছেন, সে ‘দায়িত্ব’টা আসলে কী? এটা কি দুই সম্পাদকের সমন্বয়ে ‘সুশীল’ নামধারী কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের ‘ক্ষেত্রে’ ফিরে যাওয়া? এমন প্রশ্নের একটি কারণ হলো, মতিউর রহমান বারবার ‘আমরা’ এবং ‘আমাদের’ ব্যবহার করেছিলেন—যা থেকে স্পষ্ট হয়েছিল, হত্যা-সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়াসহ ১/১১-মুখী ঘটনাপ্রবাহের পেছনে আসলে কাদের কালোহাত ছিল। কালোহাতও দূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই ব্যবহার করা হয়েছিল। এসবের মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল—১. প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে; এবং ২. রাজনৈতিক নেতৃত্ব উত্খাতের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করলেও সেনাবাহিনী যাতে ক্ষমতা দখল না করতে পারে। মূল উদ্দেশ্য এখানে পরিষ্কারই ছিল—‘সুশীল’ সমাজের আড়ালে তারা সম্ভবত নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা এবং রাজনীতি যোগ-বিয়োগ ধরনের সহজ অংক নয়। কথাটা মইন উ’দের মতো দুই সম্পাদককেও হাড়ে হাড়ে বুঝতে হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার মধ্য দিয়ে কিছুদিন মাত্র ‘জোয়ার’ সৃষ্টি করতে পারলেও খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে তারা ‘মাইনাস’ করতে পারেননি। সংস্কারের ‘ট্যাবলেট’ গেলেনি জনগণ, দেশকেও প্রচলিত রাজনীতির বাইরে ঠেলে দেয়া সম্ভব হয়নি। বছর দেড়েকের মাথায় এসেই মতিউর রহমানকে বরং স্বীকার করতে হয়েছিল, ‘এতকিছুর পরও বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে দুই নেত্রীর প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।... বাস্তবতা হচ্ছে, এখন তারাই দেশের প্রধান দুই দলের মূল নেতা। ভবিষ্যতে তারাই দলকে পরিচালনা করবেন। আগামী নির্বাচনেও তারাই সামনে থাকবেন।...’
কথাগুলো অবশ্য খুব খুশি মনে বলেননি মতিউর রহমান। না বলার কারণ বুঝতে হলে ১/১১-এর পূর্ববর্তী দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে হবে। দুই সম্পাদক শুধু নন, তাদের গোষ্ঠীর প্রতিটি সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল সে সময় জটিলতা ও ঝামেলা বাড়ানোর একই উদ্দেশ্য নিয়ে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়া তো বটেই, ২২ জানুয়ারির নির্বাচনও যাতে অনুষ্ঠিত না হতে পারে সেটাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের মিলিত চাপের মুখে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে ‘অপারগতা’ প্রকাশ করতে হয়েছিল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এমএ আজিজও ‘ছুটি’ নিয়ে কেটে পড়েছিলেন। দুই সম্পাদক ও তাদের সঙ্গী-সাথীরা সবচেয়ে বেশি লেগেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পেছনে। শেষ পর্যন্ত তারা ১/১১ ঘটিয়ে ছেড়েছিলেন।
তবে ১/১১-পরবর্তী দিনগুলোতে সবই যে সব সময় ঠিকঠাকমত চলেছে, তা অবশ্য নয়। কখনও কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থানরত কারও কারও সঙ্গে দুই সম্পাদকের মতানৈক্য ঘটতেও দেখা গেছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর উদ্দেশে তেড়ে উঠেছেন তারা। নির্বাচন নস্যাত্ করে দেয়ার কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর ‘কার্যকর ভূমিকার’ প্রশংসা করলেও মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘তবে দেশ পরিচালনায় সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ বা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের ফল ভালো হয় না। এটা বিশ্বের কোথাও হয়নি।’ এরপর এসেছে তাদের মনের কথা—‘তারা (সেনাবাহিনী) যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করে নিজেদের ক্ষেত্রে ফিরে যায় তাহলে তা বিশ্বের সামনে একটা নতুন নজির সৃষ্টি করবে।’ সে সময় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল শেষের কথাটুকুতে। বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক নামের সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর মধ্য দিয়ে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’-এর দলভুক্ত দুই সম্পাদকের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল মাত্র। এ সাফল্যের ভিত্তিতে এরপর ‘তারা’ অনেক বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে পা বাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে মতানৈক্য ঘটেছিল। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, ১/১১-এর পরপর ২০০৭ সালের ২ এপ্রিল পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পঠিত মূল নিবন্ধে তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ বাংলাদেশের জন্য ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার এবং ক্ষমতায় সেনাপ্রধানকে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। পরদিনই এক সম্পাদকীয়র মাধ্যমে মইন উ’কে প্রথমে কষে ধরেছিলেন মাহফুজ আনাম। মতিউর রহমানও ‘অতীতকে ফিরিয়ে আনা যাবে না’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন প্রথম পৃষ্ঠায়। দুই সম্পাদক আক্রমণও চালিয়েছিলেন একই লাইন ধরে। ফলে বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কোনো বিশেষ কেন্দ্রের নির্দেশেই তারা সেনাপ্রধান-বিরোধী আক্রমণকে শাণিত করেছিলেন। দুই সম্পাদকের কথাগুলোও ছিল খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। যেমন মাহফুজ আনাম লিখেছিলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী রাজনীতিতে জড়াবে না। অর্পিত দায়িত্ব পালন শেষে ব্যারাকে ফিরতে হবে তাদের।’ লক্ষণীয় যে, ‘ব্যারাকে ফিরে যাওয়া উচিত’ ধরনের কোনো পরামর্শ দেয়ার পরিবর্তে মাহফুজ আনাম হুকুমের সুরে বলেছিলেন, ‘ব্যারাকে ফিরতে হবে তাদের।’ মতিউর রহমানও সরাসরি হুমকি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘লে. জেনারেল মইন উ আহমেদ নিশ্চয় তার পূর্বসুরিদের ইতিহাস জানেন। জনগণ চায় না, সেই অতীত ফিরে আসুক।’ সে সময় আলোচনাও বেশ জমে উঠেছিল। বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রক্ষমতার আশপাশ থেকে সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্য নিয়েই কথাগুলো বলেছিলেন দুই প্রতিবেশী সম্পাদক। আর এর কারণ, তারা যে বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করছিলেন, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সে গোষ্ঠীর ‘কাজ উদ্ধার’ হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থ হয়েছিল, নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এজন্যই সেনাবাহিনীকে সঙ্গে রাখার প্রয়োজনও তখন ফুরিয়ে গিয়েছিল। দুই সম্পাদকের গোষ্ঠী তখন নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তেমন কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের পথে প্রধান এবং একমাত্র সক্ষম প্রতিবন্ধক ছিল সেনাবাহিনী, জেনারেল মইন উ’র মুখ দিয়ে সে সম্ভাবনার কথাই উচ্চারিত হয়েছিল। দুই সম্পাদকও সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন একই কারণে। এজন্যই বারবার তারা সেনাবাহিনীকে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘দায়িত্ব’ পালন করে নিজেদের ‘ক্ষেত্রে’ তথা ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে দুই সম্পাদকের চাওয়াটাও অস্পষ্ট থাকেনি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘না’ বলার এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরোধিতা করার পর বাকি থেকেছে শুধু একটি বিকল্পই—সেটা ওই সম্পাদকদের সমন্বয়ে ‘সুশীল’ নামধারী কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া। এ কাজটুকুও তারা সেনাবাহিনীকে দিয়েই করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের কথামত মাঝপথে থেমে পড়তে সম্মত হচ্ছিল না বলেই তেড়ে উঠেছিলেন দুই সম্পাদক।
খালেদা জিয়ার চা চক্রের অনুষ্ঠানে ইনকিলাব সম্পাদকের মন্তব্যে এবং অন্য কয়েকজনের কথায়ও এসব বিষয়ই নতুন করে মনে পড়েছে সবার। কেউ কেউ একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, হুবহু ১/১১-এর স্টাইলে না হলেও নতুন কৌশলে অসাংবিধানিক শাসন চাপানোর ষড়যন্ত্র এখনও পুরোদমেই চলছে।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments