এই নগরীর দিনরাত্রিঃ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে by রেজোয়ান সিদ্দিকী

কাল পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের শুরু। বসন্ত বন্দনা বাংলাদেশে বহুকাল থেকেই আছে। প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুরু করে এ যুগের কবি-সাহিত্যিকেরাও বসন্ত নিয়ে এন্তার কাব্য-কথা লিখেছেন। ঋতুরাজ বসন্ত। স্বাগত বসন্ত। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বসন্তই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে নিবেদিত।

এর যে কারণ নেই তা নয়। বাংলাদেশে কোনো ঋতুই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু বসন্ত আসে মহাসমারোহে। এ দৃশ্য গ্রামে যত না চোখে পড়ে শহরে পড়ে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তরুণ-তরুণীরা লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরে, লাল হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানাতে নগরীর রাজপথে নেমে আসে। শীতের পোশাকের ভার মুক্তি ঘটে বসন্তের দিন। ঝরঝরে হালকা মেজাজে সারা শহর মেতে ওঠে বসন্ত উত্সবে। পত্রিকার পাতায় পাতায় দেখি বাসন্তি পোশাক ফ্যাশনের বাহার। পরিধেয় সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। নাগরিক মানুষেরা উত্সবের অনুষঙ্গ খুঁজে পায়।
নগরে যখন প্রচণ্ড শীত জেঁকে বসেছিল তখন আমরা আশাবাদী মানুষেরা নাগরিকদের এই বলে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম যে, শীত যখন এসেছে, বসন্ত খুব দূরে নয়। ধীরে ধীরে পায়ে পায়ে বসন্ত এসে গিয়েছে। গাছে গাছে ফুল, মুকুলের সমারোহ। মধুকড়ের গুঞ্জন ধ্বনি। হাওয়ায় ফুলের ঘ্রাণ। গাছের পাতাদের ঘুরতে ঘুরতে ঝরে পড়া। পাখিদের বাসা বাঁধার তোড়জোড়। সামান্য বাতাসে মন-প্রাণ ভরে ওঠে। এরই নাম বসন্ত।
এখন অকারণে মন উদাস হয়ে ওঠে। কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে। কারও বলা হয়। কারও কারও বলা হয়ে ওঠে না। এই দুঃখ-বেদনার মধ্যে এক ধরনের আনন্দের শিহরণ। হৃদয়ে হিল্লোল তোলে। অনুভূতিগুলোরও পরিবর্তন ঘটে। সেই অনুভূতির রকমফের ভিন্ন। শীত আর গ্রীষ্মের মধ্যে কোথায় যেন এক সেতুবন্ধ রচনা করে দেয় বসন্তকাল। শীত চলে গেছে। গ্রীষ্ম আসেনি। তার মাঝখানে আকুল করা হৃদয় নিয়ে নাগরিকরা উদাস হয়। বহুকাল ধরে এই ঋতুতে ঔদাস্যের সামান্য বিলাসিতা লালন করে আসছে নাগরিকেরা। বসন্তে ফুলের কদর বাড়ে। প্রিয়জনের হাতে একটি ফুল তুলে দিয়ে নাগরিকেরা কত কি যে নিবেদন করে। সে নিবেদন কখনও সফল হয়, কখনও তা অন্তর্বেদনার চাপা হাহাকার তুলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
বসন্ত যার হৃদয়ে আনন্দের ধারা উন্মোচন করে তার সুখের সীমা নেই। মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন, ‘মধু-ঋতু মধুকর-পাঁতি। মধুর কুসুম মধুমাতি\ মধুর বৃন্দাবন-মা মধুর মধুর রসরাজ\ মধুর যুবতীগণ অঙ্গ। মধুর মধুর রসসঙ্গ\ মধুর মাদল রসাল। মধুর মধুর করতাল\ মধুর নটন গতি ভঙ্গ। মধুর নটিনা-নট রঙ্গ \ মধুর মধুর রস-গান। মধুর বিদ্যাপতি ভাণ\’ কবির দৃষ্টিতে সব কিছুই মধুময় হয়ে উঠেছে বসন্তে। কিন্তু আধুনিক কালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘রোদনভরা এ বসন্ত/সখী কখনও আসেনি বুঝি আগে।’ গান বসন্তের বেদনাজাগানিয়া। কিন্তু পাবার আকাঙ্ক্ষা এবং না পাওয়ার বেদনাও বসন্তে কখনও কখনও হৃদয়ের ভেতর মারাত্মক তোলপাড় তোলে। আনন্দে হোক, বেদনায় হোক তোলপাড় যে তোলেই। এটাই বসন্তের নিয়ম। এ কারণে বসন্ত এত প্রিয়।
ফুট ওভারব্রিজে রাস্তা পার
নগরীতে মানুষ বেড়েছে। যানবাহন বেড়েছে। যানজট বেড়েছে। রাস্তা এক-আধটি প্রসারিত হলেও অধিকাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। হকার, দোকানপাট, ভিক্ষুক, ফুটপাত ছাড়িয়েও কোনো কোনো স্থানে রাস্তার অধিকাংশই দখল করে নিয়েছে। কোথাওবা দুই-তিন লাইনে পার্কিং। ফলে বেহাল দশা। যানবাহনের কারণে নাগরিকদের রাস্তা পার হওয়াই দায়। রাস্তা পার হতে গিয়ে যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে আদম সন্তান। ঘরে ঘরে কান্নার রোল ওঠে। এক সময় সে রোল থেমে যায়। নতুন পরিবারে আবারও কান্নার রোল। নগরীতে যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে না এমন দিন বিরল। গত এক বছরে শুধু ঢাকায়ই যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে ৩২৪ জন। মামলা হয়েছিল ৬১৭টি। বেপরোয়া যান চালনার জন্য সাজা পায়নি একজনও। ফলে যান চালকেরা এখন আরও বেশি বেপরোয়া।
নাগরিকদের এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার অভিপ্রায় নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে ফুট ওভারব্রিজ। দুই-একটি আন্ডার পাস। এর কোনোটির পরিবেশই পথ পারাপারের অনুকূল নয়। ফুট ওভারব্রিজগুলোর ওপরে নানা ধরনের মনোহারি পণ্যের দোকান। হাঁটা পথের মাঝখানে ভিক্ষার পাত্র রেখে পড়ে থাকে পঙ্গু ভিখারি। ভিক্ষার জন্য দু’পাশে হাত বাড়িয়ে নাগরিকদের আঁকড়ে ধরে। পথ পেরিয়ে যাওয়াই কষ্টকর, গায়ে ধাক্কা। হঠাত্ ছিনতাইকারীর আবির্ভাব। এসবের বিপদও কম নয়। ফলে খুব বাধ্য না হলে কেউ এসব ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারই করতে চায় না।
শুধু এই তো নয়। নগরীর পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ভোরবেলা কোনো কোনো রাজপথ ঝাড়ু দেয় কিন্তু ফুট ওভার ব্রিজের দিকে যেন কেউ খেয়ালই করে না। সেখানে মল-মূত্রেরও অস্তিত্ব আছে। ধূলোবালির স্তূপাকার। সেটি মনে হলে ফুট ওভারব্রিজের দিকে যেন কেউ খেয়ালই করে না। সেখানে মল-মূত্রেরও অস্তিত্ব আছে। ধূলোবালি স্তূপাকার। সেটি মনে হলে ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চিন্তাও করা যায় না। মানুষের অভ্যাস বদলের জন্য এক সময় ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পারাপার বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করেছিল। ফুট ওভারব্রিজ ফেলে রাজপথ দিয়ে রাস্তা পারপারে চেষ্টাকারীদের জরিমানার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ফুট ওভারব্রিজ ফেলে অধিকাংশ নাগরিক ব্রিজের নিচ দিয়েই রাস্তা পার হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কোথাও কোথাও ফুট ওভারব্রিজের নিচে শক্ত লোহার বেড়া দেয়া হয়েছে। নাগরিকরা নানা কসরত্ করে সে বেড়া ডিঙ্গায়। তবুও সহজে বাধ্য না হলে ফুট ওভারব্রিজে উঠতে চায় না কেউ।
কিন্তু নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে পার হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। খুব প্রবীণ বয়স্ক লোকদের পক্ষে হয়তো ফুট ওভারব্রিজের পিঁড়ি অতিক্রম করা কষ্টকর। সেক্ষেত্রে পুলিশ তাদের হাত ধরে পার করতে পারেন। বাকিরা যাতে ফুটওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হন। তার জন্য সেখানকার পরিবেশও নিশ্চিত করা দরকার। ফুট ওভারব্রিজ থেকে সরিয়ে দেয়া দরকার হকার কিংবা ভিখারি। তেমনি এর পরিচ্ছন্নতাও নিশ্চিত করা দরকার, যাতে ব্রিজ পার হতে গিয়ে নাগরিকদের নাকে রুমাল চাপতে না হয়।
মোবাইল প্রেমের ফাঁদে
মোটামুটি ফাঁকা এক রেস্তোরাঁয় খেতে বসলেন এক মাঝবয়েসী লোক। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। খাবার আসার আগেই তার মোবাইলে মিসকল। তিনি কলব্যাক করলেন। মোবাইলের কথোপকথন আশপাশের লোকজন শুনে ফেলল কিনা, সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। বললেন, ‘কেমন আছ? তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা না বললে মন কেমন করে ওঠে। ভালো করেছ ফোন করে।’ এরপর তিনি এক কাহিনী বর্ণনা করলেন। গত সপ্তাহে কোলকাতা গিয়েছিলেন তিন বন্ধু মিলে। তারা তিনজনই গিয়েছিলেন নিষিদ্ধ পল্লীতে। কিন্তু তিনি বসেছিলেন। কফি খেয়েছেন। গল্প করেছেন। তারপর চলে এসেছেন। কারণ, তিনি ও ধরনের সম্পর্ক তার সঙ্গেই করতে চান, যাকে তিনি ভালোবাসেন। ওপাশে মেয়েটি ধরেই ছিল, কেটে দেয়নি। লোকটি বলতে থাকলেন, ‘আমার দুটি ছেলেমেয়ে, স্ত্রী অকেজো। ঢাকায় আমার যে অ্যাসেট আছে, আমার তিন জেনারেশন তা খেয়ে শেষ করতে পারবে না। ব্যবসা করি, আল্লাহর রহমতে কোনো দিন লস করি নাই। তোমার ছবি পাঠাবে? না ছবির কোনো দরকার নেই। আমার চোখ, আমার মন, আমার হৃদয় দিয়ে আমি তোমাকে দেখব। আমি তোমার ছবি দেখতে চাই না। যদি দেখতে হয়, তোমার পাশে বসে তোমাকে দেখব। যে মেয়ে আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে, তার গায়ের রং, শরীরের আকৃতি কিছুই আমি দেখতে চাই না, বুঝতেও চাই না। তোমাকে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করাব। আমার স্ত্রী, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে তুমিও হবে আমার পরিবারের একজন। চোখ বন্ধ করলে আমাকে তো জবাবদিহি করতে হবে। সিদুুঁর যদি পরতে ইচ্ছে হয় তাহলে তুমি তা পরতে পার। আমি তোমার ছবি নির্মাণ করি না। ও তোমার আত্মীয়রা খেয়াল করছে? জানতে চাইছে কার সঙ্গে কথা বলছ? তুমি তাদের বলে দিও তুমি একটি পাগলের সঙ্গে কথা বলছ, যে তোমার পাগল। যে অন্ধ। আমি তোমার ছবি আঁকতে চাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কিংবা কুিসত করে। তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। তাদের বরং সত্য কথা বল। বল, তুমি জান না। বল আমি তাকে চিনি না। দেখিনি। জানিনি। তবে কোনো একদিন তাকে এখানে নিয়ে আসব। তখন তোমরাও দেখবে আমিও দেখব সে কে। আমি যদি একবার তোমার কাছে আসি, সবাই তোমাকে পাগল করে ফেলবে, আমাকে তোমার জন্য চাই। তারা তখন বলবে এত সুন্দর মানুষ কখনও দেখিনি। ইউ ডন্ট ওয়ান্ট টু ইউ (ইংরেজি লক্ষণীয়) হ্যাঁ, আমি তোমার কাছে চলে আসব ২০ তারিখের পরে। যেদিন আসব একটি মোবাইল ফোনও সঙ্গে আনব না। ব্যবসা-বাণিজ্য পড়ে থাকবে, আমি তোমার কাছে শুধু আমাকেই নিয়ে যাব। তিনদিন আমরা অনন্ত ভালোবাসার মধ্যে একসঙ্গে থাকব। পরস্পরকে বুঝতে পারব। কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করতে পারবে না। ২০ তারিখের পরে অ্যানি ডে তুমি ডাক দিলে আমি তোমার কাছে আসব। খুলনার বাসে উঠে বাসস্ট্যান্ডে নামব। তারপর সোজা তোমার কাছে চলে যাব। ওখান থেকে তুমি আমাকে সি অফ করে নিয়ে আসবে। তারপর তুমি আর আমি। আমি বাসস্ট্যান্ডে এসে তোমাকে মোবাইল করব। অনেক সময় হয়ে গেল। বাদ দাও। আমার মোবাইলে ব্যালেন্স সিস্টেম নেই। আচ্ছা পরে আবার করবে। ঠিক আছে। তোমার সুন্দরী ভাবীকে বইল তাকে ভালোবাসা জানিয়েছি। ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনসডের উইশ করি নাই। তোমার ভাবীকে উইশ করলাম। তোমাকে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনভর উইশ করব। এতক্ষণ ভালো থাক আমার হৃদয়, আমার ভালোবাসা।’ টেলিফোনের ও পাশের মেয়েটির বয়স কিংবা শিক্ষা কিছুই অনুমান করা গেল না। শুধুই মনে হলো মোবাইল ফোনে সম্ভবত এক সর্বনাশের পথে সে পা বাড়িয়েছে।
ফুটনোট
এক বন্ধু আবৃত্তি করছে, ‘আমি তোমার যাত্রী দলে রইব পিছে/স্থান দিও হে আমায় তুমি সবার নিচে/সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব/ তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধূসর হোক।’ কবিতার ছত্রগুলো শুনে তার সঙ্গী বন্ধু মন্তব্য করলেন ‘ভোজসভায় সবার শেষে থাকে শুধু শূন্য হাঁড়িপাতিল আর এঁটো থালা-বাসন। শালা মরেছো।’
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.