বিনায়কের দণ্ডাদেশ-আইনের অপব্যবহার by অমর্ত্য সেন
বিনায়ক সেনের বিরুদ্ধে ছত্তিশগড় আদালতের রায়ে আমি অত্যন্ত বিচলিত। আমাদের বিচারব্যবস্থা, বিশেষত রাষ্ট্রদ্রোহের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ন্যায়পথ থেকে বিরাট বিচ্যুতি। এ কথা বলছি কয়েকটি কারণে। প্রথমত, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে মাওবাদীদের কাছে কিছু চিঠি পৌঁছে দেওয়ার।
অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে কি না, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়।
দ্বিতীয়ত, যদি তা প্রমাণিতও হয়, তবু তা রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে না। কাউকে তিনি হত্যা করেননি। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবাদ কিংবা বিদ্রোহেও কাউকে উসকানি দেননি। আসলে আমরা তো জানি, বিনায়ক তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগ্রামে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি মনে করেছেন, সেই পথ যেমন ঠিক নয়, তেমনি শেষ পর্যন্ত সফলও হয় না। সুতরাং আমি মনে করি, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সত্যিই যদি তা হয়েও থাকে (যদিও তা একেবারেই স্পষ্ট নয়), তবু তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ টেকে না।
তৃতীয়ত, যেকোনো বিচারকার্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তির চরিত্রকে বিবেচনায় নিতে হয়। বিনায়ক সেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষের কল্যাণে কঠোর কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। চিকিৎসক হিসেবে সচ্ছল ও সফল জীবনযাপন আর অর্থকড়ি কামানোর পথ ছেড়ে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন অবহেলিত মানুষের সেবায়। তাই, তাঁর প্রতিজ্ঞা ও একাগ্রতার ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই।
বিনায়কের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মূলে একটি চিঠি হস্তান্তরের কথা এসেছে। যেখানে সাধারণভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ বলতে বোঝায়, সাধারণ মানুষকে বলপ্রয়োগে উসকানি প্রদান কিংবা সহিংসতা ঘটিয়ে অন্যদেরও তাতে যোগ দিতে আহ্বান জানানো। বিনায়কের ক্ষেত্রে এর কোনোটাই ঘটেনি। সবকিছু ছেড়ে এসে নিবেদিতচিত্তে অবহেলিত মানুষের সেবায় নিয়োজিত এক ব্যক্তি যদি নেহাত চিঠি হস্তান্তরের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের দণ্ড পান, তখন তো গণতান্ত্রিক ভারতের আইনকেই হাস্যাস্পদ করে তোলা হয়।
দণ্ডাদেশের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার অংশ। মনে রাখতে হবে, এটি আসলে বিনায়ক সেনকে কারাগারে আটক রাখতে অতি উৎসাহী ছত্তিশগড় রাজ্যের আইনি প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়। এখানেই আইনি প্রক্রিয়া থেমে যাবে না। ছত্তিশগড়ের উচ্চ আদালত যদি পক্ষপাতহীন ও খোলা মনে সিদ্ধান্ত নেন, তবে এই আদেশ বদলে যাবে। তবে যদি ছত্তিশগড়েও গুজরাটের মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়, যেখানে জনগণকে ন্যায়বিচারের চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের সমস্যাজনক রাজনৈতিক নীতির ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে তাদের অধীনে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি কঠিন করে তোলে, তাহলে সে পরিস্থিতিতে বিনায়কের মামলাটি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টেই মীমাংসা হতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট বারবার প্রমাণ করেছে, সব মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি এটি অত্যন্ত দায়বদ্ধ। আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি, ছত্তিশগড়ের রায় যদি আমাদের জন্য পুরোপুরি সন্তোষজনক নাও হয়, তবু সুপ্রিম কোর্ট আমাদের অসন্তুষ্ট করবে না। সুতরাং আইনি ব্যবস্থাকে খারিজ করে দেওয়ার কথা আমি একদমই বলছি না। তবে যে কারণে সচেতন নাগরিকেরা মনে করছেন ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় ঘটেছে, তা প্রচারিত হওয়া দরকার। আদালতের পাশাপাশি জনগণেরও তা জানা দরকার। বিনায়কের দণ্ডাদেশ আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে, আমি মর্মাহত হয়েছি, অন্যায় আচরণ করা হয়েছে বলে বোধ হচ্ছে।
যেকোনো মানুষের অপমানকে রবীন্দ্রনাথ নিজেরও অপমান হিসেবে নিয়েছিলেন। বিনায়কের দণ্ডাদেশে আমার মনে হয়েছে, আমাকেও অপমান করা হয়েছে। বিনায়ক সেনের নামের সঙ্গে আমার নামের মিল থাকলেও আমরা রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় নই। আবার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তিনি আমার অনাত্মীয় নন। এমনিভাবে তিনি ভারতের কোটি কোটি মানুষেরও আত্মীয়। আর বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তিনি আত্মীয় সারা দুনিয়ায় বহু মানুষের, বিশেষত দুনিয়াব্যাপী যারা তাঁরই মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইরত।
ভারতের কলকাতাভিত্তিক দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অমর্ত্য সেন: নোবেলজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ।
দ্বিতীয়ত, যদি তা প্রমাণিতও হয়, তবু তা রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে না। কাউকে তিনি হত্যা করেননি। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবাদ কিংবা বিদ্রোহেও কাউকে উসকানি দেননি। আসলে আমরা তো জানি, বিনায়ক তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগ্রামে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি মনে করেছেন, সেই পথ যেমন ঠিক নয়, তেমনি শেষ পর্যন্ত সফলও হয় না। সুতরাং আমি মনে করি, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সত্যিই যদি তা হয়েও থাকে (যদিও তা একেবারেই স্পষ্ট নয়), তবু তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ টেকে না।
তৃতীয়ত, যেকোনো বিচারকার্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তির চরিত্রকে বিবেচনায় নিতে হয়। বিনায়ক সেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষের কল্যাণে কঠোর কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। চিকিৎসক হিসেবে সচ্ছল ও সফল জীবনযাপন আর অর্থকড়ি কামানোর পথ ছেড়ে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন অবহেলিত মানুষের সেবায়। তাই, তাঁর প্রতিজ্ঞা ও একাগ্রতার ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই।
বিনায়কের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মূলে একটি চিঠি হস্তান্তরের কথা এসেছে। যেখানে সাধারণভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ বলতে বোঝায়, সাধারণ মানুষকে বলপ্রয়োগে উসকানি প্রদান কিংবা সহিংসতা ঘটিয়ে অন্যদেরও তাতে যোগ দিতে আহ্বান জানানো। বিনায়কের ক্ষেত্রে এর কোনোটাই ঘটেনি। সবকিছু ছেড়ে এসে নিবেদিতচিত্তে অবহেলিত মানুষের সেবায় নিয়োজিত এক ব্যক্তি যদি নেহাত চিঠি হস্তান্তরের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের দণ্ড পান, তখন তো গণতান্ত্রিক ভারতের আইনকেই হাস্যাস্পদ করে তোলা হয়।
দণ্ডাদেশের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার অংশ। মনে রাখতে হবে, এটি আসলে বিনায়ক সেনকে কারাগারে আটক রাখতে অতি উৎসাহী ছত্তিশগড় রাজ্যের আইনি প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়। এখানেই আইনি প্রক্রিয়া থেমে যাবে না। ছত্তিশগড়ের উচ্চ আদালত যদি পক্ষপাতহীন ও খোলা মনে সিদ্ধান্ত নেন, তবে এই আদেশ বদলে যাবে। তবে যদি ছত্তিশগড়েও গুজরাটের মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়, যেখানে জনগণকে ন্যায়বিচারের চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের সমস্যাজনক রাজনৈতিক নীতির ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে তাদের অধীনে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি কঠিন করে তোলে, তাহলে সে পরিস্থিতিতে বিনায়কের মামলাটি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টেই মীমাংসা হতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট বারবার প্রমাণ করেছে, সব মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি এটি অত্যন্ত দায়বদ্ধ। আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি, ছত্তিশগড়ের রায় যদি আমাদের জন্য পুরোপুরি সন্তোষজনক নাও হয়, তবু সুপ্রিম কোর্ট আমাদের অসন্তুষ্ট করবে না। সুতরাং আইনি ব্যবস্থাকে খারিজ করে দেওয়ার কথা আমি একদমই বলছি না। তবে যে কারণে সচেতন নাগরিকেরা মনে করছেন ন্যায়বিচারের ব্যত্যয় ঘটেছে, তা প্রচারিত হওয়া দরকার। আদালতের পাশাপাশি জনগণেরও তা জানা দরকার। বিনায়কের দণ্ডাদেশ আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে, আমি মর্মাহত হয়েছি, অন্যায় আচরণ করা হয়েছে বলে বোধ হচ্ছে।
যেকোনো মানুষের অপমানকে রবীন্দ্রনাথ নিজেরও অপমান হিসেবে নিয়েছিলেন। বিনায়কের দণ্ডাদেশে আমার মনে হয়েছে, আমাকেও অপমান করা হয়েছে। বিনায়ক সেনের নামের সঙ্গে আমার নামের মিল থাকলেও আমরা রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় নই। আবার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তিনি আমার অনাত্মীয় নন। এমনিভাবে তিনি ভারতের কোটি কোটি মানুষেরও আত্মীয়। আর বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তিনি আত্মীয় সারা দুনিয়ায় বহু মানুষের, বিশেষত দুনিয়াব্যাপী যারা তাঁরই মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইরত।
ভারতের কলকাতাভিত্তিক দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অমর্ত্য সেন: নোবেলজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ।
No comments