রাজনীতি-আল কায়দা এবং হিযবুত তাহ্রীর by সুভাষ সাহা
গণতন্ত্র, আধুনিক সরকার ব্যবস্থা, বিদ্যমান পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে হিযবুত তাহ্রীর পরিত্যাজ্য ও ইসলামবিরোধী ঘোষণা করায় এটি মূলত আধুনিক সভ্যতাবিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিকশিত হতে হলে হিযবুত তাহ্রীরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর
থাকে কি? আড্ডার আলোচনায় শেষ পর্যন্ত উপস্থিত সবাই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা এবং এর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন
হিযবুত তাহ্রীর নামের নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠনটির কর্মকাণ্ড নিয়ে এক আড্ডায় কথা উঠেছিল। সংগঠনটিকে আদৌ নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল কি-না এবং এটি আদৌ আমাদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি কি-না, এসব নিয়েও আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার ধরন দেখে মনে হয়েছিল, উপস্থিত অনেকেই হিযবুত তাহ্রীরের আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তেমন অবগত নন। একজন বললেন, হোক না ইসলামী আদর্শ, তাই বলে এভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকলে এদেরই কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত জঙ্গিবাদকেই নিজেদের লক্ষ্য হাসিলের শেষ উপায় বলে বিবেচনা করতে পারে। সেই থেকে এ সংগঠনটি সম্পর্কে আমার ঔৎসুক্য বেড়ে যায়। কীভাবে সংগঠনটি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো, তা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। তদুপরি অন্য ইসলামী সংগঠনের মতো এটিরও উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্য (জেরুজালেম, ১৯৫৩ সাল) হলেও এর বিস্তার যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্ভব হওয়াটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার হুজিসহ চারটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলেও হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। তখনও পর্যন্ত এটি আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ এমনকি ইসলামী দেশগুলোর জন্য হুমকির কারণ হয়ে ওঠেনি। তাই ২০০০ সালে এটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় নির্বিবাদে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোসহ বেশ কয়েকটি দেশে এদের কর্মকাণ্ড সেসব দেশের সরকারের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ সরকারেরও টনক নড়ে। শুরু হয় এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ। দেখা যায়, এরা সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে দ্রুত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হচ্ছে। যেহেতু তারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তব্য নিয়ে হাজির হয় এবং ইসলামী খেলাফত কায়েমের মাধ্যমে বিশ্বকে অবিশ্বাসীদের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য ব্যক্ত করে, তাই মুসলিম শিক্ষিত যুবমানসে এর প্রভাব পড়ে। তাদের আন্দোলনটা খোলাখুলি শান্তিপূর্ণ বিধায় এ ধরনের আন্দোলনে যোগ দিলে বড় কোনো বিপদে পড়তে হবে না, এটা মনে করেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকে এর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। কিন্তু সংগঠনটি পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর পাকিস্তানকে তাদের লক্ষ্য হাসিলের কৌশলগত স্থান হিসেবে বিবেচনা করার পর থেকে এদের সস্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী পাকিস্তানে ইসলামী হুকুমত কায়েম করে এ দেশটিকে তাদের বিশ্বব্যাপী খেলাফত কায়েমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভিত্তিদেশ হিসেবে ব্যবহারের ইচ্ছা তারা আর গোপন রাখতে পারেনি। তদুপরি সভা, সমাবেশ, সেমিনার, মিছিল, পুস্তিকা প্রকাশ, ব্যক্তিপর্যায়ে আলোচনার মতো শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের আদর্শ ও বক্তব্যে মনুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেও সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের উস্কানি দিয়ে এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রধান স্তম্ভকেই হেলিয়ে দিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্যের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছে। এ উদ্দেশ্যটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত কর্মকর্তা রিত্রুক্রট করার প্রক্রিয়া থেকেই টের পাওয়া যায়। হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ব্রিগেডিয়ার আলীকে গত মে মাসে গ্রেফতার করে সে দেশের সেনা কর্তৃপক্ষ। আরও চার মেজরকেও এটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও ইসলামী ও জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ এসেছিল।
অনেকেরই মনে থাকার কথা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় জেনারেল মোশাররফ যখন ভারত সফর করে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন ও বিদ্যমান কাশ্মীর সমস্যাসহ সব অমীমাংসিত বিষয় সমাধানের উদ্যোগ নেন, তখন এ হিযবুত তাহ্রীর তাকে ভারতের দালাল ও ইসলামের দুশমন বলে অভিহিত করেছিল। তার বিরুদ্ধে ক্যু করার জন্যও তারা সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল, যেসব সরকার সাম্রাজ্যবাদের দালাল এবং যারা তাদের হুকুমে ইসলামবিরোধী কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করা ন্যায়সঙ্গত। এভাবেই তারা বস্তুত ভায়োলেন্ট পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে জায়েজ করেছিল। তারা মুসলমান অধ্যুষিত কোনো দেশ দখল প্রতিহত করাকেও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এভাবেই এরা বস্তুত জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের পার্থক্যের রেখাটা যে একেবারেই অস্পষ্ট, তা প্রমাণ করেছিল।
বাংলাদেশেও সংগঠনটি মধ্যবিত্তদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছিল। মধ্যবিত্ত এমনকি বিত্তবানদের কারও কারও সমর্থন এদের প্রতি ছিল এবং এখনও আছে বলেই ২০০৯ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ করার পরও সরকার এদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। লক্ষ্য করুন, এ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। সংগঠনের সেকেন্ড ম্যান অধ্যাপক কাজী মোরশেদুল হক একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া সময়ে সময়ে বেশকিছু সক্রিয় সদস্যও গ্রেফতার হয়েছে। এর পরও সংগঠনটির কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকছে।
অন্যান্য ইসলামী ও জঙ্গি সংগঠনের মতো হিযবুত তাহ্রীর আগাগোড়াই আওয়ামী লীগবিরোধী ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের ক্ষমতাসীন হওয়াটা তাদের নাপছন্দ ছিল। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে এরা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বলে প্রচারপত্র বিলি করেছিল। তখনই এটাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটি সেনাবাহিনীর মধ্যে সরকার সম্পর্কে বিশেষ করে শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। আসলে এরা বিডিআর বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজেদের আদর্শ প্রচার ও যোগসূত্র গড়ে তোলার সুযোগ খুঁজছিল। এখানে প্রকাশিত গত কয়েক দিনের পত্রিকার পাতা ওল্টালেই এরা যে বিভেদাত্মক উদ্দেশ্য সাধনে কিছুটা সফল হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সংগঠনটি ১৮ পৃষ্ঠার এক প্যাম্ফলেটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করেছিল। তারা ভারতের কাছে দেশ বিক্রির দায়ে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিল। সুতরাং সংগঠনটির উদ্দেশ্য যে কেবল শান্তিপূর্ণ উপায়ে আদর্শ প্রচার নয়, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্যু বা অন্য কোনো উপায়ে তাদের ভাষায় বিদেশি এজেন্ট ও ইসলামের শত্রু সরকারকে উৎখাত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে হিযবুত তাহ্রীর ও আল কায়দার মধ্যে গঠনগত ও কৌশলগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। আল কায়দা যেভাবে প্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য সহিংস পদ্ধতিকেই উপযুক্ত মাধ্যম বলে বিবেচনা করে, তারা কিন্তু তা করে না। তারা সহিংসতার পর্বটি নির্দিষ্ট দেশের সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত করার পক্ষপাতী। সে কারণেই সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকাংশ সদস্যকে তারা তাদের শরিয়াহভিত্তিক খেলাফতের আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে চায়। আর এ কারণেই সরকারগুলোর চোখ-কান খাড়া হয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর মধ্যে হিযবুত তাহ্রীরের যে কোনো সংযোগকে বিপজ্জক তালিকায় রেখেছে। আল কায়দা নেতৃত্বে আরবদের রাখার পক্ষপাতী। হিযবুত তাহ্রীরও যে কোনো দেশের নাগরিককে তাদের নেতৃত্বে বরণ করে নিতে দ্বিধা করে না। পাকিস্তানকে হিযবুত তাহ্রীর খেলাফত প্রতিষ্ঠার ভিত্তিস্থান বলে বিবেচনা করলেও আল কায়দা কিন্তু আরবকে এর উর্বর ক্ষেত্র বলে মনে করে। আরবি যেহেতু কোরআনের ভাষা, আরবেই যেহেতু ইসলাম প্রথম প্রতিষ্ঠা পায় এবং যেহেতু এখান থেকেই ইসলাম সারাবিশ্বে একসময় বিস্তার লাভ করেছিল, তাই আরবই ইসলামী খেলাফতের ভবিষ্যৎ ভিত্তি হবে বলে আল কায়দা মনে করে। আরব সংস্কৃতিকেই তারা ইসলামী সংস্কৃতি বলে প্রমাণ করতে চায়। তারা পাকিস্তানকে শুধু ব্যবহার করতে চায় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। হিযবুত তাহ্রীর কিন্তু তা মনে করে না।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানি স্কলাররা নব্বইয়ের দিকে দলে দলে পাকিস্তানে এসে হিযবুত তাহ্রীর গড়ে তোলার চেষ্টা চালায় এবং তারাই শেষ পর্যন্ত সংগঠনটির নেতৃত্বে চলে আসে। বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণীর ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে তাদের আদর্শ বিস্তারের মোক্ষম কারণ সম্ভবত সংগঠনে অনারবদের গুরুত্ব দেওয়া পশ্চিমা শিক্ষিত মুসলমানদের একটি অংশের এর প্রতি সমর্থন।
যেহেতু পাকিস্তানকেই হিযবুত তাহ্রীর তাদের প্রধান কর্ম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং যেহেতু নেতাদের অনেকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ও আমেরিকান, তাই বাংলাদেশে এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনুধাবন করতে হলে পাকিস্তান, ইউরোপ ও আমেরিকায় এদের যোগসূত্র খুঁজতে হবে।
গণতন্ত্র, আধুনিক সরকার ব্যবস্থা, বিদ্যমান পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে হিযবুত তাহ্রীর পরিত্যাজ্য ও ইসলামবিরোধী ঘোষণা করায় এটি মূলত আধুনিক সভ্যতাবিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিকশিত হতে হলে হিযবুত তাহ্রীরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে কি?
আড্ডার আলোচনায় শেষ পর্যন্ত উপস্থিত সবাই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা এবং এর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
হিযবুত তাহ্রীর নামের নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠনটির কর্মকাণ্ড নিয়ে এক আড্ডায় কথা উঠেছিল। সংগঠনটিকে আদৌ নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল কি-না এবং এটি আদৌ আমাদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি কি-না, এসব নিয়েও আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার ধরন দেখে মনে হয়েছিল, উপস্থিত অনেকেই হিযবুত তাহ্রীরের আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তেমন অবগত নন। একজন বললেন, হোক না ইসলামী আদর্শ, তাই বলে এভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকলে এদেরই কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত জঙ্গিবাদকেই নিজেদের লক্ষ্য হাসিলের শেষ উপায় বলে বিবেচনা করতে পারে। সেই থেকে এ সংগঠনটি সম্পর্কে আমার ঔৎসুক্য বেড়ে যায়। কীভাবে সংগঠনটি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো, তা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। তদুপরি অন্য ইসলামী সংগঠনের মতো এটিরও উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্য (জেরুজালেম, ১৯৫৩ সাল) হলেও এর বিস্তার যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্ভব হওয়াটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার হুজিসহ চারটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলেও হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। তখনও পর্যন্ত এটি আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ এমনকি ইসলামী দেশগুলোর জন্য হুমকির কারণ হয়ে ওঠেনি। তাই ২০০০ সালে এটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় নির্বিবাদে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোসহ বেশ কয়েকটি দেশে এদের কর্মকাণ্ড সেসব দেশের সরকারের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ সরকারেরও টনক নড়ে। শুরু হয় এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ। দেখা যায়, এরা সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে দ্রুত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হচ্ছে। যেহেতু তারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তব্য নিয়ে হাজির হয় এবং ইসলামী খেলাফত কায়েমের মাধ্যমে বিশ্বকে অবিশ্বাসীদের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য ব্যক্ত করে, তাই মুসলিম শিক্ষিত যুবমানসে এর প্রভাব পড়ে। তাদের আন্দোলনটা খোলাখুলি শান্তিপূর্ণ বিধায় এ ধরনের আন্দোলনে যোগ দিলে বড় কোনো বিপদে পড়তে হবে না, এটা মনে করেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকে এর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। কিন্তু সংগঠনটি পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর পাকিস্তানকে তাদের লক্ষ্য হাসিলের কৌশলগত স্থান হিসেবে বিবেচনা করার পর থেকে এদের সস্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী পাকিস্তানে ইসলামী হুকুমত কায়েম করে এ দেশটিকে তাদের বিশ্বব্যাপী খেলাফত কায়েমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভিত্তিদেশ হিসেবে ব্যবহারের ইচ্ছা তারা আর গোপন রাখতে পারেনি। তদুপরি সভা, সমাবেশ, সেমিনার, মিছিল, পুস্তিকা প্রকাশ, ব্যক্তিপর্যায়ে আলোচনার মতো শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের আদর্শ ও বক্তব্যে মনুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেও সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের উস্কানি দিয়ে এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রধান স্তম্ভকেই হেলিয়ে দিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্যের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছে। এ উদ্দেশ্যটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত কর্মকর্তা রিত্রুক্রট করার প্রক্রিয়া থেকেই টের পাওয়া যায়। হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ব্রিগেডিয়ার আলীকে গত মে মাসে গ্রেফতার করে সে দেশের সেনা কর্তৃপক্ষ। আরও চার মেজরকেও এটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও ইসলামী ও জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ এসেছিল।
অনেকেরই মনে থাকার কথা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় জেনারেল মোশাররফ যখন ভারত সফর করে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন ও বিদ্যমান কাশ্মীর সমস্যাসহ সব অমীমাংসিত বিষয় সমাধানের উদ্যোগ নেন, তখন এ হিযবুত তাহ্রীর তাকে ভারতের দালাল ও ইসলামের দুশমন বলে অভিহিত করেছিল। তার বিরুদ্ধে ক্যু করার জন্যও তারা সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল, যেসব সরকার সাম্রাজ্যবাদের দালাল এবং যারা তাদের হুকুমে ইসলামবিরোধী কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করা ন্যায়সঙ্গত। এভাবেই তারা বস্তুত ভায়োলেন্ট পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে জায়েজ করেছিল। তারা মুসলমান অধ্যুষিত কোনো দেশ দখল প্রতিহত করাকেও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এভাবেই এরা বস্তুত জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের পার্থক্যের রেখাটা যে একেবারেই অস্পষ্ট, তা প্রমাণ করেছিল।
বাংলাদেশেও সংগঠনটি মধ্যবিত্তদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছিল। মধ্যবিত্ত এমনকি বিত্তবানদের কারও কারও সমর্থন এদের প্রতি ছিল এবং এখনও আছে বলেই ২০০৯ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ করার পরও সরকার এদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। লক্ষ্য করুন, এ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। সংগঠনের সেকেন্ড ম্যান অধ্যাপক কাজী মোরশেদুল হক একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া সময়ে সময়ে বেশকিছু সক্রিয় সদস্যও গ্রেফতার হয়েছে। এর পরও সংগঠনটির কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকছে।
অন্যান্য ইসলামী ও জঙ্গি সংগঠনের মতো হিযবুত তাহ্রীর আগাগোড়াই আওয়ামী লীগবিরোধী ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের ক্ষমতাসীন হওয়াটা তাদের নাপছন্দ ছিল। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে এরা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বলে প্রচারপত্র বিলি করেছিল। তখনই এটাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটি সেনাবাহিনীর মধ্যে সরকার সম্পর্কে বিশেষ করে শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। আসলে এরা বিডিআর বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজেদের আদর্শ প্রচার ও যোগসূত্র গড়ে তোলার সুযোগ খুঁজছিল। এখানে প্রকাশিত গত কয়েক দিনের পত্রিকার পাতা ওল্টালেই এরা যে বিভেদাত্মক উদ্দেশ্য সাধনে কিছুটা সফল হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সংগঠনটি ১৮ পৃষ্ঠার এক প্যাম্ফলেটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করেছিল। তারা ভারতের কাছে দেশ বিক্রির দায়ে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিল। সুতরাং সংগঠনটির উদ্দেশ্য যে কেবল শান্তিপূর্ণ উপায়ে আদর্শ প্রচার নয়, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্যু বা অন্য কোনো উপায়ে তাদের ভাষায় বিদেশি এজেন্ট ও ইসলামের শত্রু সরকারকে উৎখাত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে হিযবুত তাহ্রীর ও আল কায়দার মধ্যে গঠনগত ও কৌশলগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। আল কায়দা যেভাবে প্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য সহিংস পদ্ধতিকেই উপযুক্ত মাধ্যম বলে বিবেচনা করে, তারা কিন্তু তা করে না। তারা সহিংসতার পর্বটি নির্দিষ্ট দেশের সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত করার পক্ষপাতী। সে কারণেই সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকাংশ সদস্যকে তারা তাদের শরিয়াহভিত্তিক খেলাফতের আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে চায়। আর এ কারণেই সরকারগুলোর চোখ-কান খাড়া হয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর মধ্যে হিযবুত তাহ্রীরের যে কোনো সংযোগকে বিপজ্জক তালিকায় রেখেছে। আল কায়দা নেতৃত্বে আরবদের রাখার পক্ষপাতী। হিযবুত তাহ্রীরও যে কোনো দেশের নাগরিককে তাদের নেতৃত্বে বরণ করে নিতে দ্বিধা করে না। পাকিস্তানকে হিযবুত তাহ্রীর খেলাফত প্রতিষ্ঠার ভিত্তিস্থান বলে বিবেচনা করলেও আল কায়দা কিন্তু আরবকে এর উর্বর ক্ষেত্র বলে মনে করে। আরবি যেহেতু কোরআনের ভাষা, আরবেই যেহেতু ইসলাম প্রথম প্রতিষ্ঠা পায় এবং যেহেতু এখান থেকেই ইসলাম সারাবিশ্বে একসময় বিস্তার লাভ করেছিল, তাই আরবই ইসলামী খেলাফতের ভবিষ্যৎ ভিত্তি হবে বলে আল কায়দা মনে করে। আরব সংস্কৃতিকেই তারা ইসলামী সংস্কৃতি বলে প্রমাণ করতে চায়। তারা পাকিস্তানকে শুধু ব্যবহার করতে চায় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। হিযবুত তাহ্রীর কিন্তু তা মনে করে না।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানি স্কলাররা নব্বইয়ের দিকে দলে দলে পাকিস্তানে এসে হিযবুত তাহ্রীর গড়ে তোলার চেষ্টা চালায় এবং তারাই শেষ পর্যন্ত সংগঠনটির নেতৃত্বে চলে আসে। বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণীর ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে তাদের আদর্শ বিস্তারের মোক্ষম কারণ সম্ভবত সংগঠনে অনারবদের গুরুত্ব দেওয়া পশ্চিমা শিক্ষিত মুসলমানদের একটি অংশের এর প্রতি সমর্থন।
যেহেতু পাকিস্তানকেই হিযবুত তাহ্রীর তাদের প্রধান কর্ম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং যেহেতু নেতাদের অনেকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ও আমেরিকান, তাই বাংলাদেশে এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনুধাবন করতে হলে পাকিস্তান, ইউরোপ ও আমেরিকায় এদের যোগসূত্র খুঁজতে হবে।
গণতন্ত্র, আধুনিক সরকার ব্যবস্থা, বিদ্যমান পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে হিযবুত তাহ্রীর পরিত্যাজ্য ও ইসলামবিরোধী ঘোষণা করায় এটি মূলত আধুনিক সভ্যতাবিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিকশিত হতে হলে হিযবুত তাহ্রীরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে কি?
আড্ডার আলোচনায় শেষ পর্যন্ত উপস্থিত সবাই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা এবং এর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
.......আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে......
ReplyDeleteVai, Bangladesh aadhunik rashtro naki???
Tahole, USA, GB, Germany, France oigula ki?
Bangladesh to 3rd world er 1 desh.
Accha vai, Western deshguloke 1st world, Middle east er deshguloke 2nd world r Amader ei deshguloke 3rd world bola hoy keno?