বিপন্ন শৈশব-জীবন তাহাদের নয় by ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদকের লেখা হূদয় কাঁপানো খবর: ‘শিশুদের পঙ্গু করে নামানো হচ্ছে ভিক্ষায়’। শিরোনামের পরই লেখা, ‘আট-নয় বছরের এক শিশুকে জড়সড় করে আটকে রাখা হয়েছিল অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলের ভেতর। টানা ছয় মাস। খাবার বলতে দিনে একবার সামান্য ভাত অথবা রুটি আর পানি।’
প্রতিবেদক আরও জেনেছেন, ‘শরীফ নামের এক বালককে কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধে নিয়ে হাতের কবজি কেটে পঙ্গু করে দেয়...রিকশাচালক উমেদ আলীর ছেলে নিয়ামুলকে ব্লেড দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে গলা ও বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে...।’ এভাবে পঙ্গু করে তাদের ভাড়া দেওয়া হয় ভিক্ষার জন্য। টাকার ভাগ চলে যায় তাদের মালিকদের কাছে। পঙ্গু ভিক্ষুক আর তাদের মালিকদের জীবন চলতে থাকে যার যার মতো। চলতে থাকে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার।
তুলার মতো নরম শরীর নিয়ে জন্মায় সব শিশু। স্বচ্ছ চোখ, নরম হাড়, ধুকপুক করা দুর্বল হূৎপিণ্ডের এক প্রাণপাখি যেন। পাখির মতো সবই দুর্বল তার, কিন্তু পাখির ডানা ঝাপটানির মতো কী শক্তিশালী তার বাঁঁচার ইচ্ছা। প্রকৃতি তার ভেতরে এই ইচ্ছাটি দিয়েছে বলেই এই শীত-গরমের দুনিয়ায়, এই ভেজাল আর জীবাণুর পরিবেশে, এই নিষ্ঠুর জগতের মধ্যেও তারা বেঁচে থাকতে চায়, বড় হতে চায়। যত বড় হয়, ততই বাড়ে ডানা ঝাপটানো স্বাধীনতার ইচ্ছা। বড় হওয়া মানে কেবল গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠা নয়, বড় হওয়া মানে গাছের মতো মাটিতে শেকড় রেখে ওপরের দিকে উঠতে থাকা—নিজের পায়ে নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে শেখা। কিন্তু সবাই সেই সুযোগ পায় না।
এই প্রথম আলোতেই খবর ছাপা হয়েছিল, নৌকা নেই বলে গ্রামের গরিব শিশুরা পাতিলে ভেসে খাল পার হচ্ছে। এখন পড়লাম, এসব আদরের পাখিদের অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে দিনের পর দিন আটকে রাখার খবর। ওইটুকু পাতিলের মধ্যে সে ডানা ঝাপটায়, হাত-পা ছুড়তে চায়। পারে না। কিন্তু বড় হতে থাকে, আর বাঁচতে শেখে পশুর মতো। কিন্তু তার শরীরের ভেতর কোষে কোষে চলে প্রতিবাদ। তারা বড় হতে চায়, অথচ ঠেকে যায় পাতিলের ভেতরের দিকের দেয়ালে। ঘষা খেয়ে কড়া পড়ে চামড়ায়। ওপরের দিকে বাড়তে পারে না বলে তখন পাশের দিকে বাড়ার চেষ্টা করে। বাড়ে কিছুটা, কিন্তু বেঁকে যায়। এভাবে আঁকাবাঁকা এক জগদ্দল মাংসপিণ্ড হয়ে উঠলেই সে যোগ্য হয়ে ওঠে। পাতিল কেটে তাকে বের করা হয়। তারপর বসিয়ে দেওয়া হয় ‘পৃথিবীর পথে’। সে তখন আস্ত এক উপার্জনকারী ভিক্ষুক। পাতিলের জগৎ থেকে সে মুক্তি পেয়ে গেছে বটে, কিন্তু খোলা দুনিয়াটা তত দিনে তার জন্য হয়ে গেছে আরেকটা পাতিল; যেখানে সে নড়তে-চড়তে পারে না, বাড়তে পারে না, স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু আর জাগে না মনে। রাস্তাঘাটে আমরা তাদের পেরিয়ে যাই, দু-এক টাকা ভিক্ষা দিয়ে অস্বস্তি থেকে বাঁচি।
সব শিশুরই তুলার মতো শরীর, কিন্তু তুলার বিছানা সবাই পায় না। কেউ বেড়ে ওঠে আদরে আর আলো-হাওয়ায়, কেউ কেউ বেড়ে ওঠে ফুটপাতে। কংক্রিটের ভবনের ফাটলেও যেমন গাছ জন্মে, তেমনই সমাজ-অর্থনীতির ফাটলে এদের জন্ম হয়। যিশুর জন্ম হয়েছিল গোয়ালঘরে, মৃত্যু হয়েছিল ক্রুশে। আমাদের ফুটপাতে, বস্তিতে এ রকম অজস্র যিশুই জন্মায়; হয়তো তাদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ হতো মহান ও মহীয়সী। কিন্তু তাদের জীবন কেটে যায় সভ্যতার বাইরে, প্রায় প্রাণীর দশায়। পার্থক্য কেবল একটাই—এরা কথা বলতে পারে, প্রাণীরা পারে না। যিশুর মতোই কষ্টের জীবনের শূলকাঠে তাদের আমৃত্যু লটকে থাকতে হয়, যতক্ষণ না খাটতে খাটতে রক্ত পানি হয়ে যায়, যতক্ষণ না জীবনীশক্তি ফুরায়। হাতে-পায়ে পেরেক বেঁধা যিশু যন্ত্রণা সইতে না পেরে এক মুহূর্তে বলে উঠেছিলেন, ‘Eloi Eloi lama sabachthani’ ‘হে ঈশ্বর, তুমি কি আমায় পরিত্যাগ করেছ?’ এরা তা-ও বলতে পারে না। এসব শিশুরও তাই মনে হতে পারে, যা কিছু ভালো, তা আমাদের জন্য নয়। জীবন আমাদের নয়, আমাদের জন্য রয়েছে পাতিলবন্দী দাসজীবন।
সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার চলতে থাকে। কারও কোনো অসুবিধা হয় না। তারপর কোনো একদিন কোনো বুদ্ধিমান প্রযোজক বলিউডে বা হলিউডে টাকা খাটাতে আসেন। কোনো দক্ষ চলচ্চিত্র পরিচালক এদের গল্প নিয়ে তৈরি করেন কোনো স্লামডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমা। রাতারাতি হলগুলো ভরে যায় দর্শকে। সবাই দেখে আর চোখের পানি ফেলে। চলচ্চিত্রকার পুরস্কৃত হন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভাগ্য খুলে যায়, ভদ্রলোকদের বিবেকে হালকা কাঁপুনি আসে, ভালো মানুষেরা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। জীবন চলে যায়, ওই স্লামডগদের ভাগ্য আর ফেরে না। সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার চলতে থাকে। বছর শেষ হয়, দুঃখ শেষ হয় না।
উপকূলে বিশাল বিশাল চর। হারিয়ে যাওয়া, চুরি হয়ে যাওয়া শিশুদের সেখানে নৌকাভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের জন্য তৈরি হয় দাসশিবির। সেখানে তাদের মালিকেরা তাদের কিছুটা খাইয়ে অনেকটা খাটিয়ে মাছ শুকানোর কাজে ব্যবহার করে। কারও ঠাঁই হয় উত্তাল সমুদ্রে খোলামকুচির মতো নৌকায়। চরের আড়ত থেকে মাছ চলে যায় বিদেশে বা রাজধানীর বড় বড় বাড়ি বা হোটেলের ডাইনিং টেবিলে। আমাদের কেউ কেউ তা খেয়ে যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, তখন হয়তো ঝড়ের সতর্কসংকেতের মধ্যেও সেসব দাসশিশু সমুদ্রে জাল ফেলে চলেছে। ঝড়ের সময় ভয়ে কিংবা দাসজীবনের হতাশায় তারাও কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির মতো করে বলে, ‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে, এই কেতুপুরে তারে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ কেতুপুর ছিল দরিদ্র জেলেপল্লি, যাদের বেশির ভাগই ছিল মহাজনের শ্রমদাস।
বালকেরা কাজ করে চলেছে আয়ু ক্ষয় করা কারখানায়, গেরস্ত বাড়িতে। এসবই আমাদের চেনাজানা। তাদের জীবনের খবর কমই পাই, কেবল মৃত্যুর খবরে জানতে পারি, তারাও মানুষ ছিল। গণমাধ্যম বিপুল সমারোহে জানায়, কোথায় কে কর্মস্থলে ‘দুর্ঘটনায়’ মারা গেছে, কার শরীর গরম পানিতে ঝলসে দেওয়া হয়েছে, কাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে ছাদ থেকে, কাকে দিনের পর দিন গেরস্ত-প্রভু ধর্ষণ করে গেছেন। প্রাচীন গ্রিসের দুর্ধর্ষ স্পার্টা নগরের রীতি ছিল, ছেলেশিশুদের মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো। সেখানে তাদের যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা হতো। আর দুর্বল শিশুদের ফেলে দেওয়া হতো পাহাড়ের কিনার থেকে অথবা বানানো হতো দাস। তারপর অনেক দিন গেল। হাজার কোটিবার পৃথিবী ঘুরল সূর্যের চারপাশে। কত রাজা-মহারাজার সোনালি শাসন শেষ হলো, তবু প্রাগৈতিহাসিক তেলাপোকার মতো টিকে রইল সেই দাসপ্রথা। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন,‘এখনও নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরাল!’ এখনো জীবন মানে দুঃখ, কত যুগবিপ্লব পেরোল!
পাঠক, এগুলো চরম ঘটনা। সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবারের বাইরের ঘটনা। কেরানীগঞ্জের যে ক্লাবঘরে ওই শিশুদের পঙ্গু বানানো হতো, সেই ক্লাবঘরে যে এসব চলত, তার খবর রাষ্ট্র-পুলিশ-গণমাধ্যম হয়তো এত দিন জানত না। কিন্তু ওই ক্লাবঘরটা তো আইনের আওতার মধ্যে, সমাজপতি-রাষ্ট্রপতিদের শাসনের এখতিয়ারে। যে সন্ত্রাসীরা ওই ক্লাবঘর চালাত, কিংবা যে জেলে-মহাজনের দায়িত্বে জেলেদাস তৈরি হতো, তাদের কায়কারবার তো রাষ্ট্রের ভেতরেই। থানা-পুলিশকে খুশি না রেখে, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া যে দেশে ক্লাব চালানো তো দূরের কথা, একটা খুঁটিও পোঁতা যায় না, সেখানে এই শিশুদের পরিণতির দায়ভার কি সমাজ-রাষ্ট্রকে নিতে হবে না? উচ্ছেদের তাড়ার মধ্যে দৌড়ানো শিশুরা, ফুটপাতে পথিকের জুতায় বাড়ি খাওয়া শিশুরা, কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির বন্ধ কাচে মুখ ঠেকিয়ে যারা ভিক্ষা চায়, ফুল কিনতে সাধে, তারা কি তাদের নিজেদের দোষেই অমন? আর কারও কোনো দায়িত্ব নেই? স্কুল আর প্লেয়িং গ্রাউন্ডে সচ্ছল ঝলমলে শিশুরা শুধু, কালো হাড্ডিসার শিশুরা কেন ফুটপাতে? কারও মাথার ওপরে কেন সাত-সাতটি আকাশ, আর কারও জীবন কেন আটকে থাকে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে? প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একবার কথাচ্ছলে বলেছিলেন, বস্তির শিশু আর ফ্ল্যাটবাড়ির শিশুর বুদ্ধির বিকাশ পরস্পরের বিপরীত। বস্তির ওরা ছোটবেলায় বেশ চটপটে, চৌকস থাকে, কিন্তু বড় হতে হতে, মার খেতে খেতে ভোঁতা হয়ে যায়। আর সচ্ছল শিশুরা ছোটবেলায় পানিটি পর্যন্ত ঢেলে খেতে না পারলেও শিক্ষা আর সুবিধায় দিনে দিনে স্মার্ট আর দক্ষ হয়ে ওঠে। দোষটা জন্মের নয়, সামাজিক পরিবেশের।
সন্ত্রাসী চক্রের শারীরিক পঙ্গু করার একটি চক্র ধরা পড়েছে, কিন্তু যারা আর্থিক-মানসিকভাবে পঙ্গু হতে হতে বড় হচ্ছে, তারা কোন চক্রের হাতে বন্দী? সেই চক্র কি কোনো দিন ধরা পড়বে না? তাদের বছরই কি পেরোবে শুধু, দুঃখ ফুরাবে না?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
তুলার মতো নরম শরীর নিয়ে জন্মায় সব শিশু। স্বচ্ছ চোখ, নরম হাড়, ধুকপুক করা দুর্বল হূৎপিণ্ডের এক প্রাণপাখি যেন। পাখির মতো সবই দুর্বল তার, কিন্তু পাখির ডানা ঝাপটানির মতো কী শক্তিশালী তার বাঁঁচার ইচ্ছা। প্রকৃতি তার ভেতরে এই ইচ্ছাটি দিয়েছে বলেই এই শীত-গরমের দুনিয়ায়, এই ভেজাল আর জীবাণুর পরিবেশে, এই নিষ্ঠুর জগতের মধ্যেও তারা বেঁচে থাকতে চায়, বড় হতে চায়। যত বড় হয়, ততই বাড়ে ডানা ঝাপটানো স্বাধীনতার ইচ্ছা। বড় হওয়া মানে কেবল গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠা নয়, বড় হওয়া মানে গাছের মতো মাটিতে শেকড় রেখে ওপরের দিকে উঠতে থাকা—নিজের পায়ে নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে শেখা। কিন্তু সবাই সেই সুযোগ পায় না।
এই প্রথম আলোতেই খবর ছাপা হয়েছিল, নৌকা নেই বলে গ্রামের গরিব শিশুরা পাতিলে ভেসে খাল পার হচ্ছে। এখন পড়লাম, এসব আদরের পাখিদের অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে দিনের পর দিন আটকে রাখার খবর। ওইটুকু পাতিলের মধ্যে সে ডানা ঝাপটায়, হাত-পা ছুড়তে চায়। পারে না। কিন্তু বড় হতে থাকে, আর বাঁচতে শেখে পশুর মতো। কিন্তু তার শরীরের ভেতর কোষে কোষে চলে প্রতিবাদ। তারা বড় হতে চায়, অথচ ঠেকে যায় পাতিলের ভেতরের দিকের দেয়ালে। ঘষা খেয়ে কড়া পড়ে চামড়ায়। ওপরের দিকে বাড়তে পারে না বলে তখন পাশের দিকে বাড়ার চেষ্টা করে। বাড়ে কিছুটা, কিন্তু বেঁকে যায়। এভাবে আঁকাবাঁকা এক জগদ্দল মাংসপিণ্ড হয়ে উঠলেই সে যোগ্য হয়ে ওঠে। পাতিল কেটে তাকে বের করা হয়। তারপর বসিয়ে দেওয়া হয় ‘পৃথিবীর পথে’। সে তখন আস্ত এক উপার্জনকারী ভিক্ষুক। পাতিলের জগৎ থেকে সে মুক্তি পেয়ে গেছে বটে, কিন্তু খোলা দুনিয়াটা তত দিনে তার জন্য হয়ে গেছে আরেকটা পাতিল; যেখানে সে নড়তে-চড়তে পারে না, বাড়তে পারে না, স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু আর জাগে না মনে। রাস্তাঘাটে আমরা তাদের পেরিয়ে যাই, দু-এক টাকা ভিক্ষা দিয়ে অস্বস্তি থেকে বাঁচি।
সব শিশুরই তুলার মতো শরীর, কিন্তু তুলার বিছানা সবাই পায় না। কেউ বেড়ে ওঠে আদরে আর আলো-হাওয়ায়, কেউ কেউ বেড়ে ওঠে ফুটপাতে। কংক্রিটের ভবনের ফাটলেও যেমন গাছ জন্মে, তেমনই সমাজ-অর্থনীতির ফাটলে এদের জন্ম হয়। যিশুর জন্ম হয়েছিল গোয়ালঘরে, মৃত্যু হয়েছিল ক্রুশে। আমাদের ফুটপাতে, বস্তিতে এ রকম অজস্র যিশুই জন্মায়; হয়তো তাদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ হতো মহান ও মহীয়সী। কিন্তু তাদের জীবন কেটে যায় সভ্যতার বাইরে, প্রায় প্রাণীর দশায়। পার্থক্য কেবল একটাই—এরা কথা বলতে পারে, প্রাণীরা পারে না। যিশুর মতোই কষ্টের জীবনের শূলকাঠে তাদের আমৃত্যু লটকে থাকতে হয়, যতক্ষণ না খাটতে খাটতে রক্ত পানি হয়ে যায়, যতক্ষণ না জীবনীশক্তি ফুরায়। হাতে-পায়ে পেরেক বেঁধা যিশু যন্ত্রণা সইতে না পেরে এক মুহূর্তে বলে উঠেছিলেন, ‘Eloi Eloi lama sabachthani’ ‘হে ঈশ্বর, তুমি কি আমায় পরিত্যাগ করেছ?’ এরা তা-ও বলতে পারে না। এসব শিশুরও তাই মনে হতে পারে, যা কিছু ভালো, তা আমাদের জন্য নয়। জীবন আমাদের নয়, আমাদের জন্য রয়েছে পাতিলবন্দী দাসজীবন।
সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার চলতে থাকে। কারও কোনো অসুবিধা হয় না। তারপর কোনো একদিন কোনো বুদ্ধিমান প্রযোজক বলিউডে বা হলিউডে টাকা খাটাতে আসেন। কোনো দক্ষ চলচ্চিত্র পরিচালক এদের গল্প নিয়ে তৈরি করেন কোনো স্লামডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমা। রাতারাতি হলগুলো ভরে যায় দর্শকে। সবাই দেখে আর চোখের পানি ফেলে। চলচ্চিত্রকার পুরস্কৃত হন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভাগ্য খুলে যায়, ভদ্রলোকদের বিবেকে হালকা কাঁপুনি আসে, ভালো মানুষেরা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। জীবন চলে যায়, ওই স্লামডগদের ভাগ্য আর ফেরে না। সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার চলতে থাকে। বছর শেষ হয়, দুঃখ শেষ হয় না।
উপকূলে বিশাল বিশাল চর। হারিয়ে যাওয়া, চুরি হয়ে যাওয়া শিশুদের সেখানে নৌকাভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের জন্য তৈরি হয় দাসশিবির। সেখানে তাদের মালিকেরা তাদের কিছুটা খাইয়ে অনেকটা খাটিয়ে মাছ শুকানোর কাজে ব্যবহার করে। কারও ঠাঁই হয় উত্তাল সমুদ্রে খোলামকুচির মতো নৌকায়। চরের আড়ত থেকে মাছ চলে যায় বিদেশে বা রাজধানীর বড় বড় বাড়ি বা হোটেলের ডাইনিং টেবিলে। আমাদের কেউ কেউ তা খেয়ে যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, তখন হয়তো ঝড়ের সতর্কসংকেতের মধ্যেও সেসব দাসশিশু সমুদ্রে জাল ফেলে চলেছে। ঝড়ের সময় ভয়ে কিংবা দাসজীবনের হতাশায় তারাও কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির মতো করে বলে, ‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে, এই কেতুপুরে তারে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ কেতুপুর ছিল দরিদ্র জেলেপল্লি, যাদের বেশির ভাগই ছিল মহাজনের শ্রমদাস।
বালকেরা কাজ করে চলেছে আয়ু ক্ষয় করা কারখানায়, গেরস্ত বাড়িতে। এসবই আমাদের চেনাজানা। তাদের জীবনের খবর কমই পাই, কেবল মৃত্যুর খবরে জানতে পারি, তারাও মানুষ ছিল। গণমাধ্যম বিপুল সমারোহে জানায়, কোথায় কে কর্মস্থলে ‘দুর্ঘটনায়’ মারা গেছে, কার শরীর গরম পানিতে ঝলসে দেওয়া হয়েছে, কাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে ছাদ থেকে, কাকে দিনের পর দিন গেরস্ত-প্রভু ধর্ষণ করে গেছেন। প্রাচীন গ্রিসের দুর্ধর্ষ স্পার্টা নগরের রীতি ছিল, ছেলেশিশুদের মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো। সেখানে তাদের যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা হতো। আর দুর্বল শিশুদের ফেলে দেওয়া হতো পাহাড়ের কিনার থেকে অথবা বানানো হতো দাস। তারপর অনেক দিন গেল। হাজার কোটিবার পৃথিবী ঘুরল সূর্যের চারপাশে। কত রাজা-মহারাজার সোনালি শাসন শেষ হলো, তবু প্রাগৈতিহাসিক তেলাপোকার মতো টিকে রইল সেই দাসপ্রথা। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন,‘এখনও নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরাল!’ এখনো জীবন মানে দুঃখ, কত যুগবিপ্লব পেরোল!
পাঠক, এগুলো চরম ঘটনা। সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবারের বাইরের ঘটনা। কেরানীগঞ্জের যে ক্লাবঘরে ওই শিশুদের পঙ্গু বানানো হতো, সেই ক্লাবঘরে যে এসব চলত, তার খবর রাষ্ট্র-পুলিশ-গণমাধ্যম হয়তো এত দিন জানত না। কিন্তু ওই ক্লাবঘরটা তো আইনের আওতার মধ্যে, সমাজপতি-রাষ্ট্রপতিদের শাসনের এখতিয়ারে। যে সন্ত্রাসীরা ওই ক্লাবঘর চালাত, কিংবা যে জেলে-মহাজনের দায়িত্বে জেলেদাস তৈরি হতো, তাদের কায়কারবার তো রাষ্ট্রের ভেতরেই। থানা-পুলিশকে খুশি না রেখে, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া যে দেশে ক্লাব চালানো তো দূরের কথা, একটা খুঁটিও পোঁতা যায় না, সেখানে এই শিশুদের পরিণতির দায়ভার কি সমাজ-রাষ্ট্রকে নিতে হবে না? উচ্ছেদের তাড়ার মধ্যে দৌড়ানো শিশুরা, ফুটপাতে পথিকের জুতায় বাড়ি খাওয়া শিশুরা, কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির বন্ধ কাচে মুখ ঠেকিয়ে যারা ভিক্ষা চায়, ফুল কিনতে সাধে, তারা কি তাদের নিজেদের দোষেই অমন? আর কারও কোনো দায়িত্ব নেই? স্কুল আর প্লেয়িং গ্রাউন্ডে সচ্ছল ঝলমলে শিশুরা শুধু, কালো হাড্ডিসার শিশুরা কেন ফুটপাতে? কারও মাথার ওপরে কেন সাত-সাতটি আকাশ, আর কারও জীবন কেন আটকে থাকে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে? প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একবার কথাচ্ছলে বলেছিলেন, বস্তির শিশু আর ফ্ল্যাটবাড়ির শিশুর বুদ্ধির বিকাশ পরস্পরের বিপরীত। বস্তির ওরা ছোটবেলায় বেশ চটপটে, চৌকস থাকে, কিন্তু বড় হতে হতে, মার খেতে খেতে ভোঁতা হয়ে যায়। আর সচ্ছল শিশুরা ছোটবেলায় পানিটি পর্যন্ত ঢেলে খেতে না পারলেও শিক্ষা আর সুবিধায় দিনে দিনে স্মার্ট আর দক্ষ হয়ে ওঠে। দোষটা জন্মের নয়, সামাজিক পরিবেশের।
সন্ত্রাসী চক্রের শারীরিক পঙ্গু করার একটি চক্র ধরা পড়েছে, কিন্তু যারা আর্থিক-মানসিকভাবে পঙ্গু হতে হতে বড় হচ্ছে, তারা কোন চক্রের হাতে বন্দী? সেই চক্র কি কোনো দিন ধরা পড়বে না? তাদের বছরই কি পেরোবে শুধু, দুঃখ ফুরাবে না?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments