ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান-জবাব না দেওয়ার সংস্কৃতি by উম্মে মুসলিমা

বছর পাঁচেক আগে প্রথম আলোয় ‘তালি ও বাঙালি’ শিরোনামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। তালি দিতে বা প্রশংসা করতে আমরা বাঙালিরা অতিশয় ব্যয়কুণ্ঠ। লেখাটার সঙ্গে অনেকেই একমত পোষণ করলেও স্বভাব খুব একটা বদলেছে, বলা যাবে না।


কারণ, এখনো কোনো অনুষ্ঠানে প্রশংসা প্রদানের সময় এলে ঘোষকের ঘোষণা ব্যতিরেকে স্বতঃস্ফূর্ত তালি আমাদের হাতে খেলে না, যদিও ‘বদলে যাও বদলে দাও’ স্লোগান নিয়ে প্রথম আলোর অব্যাহত পথচলায় আমরা কম-বেশি সহযোগী হতে সচেষ্ট, তবু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলোর জন্য আমাদের আরও আন্তরিক হওয়ার প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, ব্যক্তিপর্যায়ে অহিতকর আচার-আচরণ-স্বভাব-দৃষ্টিভঙ্গি-চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে পারলেই না আমরা বদলে যেতে পারব। পরিবর্তনে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা অবশ্যই ভেতরে ভেতরে বদলাচ্ছেন। আর যাঁদের বদলানোর প্রয়োজন নেই, তাঁরা বদলে দিতে এগিয়ে আসছেন। তো, ছোট্ট একটা পরিবর্তনের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার ইচ্ছা। সেটা হচ্ছে জবাব বা রেসপন্স না করার স্বভাব পরিবর্তনের।
আমরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে গেলে অন্য দেশের লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হয় বা অন্য দেশের কেউ দেশে এলে আমাদের স্বভাবসুলভ আতিথেয়তায় তারা মুগ্ধ হয়। আমাদের স্বভাব এখনো শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই হতদরিদ্র গৃহস্বামীর মতো, যারা নিজের শেষ সম্বলটুকু বাঁধা রেখেও অতিথি আপ্যায়ন করি। অতিথি আপ্লুত হয়, তাদের দেশে ফিরে গিয়ে তারা চিঠিপত্রে (ইদানীং ই-মেইল, টেলিফোন) যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে, তুলে নিয়ে যাওয়া ফটো পাঠায়, আমরা বড়জোর প্রথম চিঠিটার জবাব দিই, তারপর চিরকালের মতো নিশ্চুপ। কেউ কেউ আদৌ কোনো জবাবই দিই না। তারা বারবার যোগাযোগ করে হতাশ হয়ে একসময় থেমে যায়। এক অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ২০০০ সালের পর ২০০৯ সালে আবার আমেরিকায় কনফারেন্সে যোগদান করে ফিরে এসে সহকর্মীদের কাছে ভারি কৌতুকের সঙ্গে গল্প করছিলেন এ রকম, এবারের কনফারেন্সেও যোগদান করা সেই ২০০০ সালের খুব বন্ধু হয়ে যাওয়া এক আমেরিকান তাঁকে দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। তাঁদের উচ্চপদস্থ তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, হঠাৎ এ মরা কান্না কেন? কিছুক্ষণ পর নাক-মুখ মুছে আমেরিকান বললেন যে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ সিডরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ কর্মকর্তা গল্পের সময় সেই সহমর্মী আমেরিকানকে ‘নাদান’ সম্বোধন করে হাসতে হাসতে বললেন, সিডরের পরপর অবশ্য তাঁর কাছ থেকে একটা চিঠি তিনি পেয়েছিলেন। জবাব না দেওয়ার কারণেই ওই হূদয়বিদারক অবস্থার অবতারণা।
আমরা হরহামেশাই বিয়ের কার্ড পাই। আমন্ত্রণপত্রের নিচে ‘অপারগতায়’ শব্দের পাশে ফোন নম্বর দেওয়া থাকে। আমরা অপারগতায় বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান করতে না পারলেও কখনো সেই নম্বরে টেলিফোন করে জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি না। ওদিকে নিমন্ত্রণকারীর হাঁড়ি হাঁড়ি খাবার অপচয় হয়। টাকাপয়সার শ্রাদ্ধ তো আছেই। আবার এমনও দেখা গেছে, যাঁরা বিয়েতে যেতে পারেননি, তাঁদের বাড়ি হাঁড়িসুদ্ধ খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন নিমন্ত্রণকারী। তার জন্য তিনি ধন্যবাদও পাননি, যথাসময়ে হাঁড়িও ফেরত পাননি। হাঁড়ি আনতে যখন নিজের লোক পাঠালেন, দেখা গেল, সে হাঁড়ি তত দিন পর্যন্ত আধোয়া অবস্থায় পড়ে আছে।
একবার এক উঠতি লেখক প্রসিদ্ধ এক ম্যাগাজিনে একটা লেখা পাঠিয়ে তিন মাস অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন প্রকাশিত হচ্ছে না, তখন লেখাটা দ্বিতীয় অন্য পত্রিকায় পাঠালেন। দুর্ভাগ্যবশত কদিন পর একই দিনে ওই একই লেখা দুটি পত্রিকাতেই ছাপা হলো। লেখক লজ্জায় একশেষ। দুটি পত্রিকার সম্পাদক টেলিফোনে জানালেন, ‘এটা ঠিক হয়নি আপনার।’ লেখক বিষয়টা খুলে বললেন। দ্বিতীয় পত্রিকার সম্পাদক এমন নাখোশ হলেন যে তিনি তার পর থেকে লেখকের আর কোনো লেখাই ছাপেন না। ভাগ্যিস, প্রথম সম্পাদক ব্যাপারটা ভুলে গেছেন। অথচ ওই হতভাগা লেখক নাকি শুরুর দিকে ভারতের দেশ পত্রিকায় ডাকে একটা গল্প পাঠিয়েছিলেন। স্বয়ং সাগরময় ঘোষ অপারগতা প্রকাশ করে কদিন পরই তাঁকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, গল্পটা ভালো, কিন্তু ভাষার গাঁথুনি আরও মজবুত হতে হবে। অথচ ‘আপনার কবিতাখানি পেলুম’ বলে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসুসহ পরবর্তী সময়ে আরও অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিক-সম্পাদক উত্তরসূরি নামকরা কবির অজস্র পত্রের জবাব দিয়েছেন; আমরা পড়ি।
আগেকার দিনে অবশ্য বাবুরা চাকরদের ‘জবাব’ দিতেন। তবে সে তাৎক্ষণিক জবাবে বেচারা চাকরদের পরিণাম কী হতো, তা বলাই বাহুল্য। আজকাল একটা জবাবের অপেক্ষায় চাকরিপ্রার্থীরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন। চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেন। কিন্তু তারপর আর কোনো খবর নেই! যে প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানে ধরণা দিতে গেলে দারোয়ানেরা পর্যন্ত বড় সাহেব বনে যান। কবে কার্ড ছাড়বে, কবে নিয়োগ-পরীক্ষা—এসবের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। তারপর বছর-দুই বছর পর একদিন হয়তো পরীক্ষার প্রবেশপত্র হাতে আসে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকা শহরে এসে নাখোশ আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, নোটিশ বোর্ডে পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনের নোটিশ। আরও ১০ দিন পর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীকে বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার আসতে হয়। ঢাকা শহরে থাকা, আসা-যাওয়ার খরচ, ঝামেলা—এসবের কোনো ধারই ধারে না কর্তৃপক্ষ। সময়মতো সবকিছু জানিয়ে দিলে এই ঝক্কি ও ব্যয় নির্বাহ থেকে সাধারণ দরিদ্র প্রার্থীর কত বড় উপকার হয়, তা অনুধাবনের সময় নেই বড় বড় কর্তাব্যক্তির। আর ভালো পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পাওয়া?—এ কাদের কপালে আছে, তা-ও অনেকেই জানেন। কম্পিউটার-ইন্টারনেটের সুবিধা এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। বর্তমান সরকার প্রতিটি ইউনিয়ন কাউন্সিলে কম্পিউটার প্রদানসহ ইন্টারনেট সংযোগের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান সময়মতো আবেদনপত্র, পরীক্ষা ও তারিখ পরিবর্তনের তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানিয়ে দিলে প্রার্থীদের হয়রানি ও খরচ কমে এবং কার্যক্রমে গতি আসে। বিশ্ব যখন গোলকায়নে ঘূর্ণমান, আমরা তখনো তথ্য জানার গোলকধাঁধায় আটকে আছি। কেবল এই আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে বসে থাকলেই কাজ হবে না; জবাব দেওয়ার স্বভাবও আয়ত্ত করতে হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘তথ্য জানা ও পাওয়া আপনার মৌলিক অধিকার। তথ্য অধিকার আইন অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা তথ্য প্রদানে বাধ্য। আরও জানতে দেখুন: www.infocom.gov.bd’ বলে গ্রামীণফোনে এসএমএসের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়েছে। আমরা আশাবাদী, এতে আমাদের মধ্যে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.