মহাস্থানগড়-প্রত্ননিদর্শনের ধ্বংস চলতেই থাকবে?

২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোসহ দেশের অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রভাবশালী মহলের উসকানিতে মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থলে হামলা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস এবং তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর ভাষিক ও শারীরিক হামলার খবর পড়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হয়েছি।


গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে এখানে প্রত্ননিদর্শন ধ্বংসের ঘটনা ঘটছে। সর্বোচ্চ আদালতের যথাযথ নির্দেশনা ও প্রশংসনীয় ভূমিকার পরও মোতায়েন করা পুলিশ ও র্যাবের সামনে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল, তা আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মহাস্থানগড় শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরদুর্গ প্রত্নস্থান। দুর্গপ্রাচীর এবং র্যামপার্ট দ্বারা পরিবেষ্টিত প্রধান নগরদুর্গের চারপাশে ১০০টিরও বেশি ঢিবি আকৃতির বিক্ষিপ্ত প্রত্নস্থান রয়েছে। একে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির প্রাচীন রাজধানী পুণ্ড্রনগর হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এই প্রত্নস্থানের বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু উৎখনন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এখানে আদি ঐতিহাসিক সময়কাল থেকে ঔপনিবেশিক সময়কাল পর্যন্ত ধারাবাহিক বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে প্রকাশিত বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ দল কর্তৃক উৎখনন কার্যক্রমের প্রতিবেদনের প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরায়ণ এবং কার্বন ১৪ তারিখের সমন্বয়ে এই অঞ্চলের প্রাচীনতম সময়কাল নির্দেশিত হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতক অর্থাৎ এই স্থানের বয়স প্রায় দুই হাজার তিন শ থেকে চার শ বছর।
দক্ষিণ প্রতিরক্ষাপ্রাচীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পীর সুলতান মাহী সাওয়ারের মাজার রয়েছে। প্রতিবছর এই প্রত্নস্থান, প্রত্নস্থান জাদুঘর ও মাজার হাজারো মানুষকে আকৃষ্ট করে। বৈশাখ মাসব্যাপী এই অঞ্চলে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়।
বহুতল ভবন নির্মাণের নামে মহাস্থানগড়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় ২০১০ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে। সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৃণমূলের কর্মকর্তাদের সাহসী তৎপরতায় ফাউন্ডেশন ট্রেঞ্চ খনন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংসের খবর প্রকাশ পেয়েছিল। আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা, ভূমি অধিগ্রহণে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ না করা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থের কারণে এই ধ্বংস বন্ধ হচ্ছে না। প্রচলিত অ্যানটিকুইটি অ্যাক্টের সীমাবদ্ধতা এবং সেই আইনের যুগোপযোগীকরণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের তৎপরতার অভাবও এ জন্য দায়ী।
২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর হিউম্যান রাইটস অব পিস ইন বাংলাদেশের বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে মর্মে হাইকোর্টে রিট পিটিশন পেশ করেন। হাইকোর্ট তাৎক্ষণিকভাবে নির্মাণকাজের নামে এই ধ্বংস কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন। ঘটনা তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি কর্মসৃজন প্রকল্পের অধীনে রাস্তা নির্মাণের নামে ‘নিতাই ধাপানির পাট’ নামে অপর একটি প্রত্নঢিবি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একই হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনরায় স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের দুজনসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। বেঞ্চ পুনরায় ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন এবং মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে প্রত্নস্থান সংরক্ষণে তাদের ব্যর্থতার কারণ জানতে চান।
রাতের আঁধারে পুনরায় নির্মাণ-কার্যক্রমের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্টের আগের রায় মোতাবেক মহাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতার জন্য বগুড়ার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও মাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মমতাজউদ্দীনকে কারণ দর্শানোর জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন এবং পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করার নির্দেশ জারি করেন। ওই দিন হাইকোর্ট রায় পালনে ব্যর্থ হওয়ায় জেলা কমিশনার, পুলিশ সুপার এবং মাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতিকে কোর্টে তলব করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত পুরো ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে ভর্ৎসনা করেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতিসচিবের নেতৃত্বে একটি দল মহাস্থানগড় পরিদর্শনে যায় সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য। প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ওই সভা চলাকালে প্রভাবশালী মহলের প্ররোচনায় এবং ছড়ানো গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মানুষ বিক্ষোভ করে এবং বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ খননের স্থানে হামলা করে।
অন্যদিকে প্রশাসন ও সরকারদলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মহাস্থান জাদুঘরের জিম্মাদারকে বিভিন্ন সময়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছেন, যিনি একজন নারী। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা তাঁকে আক্রমণাত্মক ভাষায় গালাগাল করেন। আমরা তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটায় আমরা আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ। দেশের ঐতিহ্য রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার খেসারত যদি একজন সরকারি কর্মকর্তাকে এভাবে দিতে হয়, তাহলে আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কীভাবে করব?
আমাদের দেশের সংবিধানে জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করছেন, আমরা তাঁদের শাস্তি দাবি করছি। ঘটনার আড়ালের বিষয়াবলি উন্মোচনের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। পূর্ববর্তী তদন্ত কমিটির সব রিপোর্টও মাননীয় আদালত ও জনগণের সামনে প্রকাশ করা হোক। সর্বশেষে, আমরা তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দাবি করছি, যাঁরা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রসমর্থিত ক্ষমতাবানদের ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে দিন যাপন করছেন।
লেখকেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক, গবেষক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.