আরব বিদ্রোহ-গণতন্ত্রের নতুন দিশারি by মাইকেল হার্ট ও আন্তোনিও নেগ্রি

উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকা গণ-অভ্যুত্থান পর্যবেক্ষকদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে। চ্যালেঞ্জটি হলো, এসব ঘটনাকে অতীতের নানা পুনরাবৃত্তি হিসেবে না পাঠ করে বরং মুক্তি ও গণতন্ত্রের নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে দেওয়া অভিনব পরীক্ষা হিসেবে পাঠ করার; যার তাৎপর্য আঞ্চলিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায়।


বাস্তবিকই আমরা আশা করি, চলমান সংগ্রামী ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়ে আরব দুনিয়া আগামী দশকে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, যে ভূমিকা গত দশকে পালন করেছে লাতিন আমেরিকা। অর্থাৎ আর্জেন্টিনা থেকে ভেনেজুয়েলা আর ব্রাজিল থেকে বলিভিয়া যেমন প্রগতিশীল সরকার ও শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের মধ্যকার রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর গবেষণাগার হয়ে উঠেছিল, আগামী দিনে তেমন পরীক্ষার ক্ষেত্র হবে আরব দুনিয়া।
এসব বিদ্রোহ মতাদর্শিক জমিন আবর্জনামুক্ত করার কাজটি প্রত্যক্ষভাবেই করেছে, সভ্যতার সংঘাতের বর্ণবাদী যে তত্ত্ব আরব রাজনীতিকে অতীতমুখী করে রেখেছিল, তা উড়িয়ে দিয়েছে। আরববাসীর সামনে কেবল সেক্যুলার স্বৈরাচারী এবং গোড়া মোল্লাতন্ত্রের কোনো একটাকে বেছে নেওয়ার পথ খোলা কিংবা মুসলমানরা কোনো না কোনোভাবে মুক্তি ও গণতন্ত্রের অনুপযোগী—এমন রাজনৈতিক বাঁধাধরা ছাঁচ ভেঙে দিয়েছে তিউনিস, কায়রো ও বেনগাজির জনতা। এমনকি এসব সংগ্রামকে ‘বিপ্লব’ বলাও মনে হচ্ছে ভুল পথে চালিত করছে এমন সব পর্যবেক্ষকদের, যাঁরা মনে করেন সংগ্রামের ঘটনাপরম্পরা ১৭৮৯ বা ১৯১৭ কিংবা রাজা ও জারের বিরুদ্ধে অতীতে ইউরোপীয়দের আরও কিছু বিদ্রোহের ধারাকেই অনুসরণ করতে হবে।
বেকারত্বকে কেন্দ্র করে প্রজ্বলিত হয়েছে আরবের এসব বিদ্রোহ। আর বিদ্রোহের কেন্দ্রে শিক্ষিত তরুণেরা, যাঁদের পুড়তে হচ্ছে আশাভঙ্গের বেদনায়। লন্ডন বা রোমের তরুণদের সঙ্গে তাঁদের মিল অনেক। যদিও আরব দুনিয়ায় বিদ্রোহের মূল দাবি স্বৈরতন্ত্র ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসান—এই এক দাবির পেছনে আছে কর্মসংস্থান ও জীবনবিষয়ে একগুচ্ছ সামাজিক দাবি-দাওয়া—শুধু নির্ভরতা ও দারিদ্র্যের অবসানই নয়, বুদ্ধিদীপ্ত ও অত্যন্ত সামর্থ্যবান জনগণের হাতে ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব প্রদানের দাবি। জিনে আল আবিদিন বেন আলী ও হোসনি মোবারক কিংবা মুয়াম্মার গাদ্দাফির ক্ষমতাত্যাগ সে পথের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।
বিদ্রোহ যেভাবে সংগঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে গত এক দশকের অধিক কালজুড়ে দুনিয়ার নানা প্রান্তে—সিয়াটল থেকে বুয়েন্স এইরেস ও জেনোয়া এবং বলিভিয়ার কোচাবাম্বা পর্যন্ত নানা বিদ্রোহের। এই সবকটি বিদ্রোহে কাজ করেছে অনুভূমিক এক নেটওয়ার্ক, যার কোনো একক ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। প্রথাগত বিরোধী পক্ষগুলো এই নেটওয়ার্কে শামিল হতে পারে, কিন্তু তারা এটাকে পরিচালনা করতে পারে না। বাইরের পর্যবেক্ষকেরা মিসরীয় বিদ্রোহে শুরু থেকেই একজন নেতার খোঁজ পেতে চেয়েছেন—সেটা মোহামেদ এলবারাদি অথবা গুগলের মার্কেটিং-প্রধান ওয়ায়েল ঘোনিস যেই হোন। তাঁদের ভয়, মুসলিম ব্রাদারহুড অথবা অন্য কোনো গোষ্ঠী হয়তো ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। তাঁরা তো বোঝেন না যে জনতা কোনো কেন্দ্র ছাড়াই নিজেদের সংগঠিত করতে পারে—কোনো নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া কিংবা কোনো প্রথাগত সংগঠনের দ্বারা আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া এই বিদ্রোহের শক্তিকেই ক্রমশ দুর্বল করে দেয়। এসব বিদ্রোহে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক উপকরণ যেমন—ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারের প্রাধান্য বিদ্রোহের সাংগঠনিক কাঠামোর আলামত, কারণ নয়। এগুলো হলো হাতের কাছে থাকা হাতিয়ার কাজে লাগিয়ে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত জনগণের নিজেকে প্রকাশের উপায়।
এসব সংগঠিত নেটওয়ার্কের আন্দোলন যদিও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনুমোদন করে না, তবু তাদের দাবি-দাওয়াকে অবশ্যই সংহত করতে হয়, নতুন ধরনে সমগ্রকে গঠনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যে প্রক্রিয়া বিদ্রোহের সবচেয়ে সক্রিয় অংশকে সাধারণভাবে জনসাধারণের প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করে। আরব তরুণদের গণ-অভ্যুত্থান নিশ্চয়ই প্রচলিত উদারপন্থী সংবিধান পাওয়ার লক্ষ্যে নয়। এমন সংবিধান তো ক্ষমতা বণ্টন ও নিয়মিত নির্বাচনী সক্রিয়তার নিশ্চয়তাই দেয় শুধু। বরং তাদের বিদ্রোহের লক্ষ্য সেই ধরনের গণতন্ত্র, যা নতুন অভিব্যক্তি ও জনতার প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য রাখে। অভীষ্ট গণতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে প্রথমত বাকস্বাধীনতার সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সেটা অধিপতি গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতার প্রচলিত ধরনে নয়। এই গণমাধ্যম তো বরাবরই সরকার ও সম্পদশালী অভিজাতদের দ্বারা কলুষিত হয়। বরং সেই বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতি যা নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত সম্পর্কের সাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে।
বহুবিস্তৃত বেকারত্ব ও দারিদ্র্য শুধু নয়, উৎপাদন ও অভিব্যক্তিগত হতাশার সাধারণ বোধ (বিশেষত তরুণদের মধ্যে) থেকেই আরব গণ-অভ্যুত্থানের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটি র্যাডিকেল সাংবিধানিক প্রতিক্রিয়ার ভেতর অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনার সাধারণ পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। এটাই সেই প্রান্তরেখা, যা অতিক্রম করে যেতে পারবে না নয়া উদারপন্থা; আর পুঁজিবাদ পড়বে প্রশ্নের মুখে। এসব চাহিদা মেটাতে একেবারে অনুপযোগী ইসলামি শাসন। এই জায়গাতেই গণ-অভ্যুত্থান শুধু উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভারসাম্যকেই স্পর্শ করে না, অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের বৈশ্বিক ব্যবস্থাও আর অধরা থাকে না।
সুতরাং আমাদের আশা, আরব দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকা সংগ্রামের ঘটনাচক্র লাতিন আমেরিকার মতো চেহারা নিক, রাজনৈতিক আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগাক, আরবের সীমা ছাড়িয়ে মুক্তি ও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলুক সর্বত্র। প্রতিটি বিদ্রোহই ব্যর্থ হতে পারে; জালিম শাসক রক্তাক্ত দমনপীড়ন চালাতে পারে; সামরিক জান্তা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে মরিয়া হতে পারে; প্রথাগত বিরোধী গোষ্ঠীগুলো আন্দোলন ছিনতাই করার প্রচেষ্টা চালাতে পারে; আর ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদীরা কৌশলে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বিদ্রোহের মধ্যে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার যে প্রকাশ ঘটেছে, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ প্রজন্মের নতুন জীবনের যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে, যে জীবনে তারা নিজের সামর্থ্য কাজে লাগাতে পারবে, সেসব চাওয়া তো মরে না।
যত দিন এসব দাবি-দাওয়া ও আকাঙ্ক্ষা জীবন্ত থাকবে, তত দিন সংগ্রামও চলবে। মুক্তি ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে এসব নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরবর্তী দশকে দুনিয়াবাসীকে কী শিক্ষা দেবে, প্রশ্ন সেটাই।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
মাইকেল হার্ট: যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।
আন্তোনিও নেগ্রি: সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক দার্শনিক।

No comments

Powered by Blogger.