এসো নীপবনে-শীত এবং শারীরিক কসরত by আবুল হায়াত

শীত যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছে, তাতে সারা দেশের রুক্ষ ভাবটাই যেন বদলে গেছে। মানুষ যেন উত্তেজিত হতে ভুলে গেছে শীতের প্রকোপে। বুধবারের পৌর নির্বাচনই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। সবই যেন ঠান্ডা মেরে গেছে। সারা বছর এমন শীত থাকলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। তাই এই শান্তিও চিরস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।


যা-ই হোক, প্রতিবারই শীত আসবে। চাল-চুলোহীন মানুষ কষ্ট পাবে, আরামে লেপ মুড়ি দেবে বাকিরা। এটাই চিরকাল হয়ে থাকে। হবেও।
কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, বিত্তহীনরা বিত্তশালীদের লেপ কেড়ে নিলেই যত বিপত্তি। সে বিপত্তি দেখা না দিলেই ভালো। সে রকম বিপ্লবের ধকল এ দেশ সইতে পারবে না। তবে ক্ষমতাবানেরা দুর্বলদের লেপ কেড়ে নেয়—এটা হরহামেশাই হচ্ছে বৈকি।
সেই কথাটাই মনে পড়ছে আজ।
বুড়োদের শীত যদিও অনুভব হয় বেশি, জোয়ানেরাই কিন্তু লেপ মুড়ি দেওয়াটাকে ভালোবাসে অধিক। সেই বুয়েটে যখন ছাত্র ছিলাম, তখনকার কথাটাই আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে। আমাদের পাঠ্যক্রমে পিটি (শারীরিক কসরত) ছিল বাধ্যতামূলক। আটটি সেমিস্টারের প্রতিটিতে একটি করে কোর্স ছিল পিটির। এবং সেই কোর্সের নম্বর ডিভিশন পেতে যোগ হতো। সুতরাং কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হতো বাধ্য হয়ে।
পিটি ক্লাস হতো সূর্যদেব উদিত হওয়ার আগেই। গ্রীষ্মকালটা তো ভালোই যেত। যত সমস্যা ছিল শীতের সময়। হায়রে কষ্ট। মনে পড়লে গা শিউরে উঠছে আমার। ওই লেপের ওম ছেড়ে কুয়াশার মধ্যে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ছুটতে হতো লাল ভবনের মাঠে। ফুল পার্সেন্টেজ সবার থাকত না পিটি ক্লাসের, তারপর সেমিস্টার শেষে স্যারদের হাতেপায়ে ধরা—নন কলেজিয়েট যাতে না হয়—আহারে, সেই সব দিন!
কিন্তু এখন ভাবছি, হবু ইঞ্জিনিয়ারদের এভাবে কষ্ট দিয়ে পিটি করানোর প্রয়োজন কী? (এখনো হয় কি না জানি না) প্রয়োজন নিশ্চয় ছিল, তা না হলে মাথাওয়ালা মানুষগুলো ছাত্রদের কষ্ট দেবেন কেন। যে মানুষগুলো ভবিষ্যৎ জীবনে দেশ গড়ার কাজে অন্যতম প্রধান ভূমিকা নেবেন, তাঁদের তো নিজেদের শরীর গড়তে হবে আগে, তাই না? শরীর আর মনের সম্পর্ক নিবিড়। সুতরাং মন ভালো রাখতে গেলে শরীর ঠিক রাখা চাই। আর তাই তো শারীরিক কসরত।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েটে যখন পড়তাম, সেই বাধ্যতামূলক জুনিয়র ক্যাডেট কোরে যোগ দিতে হয়েছিল। নবম আর দশম শ্রেণী, এই দুই বছর মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হয়েছে আমাদের। পিটি একটি প্রধান অঙ্গ ছিল জুনিয়র ক্যাডেট কোরের। তখন থেকেই দেশ গড়ার জন্য প্রস্তুতি দেওয়া হয়েছে আমাদের। আসলেই প্রকৌশলী জীবনে বহু প্রতিকূল অবস্থায়, পরিবেশে কাজ করতে হয়েছে। সেগুলো সইবার জন্য শরীরের দৃঢ়তা, তার সঙ্গে মানসিক স্থিতির প্রয়োজন ছিল। এবং ওই সব শিক্ষা সেসব ক্ষেত্রে কাজ দিয়েছে বলে বিশ্বাস করি আমি।
যেমন, লিবিয়াতে চাকরিকালে শীতের সময় অফিসে যেতে হতো সাতটায়। অথচ সূর্য ওঠে বেলা আটটার পরে। ওই সেই লেপের ওম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হতো কাজের জন্য সাইটে। সে সময়ও মনে পড়ে যেত বুয়েটের কথা। পিটির কথা।
আজও খুব করে মনে পড়ছে। কারণ এখন বেলা নয়টা আর বাইরের তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের কোনো খবর নেই। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চতুর্দিক। আর আমি ছুটছি পুবাইলে নাটকের শুটিং করতে। আমি নিশ্চিত যে, পুবাইলে এখন তাপমাত্রা কম করে হলেও ঢাকার চেয়ে ২ ডিগ্রি কম।
কিন্তু ওই যে শিক্ষা। ছাত্রাবস্থার শিক্ষা কেমন কাজে লাগছে বলুন। কিন্তু দেখুন, ছাত্ররা কিন্তু মানতে চায় না সেটা। আমি নিজেও কত বাপান্ত করেছি কর্তৃপক্ষের সেই সময়। আজ বুঝছি, সেটা ভুল ছিল। আমার কন্যারাও বোঝেনি—তারা পিটির দিন এলেই দেখেছি সকাল থেকে খ্যানখ্যান শুরু করত।
‘আব্বু, একটা চিঠি দাও আপাকে।’
‘কেন?’
‘আমার শরীর ভালো না। পিটি করতে পারব না।’
সব সময় যে তাদের আবদার শুনিনি, তা নয়। কখনো কখনো অতিস্নেহের বশে লিখে দিয়েছি দুই লাইন ওদের আপাকে—
‘মেয়ের শরীর পিটির অনুকূলে নয়, রেহাই দেওয়া যেতে পারে।’
ওটা ছিল আমার ভুল। আমার বিশ্বাস, ওরাও একসময় বুঝবে, ভুল ছিল ওদের ওই আবদার করাটা।
সে যা-ই হোক, স্কুলের শিক্ষা তথা ছাত্রজীবনের প্রতিটি শিক্ষাই ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয়। সেটাই ভীষণ কুসময়ে সহায় হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই নব্বইয়ের দশকে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেটা তাদের শিক্ষানীতি হিসেবে স্কুল কমিটির অনুমোদনও পেয়েছিল। ‘টিচিং দেম বাই বিটিং দেম।’ হ্যাঁ, Teaching them by beating them—এই নীতিতে চলছিল স্কুলটি। প্রতিদিন সকালে স্কুলে আসার সঙ্গে সঙ্গে লাইন করে দাঁড় করানো হতো ছাত্রদের। তারপর শুরু হতো পেছনের সারির ছাত্রদের বেতানো। সেটা শেষ হলে বেত তুলে দেওয়া হতো সেই ছাত্রদের হাতে। সেটা দিয়ে তারা বেত মারত তাদের সামনের সারির ছাত্রদের। এভাবেই চলত পুরো প্রক্রিয়াটি। এ কাজ শেষে ক্লাসে যেত ছাত্ররা। সেখানে ভুলত্রুটির জন্য তো ছিলই আরও বেতের বাড়ি।
এ রকম একটা উন্নত দেশের শিক্ষিতজনেরা এমন একটা কাজ করতেন কি এমনি এমনি! নিশ্চয় না। ছাত্রদের ভালোর জন্যই তো। তাঁরা বুঝেছিলেন—মাইরের ওপরে ওষুধ নাই। তাই পিটিয়ে মানুষ করার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ জীবনেও যাতে তারা আপদে-বিপদে পিটুনি সইতে পারে, তার জন্যও প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন ছাত্রদের।
কিন্তু সে দেশেও তো মূর্খের সংখ্যা কম নেই। তাঁরা বাধা দিলেন এমন মহৎ যুগান্তকারী পদ্ধতিতে। এ নিয়ে কোর্ট-কাচারি হলো। আইনি বিচারে স্কুল কর্তৃপক্ষ হেরে গেল। ফলে ছাত্ররা আপাত রেহাই পেলেও ভবিষ্যৎ জীবনে মারপিটের সময় খুবই কষ্টের সম্মুখীন যে হয়েছে বা হবে তাতে আমার সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই পদ্ধতিটাকে খুবই পছন্দ করেছি। এবং বুয়েট, চুয়েট, ডুয়েট যত সব প্রকৌশলী গড়ার কারখানা আছে, তাদের অনুরোধ করছি, আর ভুল করবেন না, পিটি যদি বাদ হয়ে থাকে তবে অনতিবিলম্বে তা পুনর্যোগ করুন এবং ওপরে উল্লিখিত পদ্ধতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করুন—
‘টিচিং দেম বাই বিটিং দেম।’
কার্যক্ষেত্রে এমপি সাহেবদের মার সহ্য করার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.