চারদিক-মুড়ির কারিগর by শারমিন নাহার
বৈশাখ মানেই দিনের বেলা কাঠফাটা রোদ। তবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই কখনো কালবৈশাখীর লীলা। প্রকৃতির এমন বিচিত্র রূপ বুঝি কেবল বৈশাখেই দেখা যায়। বৈশাখের ৫ তারিখ, বিকেল থেকেই বৃষ্টি আর ঝড়। আর বৃষ্টির অনুষঙ্গ হিসেবে মুড়িভর্তা কিন্তু দারুণ! যে-ই ভাবা সে-ই কাজ।
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই একটা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য, পুরান ঢাকার লালবাগের মোড়ের মুড়ির দোকান।
অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, মুড়ির আবার দোকান হয় নাকি?
হুম! অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা। লালবাগের চৌরাস্তা থেকে কিছুটা এগিয়ে পোস্তার দিকে যেতেই দোকানটা। আর দোকান খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগে না। ছোট্ট দোকানের মধ্যে মানুষে ঠাসা, পা রাখারই জায়গা নেই। দোকানের নামটাও চোখে পড়ার মতো—‘নিরাপদ মুড়িভর্তা’। নাম দেখে বোঝা যায়, নিরাপদ খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা থেকেই এমন নাম দেওয়া হয়েছে। মুড়িভর্তার কারিগর দোকানদার মো. নূরুল ইসলামের দম ফেলার ফুরসত নেই। ক্রেতার ফরমায়েশ অনুযায়ী মুড়িভর্তা তৈরি করে দিচ্ছেন এক হাতেই।
এত বড় ভূমিকার পরের গল্পটা এই নূরুল ইসলামকে নিয়েই। তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যেও নূরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে তাঁর জীবনের গল্প।
কত দিন হলো এই কাজ করছেন? ‘তা প্যারায় তিন বছর হইব। তয় এই জায়গায় দোকান দিছি আড়াই বছর।’
অন্য যেকোনো কিছু বাদ দিয়ে মুড়ি বানানোর মতো পেশায় কেন?
এবার মুখে হাসি, ‘একবার মুড়ি খাইতে গেছিলাম, তয় খাইতে পারি নাই। তখন থাইক্যাই ভাবছি, এমন কিছু বানামু, যা আগে কেউ বানায় নাই। ৫০ টেসের মুড়িভর্তা আবিষ্কার করতে টাইম লাগছে দুই বছর। অহন তো পারিই। কাস্টমার কত পদ খাইব?’
আদি বাড়ি বিক্রমপুরে হলেও বর্তমানে আবাস তাঁর দোকান থেকে কিছুদূর এগিয়ে পোস্তায়। এখন সপরিবারে থাকেন এখানে।
বাড়িতে কে কে আছে?
‘আমার বিবি আর তিন পোলা-মাইয়া।’ ততক্ষণে নূরুল ইসলামের সহকারী তাঁর ছেলের সঙ্গে পরিচয়ের পর্ব শেষ। বড় ছেলে মো. শফিক দোকানের মুড়ি বানানোর সালাদ কাটে আর বাবার বানানো মুড়ি ক্রেতাদের হাতে বুঝিয়ে দেয়। নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এইডা বড় পোলা। অয় এবার আইয়ে পরীক্ষা দিতাছে। আর মাইয়া ম্যাট্রিক দিছে। আরেক পোলা কেলাস টুতে পড়ে। অর পরীক্ষা থাকলে দোকানে আহে না। তয় বাকি দিনে আমারে কামে সাহায্য করে। খালি এই পোলাই না, আমার বিবিও আমারে কামে সাহায্য করে। ঘরে মুড়ি বানাইতে মেলা পদের জিনিস লাগে। আগের দিন রাত থেইক্যা ঘুগনি, ঘন মসলা বানায় রাখি।’
এই মুড়িভর্তা করার জন্য দেশি মোটা লাল মুড়ি কোথায় পান?
‘এই মুড়ি ঝালকাঠি থেইক্যা আনি। এই মুড়ি দিয়া ভর্তা বানাইলে টেস লাগে।’
কেবল পুরান ঢাকার বাসিন্দাই নয়, ধানমন্ডি থেকে মুড়িভর্তা খেতে আসা আরিফ রহমান বলেন, এমন ভিন্ন স্বাদের মুড়ি তিনি আগে কখনো খাননি।
মুড়ির স্বাদের মতো নামের আছে বাহার আর দোকানে ঢুকেই নজর পড়ল বাহারি নামের তালিকা। রোজার দিনের মুড়ি, মজাদার মুড়ি, টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদের রকমারি মুড়ি, কাসুন্দি মুড়ি। স্বাদ বাড়াতে আছে নানা শাকিলা পানি আর শাকিলা সস। আর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাবাব তো আছেই। নামের বৈচিত্র্য নিয়ে কারিগর নূরুল ইসলাম বললেন, ‘রোজার দিনের মুড়ির একটা আলাদা টেস আছে। তাই রোজার দিনের টেস দিবার লেইগা রোজার দিনের মুড়ি।’
প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় দোকান খুলে তা চলে ১০টা পর্যন্ত। নূরুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ আমার দোকানের মুড়ি হাউস কইরা খায়, এইডা আমার প্রশান্তি।’ কেবল দোকানেই মুড়ি বিক্রি করেন তা নয়, বিভিন্ন বিয়ে আর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেও ডাক পেলে যান তিনি।
‘মেলা কষ্ট করছি। আমি চাই না, আমার পোলা-মাইয়া এমন কষ্ট করুক। লেখাপড়া শিইখ্যা তারা যেন মানুষ হয়। এমন ছুডু কাম না কইরা বড় চাকরি করব। পোলা-মাইরা মানুষ হইলেই খুশি। আর...।’ এবার থমকে যান তিনি। বলেন, ‘মানুষরে বেবাক টেসের মুড়ি বানায় দিতে চাই।’
শারমিন নাহার
অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, মুড়ির আবার দোকান হয় নাকি?
হুম! অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা। লালবাগের চৌরাস্তা থেকে কিছুটা এগিয়ে পোস্তার দিকে যেতেই দোকানটা। আর দোকান খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগে না। ছোট্ট দোকানের মধ্যে মানুষে ঠাসা, পা রাখারই জায়গা নেই। দোকানের নামটাও চোখে পড়ার মতো—‘নিরাপদ মুড়িভর্তা’। নাম দেখে বোঝা যায়, নিরাপদ খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা থেকেই এমন নাম দেওয়া হয়েছে। মুড়িভর্তার কারিগর দোকানদার মো. নূরুল ইসলামের দম ফেলার ফুরসত নেই। ক্রেতার ফরমায়েশ অনুযায়ী মুড়িভর্তা তৈরি করে দিচ্ছেন এক হাতেই।
এত বড় ভূমিকার পরের গল্পটা এই নূরুল ইসলামকে নিয়েই। তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যেও নূরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে তাঁর জীবনের গল্প।
কত দিন হলো এই কাজ করছেন? ‘তা প্যারায় তিন বছর হইব। তয় এই জায়গায় দোকান দিছি আড়াই বছর।’
অন্য যেকোনো কিছু বাদ দিয়ে মুড়ি বানানোর মতো পেশায় কেন?
এবার মুখে হাসি, ‘একবার মুড়ি খাইতে গেছিলাম, তয় খাইতে পারি নাই। তখন থাইক্যাই ভাবছি, এমন কিছু বানামু, যা আগে কেউ বানায় নাই। ৫০ টেসের মুড়িভর্তা আবিষ্কার করতে টাইম লাগছে দুই বছর। অহন তো পারিই। কাস্টমার কত পদ খাইব?’
আদি বাড়ি বিক্রমপুরে হলেও বর্তমানে আবাস তাঁর দোকান থেকে কিছুদূর এগিয়ে পোস্তায়। এখন সপরিবারে থাকেন এখানে।
বাড়িতে কে কে আছে?
‘আমার বিবি আর তিন পোলা-মাইয়া।’ ততক্ষণে নূরুল ইসলামের সহকারী তাঁর ছেলের সঙ্গে পরিচয়ের পর্ব শেষ। বড় ছেলে মো. শফিক দোকানের মুড়ি বানানোর সালাদ কাটে আর বাবার বানানো মুড়ি ক্রেতাদের হাতে বুঝিয়ে দেয়। নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এইডা বড় পোলা। অয় এবার আইয়ে পরীক্ষা দিতাছে। আর মাইয়া ম্যাট্রিক দিছে। আরেক পোলা কেলাস টুতে পড়ে। অর পরীক্ষা থাকলে দোকানে আহে না। তয় বাকি দিনে আমারে কামে সাহায্য করে। খালি এই পোলাই না, আমার বিবিও আমারে কামে সাহায্য করে। ঘরে মুড়ি বানাইতে মেলা পদের জিনিস লাগে। আগের দিন রাত থেইক্যা ঘুগনি, ঘন মসলা বানায় রাখি।’
এই মুড়িভর্তা করার জন্য দেশি মোটা লাল মুড়ি কোথায় পান?
‘এই মুড়ি ঝালকাঠি থেইক্যা আনি। এই মুড়ি দিয়া ভর্তা বানাইলে টেস লাগে।’
কেবল পুরান ঢাকার বাসিন্দাই নয়, ধানমন্ডি থেকে মুড়িভর্তা খেতে আসা আরিফ রহমান বলেন, এমন ভিন্ন স্বাদের মুড়ি তিনি আগে কখনো খাননি।
মুড়ির স্বাদের মতো নামের আছে বাহার আর দোকানে ঢুকেই নজর পড়ল বাহারি নামের তালিকা। রোজার দিনের মুড়ি, মজাদার মুড়ি, টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদের রকমারি মুড়ি, কাসুন্দি মুড়ি। স্বাদ বাড়াতে আছে নানা শাকিলা পানি আর শাকিলা সস। আর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাবাব তো আছেই। নামের বৈচিত্র্য নিয়ে কারিগর নূরুল ইসলাম বললেন, ‘রোজার দিনের মুড়ির একটা আলাদা টেস আছে। তাই রোজার দিনের টেস দিবার লেইগা রোজার দিনের মুড়ি।’
প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় দোকান খুলে তা চলে ১০টা পর্যন্ত। নূরুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ আমার দোকানের মুড়ি হাউস কইরা খায়, এইডা আমার প্রশান্তি।’ কেবল দোকানেই মুড়ি বিক্রি করেন তা নয়, বিভিন্ন বিয়ে আর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেও ডাক পেলে যান তিনি।
‘মেলা কষ্ট করছি। আমি চাই না, আমার পোলা-মাইয়া এমন কষ্ট করুক। লেখাপড়া শিইখ্যা তারা যেন মানুষ হয়। এমন ছুডু কাম না কইরা বড় চাকরি করব। পোলা-মাইরা মানুষ হইলেই খুশি। আর...।’ এবার থমকে যান তিনি। বলেন, ‘মানুষরে বেবাক টেসের মুড়ি বানায় দিতে চাই।’
শারমিন নাহার
No comments