চৈতন্যের মুক্তবাতায়ন-অনক্ষর প্রাকৃতজনের নিখাদ দেশপ্রেম by যতীন সরকার
আমি মাস্টার- এটিই আমার সামাজিক পরিচয়। মাস্টার পরিচয়েই আমি গর্ববোধ করি। প্রথমে স্কুলে ও পরে কলেজের মাস্টার হই। ৪২ বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাস্টারির কাজে যুক্ত থেকেছি। আর একান্ত আত্মপ্রসাদের সঙ্গেই বলি, মাস্টারি করে প্রচুর সুনাম ও সম্মানও পেয়েছি।
স্কুল বা কলেজের ক্লাসে নয় শুধু, মাস্টারি করেছি বিভিন্ন পাঠচক্রে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা সংগঠনে- এমনকি রাজনৈতিক দলেও। সংস্কৃতি বলতে আমি কী বুঝি, বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ কী, রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক কী- এ রকম নানা প্রশ্ন নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনে যেসব আলোচনা করেছি, সেসবের মধ্যেও আমার মাস্টার পরিচয়টাই সবার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। এই পরিচিতির সুবাদেই বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে আমার সংযুক্তি।
সত্যেন সেন যখন ঢাকার নারিন্দায় উদীচীর পত্তন ঘটান, সেই পাকিস্তানি জমানায়ই ময়মনসিংহ শহরেও এর ঢেউ এসে লাগে, এখানেও উদীচীর শাখা প্রতিষ্ঠায় আমরা কয়েকজন তৎপর হয়ে উঠি। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিল আলোকময় নাহার। তাঁরই উদ্যোগে ওস্তাদ মিথুন দেকে নেতৃপদে বসিয়ে ময়মনসিংহে উদীচীর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। উদীচী যেহেতু একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, তাই এর সদস্যদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার তাগিদ দেখা দেয় এবং এখানেও আমার ওপরই 'মাস্টারি'র দায়িত্ব বর্তায়। বাংলাদেশের অন্য কয়েকটি জেলায় যখন উদীচীর শাখা গড়ে ওঠে, তখন সেসব জেলায়ও আমাকেই 'মাস্টারি' করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে সারা দেশে সংস্কৃতির মাস্টারির সূত্রেই আমার একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উদীচীর সদস্যরা আমাকে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির আসনে বসিয়ে দেন।
রাজনীতির সঙ্গে আমার সংযুক্তির সূত্রও এই মাস্টারিই। প্রশিক্ষণের নামে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে নানা তত্ত্বকথা নিয়ে বকাবাজি করেছি- অর্থাৎ মাস্টারি করেছি। এ রকম মাস্টারি ছাড়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটার তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। অথচ এটুকুর জন্যই আমি কি না 'রাজনীতিক' আর তারই ফলে আমার কারাবাস!
এখানেও তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা আমাকে মাস্টারি করার জন্য ধরে বসল। কারাবন্দি প্রবীণ নেতারাও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। তাই কারাগারে বসেও আমাকে মাস্টারি করতে হলো। এ রকম মাস্টারি করার মধ্য দিয়ে আমার নিজের চেতনায়ও যেমন শাণ দিয়ে যেতে পেরেছিলাম, তেমনি অন্যদের চৈতন্যকেও সজাগ করে তুলতে চেষ্টা করেছিলাম। তাই সবার পরামর্শে ও সহযোগিতায় সে মাস্টারির প্রকৃতি ও পদ্ধতি সবই ভিন্নভাবে বিন্যস্ত করে নেওয়া হয়েছিল। বকাউল্লা মাস্টার আর শোনাউল্লা ছাত্র- এ রকম অবস্থানের বদল ঘটিয়ে এমন সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, যাতে প্রত্যেকের সরব ও সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত থাকে। এভাবেই বিভিন্ন জাতীয় দিবস বা বরণীয়জনের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানগুলোও যুগপৎ শিক্ষাপ্রদ ও আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। সে সময়ই মওলানা ভাসানী, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, মাও সে তুং প্রমুখ দেশি-বিদেশি বরণীয় ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটে। তাঁদের স্মরণসভায় যাঁরা আলোচনা করেছিলেন তাঁদের সবার বক্তব্যই ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ। এভাবে শুধু আমি একাই মাস্টারি করিনি, আমার সহবন্দি অনেকেই মাস্টার হয়ে উঠেছিলেন।
ময়মনসিংহ জেলের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আমার পাশের শয্যায়ই ছিলেন মুক্তাগাছার খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ। একসময়কার আওয়ামী লীগপন্থী ও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য শহীদুল্লাহ পরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাসদে যোগ দেন। জাসদ সদস্যরূপেই তিনি কারাবন্দি হন। বন্দিদশার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, "সেবার বিনা বিচারে দীর্ঘ ১৯ মাস ছিলাম জেলখানায়। এই ১৯ মাসের কারাজীবন অতীতে জেলে থাকার মতো মনে হয়নি। নানা কারণে এবারের জেলজীবন আমার কাছে অনেকটা ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এ সময় কারাগারের ভেতরে ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দিরা মিলে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনসহ বিভিন্ন সময় দেশের রাজনীতি ও নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা, সংগীতানুষ্ঠান, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পালন করতাম। প্রাথমিক অবস্থায় কঠোর বিধিনিষেধের কারণে ১৯৭৫ সালে বিজয় দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৬-এ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় পাশাপাশি কাঠের চেয়ার দাঁড় করিয়ে তা কালো কাপড়ে ঢেকে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। সেখানে ফুল দিয়ে সব বন্দির সমন্বয়ে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' প্রভাতফেরির অমর গান গেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করি। বিকেলে রফিক ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আলোচনা সভা করা হয়। সেখানে বক্তার তালিকায় তোফায়েল আহমেদ, রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া, আমি, খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক যতীন সরকারসহ অন্যরা ছিলেন। এর পর থেকে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ কোনো দিবস পালনের বিধিনিষেধই আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই সভাপতি হিসেবে রফিক ভাই আর নিয়মিত বক্তার তালিকায় তোফায়েল আহমেদ, যতীনবাবু, আমিসহ কয়েকজন ছিলাম।"
হ্যাঁ, ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা রফিক উদ্দিন ভুঁইয়ার সভাপতিত্বেই জেলখানায় আমরা নানা অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছি। শুধু গুরুগম্ভীর আলোচনা অনুষ্ঠানই নয়, ভুঁইয়া সাহেবকে সভাপতির আসনে বসিয়ে অনেক হালকাচালের হাসি-মশকরার অনুষ্ঠানও আমরা করেছি। সে সময়ের পত্রপত্রিকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেক অবিমৃষ্যকারিতাপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হতো। ওই সব লেখা পড়ে আমরা স্বভাবতই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠতাম। আবার তারই পাশাপাশি এসব লেখকের (তথা বাংলাদেশবিরোধী শয়তানদের) মূর্খতার পরিচয় পেয়ে আমরা হো হো করে হেসেও উঠতাম। একবার স্বাধীনতার দুশমনদের বক্তব্যের সূত্র ধরেই আমরা একটা রম্য বিতর্কের অনুষ্ঠান করলাম। বিতর্কের প্রস্তাব- 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বিদেশি উসকানির ফল'।
যথারীতি রফিক ভুঁইয়াকে সভাপতির আসনে বসিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। প্রস্তাবের পক্ষদলের নেতা আমি আর বিপক্ষদলের সৈয়দ আহমদ (তিনি ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ময়মনসিংহের আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম বিশিষ্টজন)। আমার দলের অন্য সবার সচিৎকার সমর্থন নিয়ে এমন উৎকট গলাবাজি আমি করেছিলাম যে বিপক্ষদলের সবাই একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। শুধু কোণঠাসা নয়, আমার কলিংবেল-নিন্দিত কণ্ঠের গর্জনের সামনে তাঁরা সব কথারই যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ রকম সব নোংরা বক্তব্য আমার মুখ থেকে বেরোতে পারে- এমনটি তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অনেক কুৎসিত কথা আমি অবলীলায় বলে যাচ্ছিলাম। সেসব কথার পেছনে চোখা চোখা যুক্তিও পেশ করছিলাম। তবে বলাই বাহুল্য, সেগুলো ছিল একান্তই কুযুক্তি বা অপযুক্তি। প্রকৃত যুক্তির চেয়ে কুযুক্তি বা অপযুুক্তি অনেক সময়ই অনেক বেশি জোরদার ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কুযুক্তি যেমন অনায়াসে ধূম্রজালের সৃষ্টি করতে পারে, প্রকৃত যুক্তি তেমনটা পারে না। সে কারণেই কুযুক্তির কুপ্রভাবে ফেলে মানুষকে চিরস্থায়ী না হলেও দীর্ঘস্থায়ী বিভ্রান্তির পাঁকে আটকে রাখা যায়। এ রকমটি করেই তো স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকার ও তাদের উত্তরসূরিরা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বুক চিতিয়ে চলছে, প্রতিনিয়ত নানা কুযুক্তির জাল বিস্তার করছে, সেই জালে নতুন প্রজন্মের মানুষদের অনেককেই আটকে ফেলছে।
তবে আশার কথা এই যে স্বাধীনতাবিরোধীদের কুযুক্তি বা অপযুক্তির জালে যারা ধরা পড়েনি, সেই সব মানুষই গুণে-মানে-প্রত্যয়ে অনেক বেশি উৎকর্ষমণ্ডিত। আর এ রকম মানুষের মধ্যে প্রাকৃতজনই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনক্ষর প্রাকৃতজন যে তথাকথিত শিক্ষিতজনদের মতো মতলববাজ নয়, জেলখানায়ই তার অনেক প্রমাণ পেয়েছিলাম।
আমাদের সেদিনকার বিতর্ক চলার সময় বেশ কিছুসংখ্যক সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দিও সেখানে এসে ভিড় করেছিল। ওই অনক্ষর বন্দিরা ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আশপাশেই থাকত। ওদের কয়েকজনকে জেল কর্তৃপক্ষই আমাদের রান্নাবান্না, কাপড় কাচাসহ নানা কাজকর্মের জন্য নিযুক্ত করে রেখেছিল। বিতর্কের শেষে আমি সেখান থেকে চলে আসার পরও ওরা সভাপতি রফিক ভুঁইয়ার কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করেছিল। ক্ষোভটা মূলত আমার ওপর। বিকেলবেলা ভুঁইয়া সাহেবই আমাকে সে কথা জানিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, 'জানেন, যতীনবাবু, আপনি যে স্বাধীনতাবিরোধী, সে কথা আজ সবাই জেনে গেছে। আপনার মতো স্বাধীনতাবিরোধীর সঙ্গে কেন আমরা মেলামেশা করি- এমন প্রশ্নও তারা তুলেছে।'
এটুকু বলেই ভুঁইয়া সাহেব মুখে একটা কৃত্রিম ভাব এনে বললেন, 'না, এখন থেকে আপনার সঙ্গে কেউ আমরা কথাই বলব না। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করলে আমরাও তো ওদের চোখে সন্দেহভাজন হয়ে যাব। তাই...'
কিন্তু বেশিক্ষণ তিনি এই কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রাখতে পারলেন না। আমার কাঁধে হাত রেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসি থামলে তিনি ওই সাধারণ কয়েদিদের সম্পর্কে অনেক প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করলেন, লেখাপড়া না জেনেও যে ওদের দেশপ্রেম একেবারে নিখাদ, সে কথাটাই বারবার বলে চললেন।
আমিও তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলাম। নিজেরা যেমন ওরা 'শিক্ষিত' লোকের মতো মনে এক রেখে মুখে আরেক বলতে পারে না, অন্য কেউ যে এমনটি করতে পারে, তাও ভাবতে পারে না। তাই বিতর্ক অনুষ্ঠানে আমার মুখে যা যা শুনেছে, সেসবকে আমার মনের কথা বলেই বিশ্বাস করেছে। সেই বিশ্বাস থেকেই তারা আমাকে দেশদ্রোহী বলে সাব্যস্ত করে নিয়ে আমার প্রতি তীব্র ঘৃণায় ফেটে পড়েছে।
অনক্ষর প্রাকৃতজনের অবস্থান যে স্বাধীনতার পক্ষে একান্ত দৃঢ়, জেলখানায় এসেও আমি তা-ই প্রত্যক্ষ করলাম। অথচ এদেরই বিপরীতে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ও 'শিক্ষিত' রাজবন্দিদের বেশ কয়েকজনের কথাবার্তায় অন্য রকম ভাবনার পরিচয় পেয়েছি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তরে যা ঘটেছে, তাকে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ বলেই স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, এটা ভারতীয় আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাঁদের কথা আমি শুনেই গেছি কেবল, তর্কে প্রবৃত্ত হওয়ার প্রবৃত্তিই আমার হয়নি। কিন্তু খাঁটি দেশপ্রেমিক সাধারণ কয়েদিরা যে আমাকে ঘৃণা করছে, এতে আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম। তবে ভুঁইয়া সাহেবই আমাকে আশ্বস্ত করলেন। জানালেন যে বিষয়টি বুঝিয়ে বলায় তাঁদের ভুল দূর হয়ে গেছে; এখন আর আমার প্রতি তাঁদের কোনো অভিযোগ নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ
সত্যেন সেন যখন ঢাকার নারিন্দায় উদীচীর পত্তন ঘটান, সেই পাকিস্তানি জমানায়ই ময়মনসিংহ শহরেও এর ঢেউ এসে লাগে, এখানেও উদীচীর শাখা প্রতিষ্ঠায় আমরা কয়েকজন তৎপর হয়ে উঠি। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিল আলোকময় নাহার। তাঁরই উদ্যোগে ওস্তাদ মিথুন দেকে নেতৃপদে বসিয়ে ময়মনসিংহে উদীচীর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। উদীচী যেহেতু একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, তাই এর সদস্যদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার তাগিদ দেখা দেয় এবং এখানেও আমার ওপরই 'মাস্টারি'র দায়িত্ব বর্তায়। বাংলাদেশের অন্য কয়েকটি জেলায় যখন উদীচীর শাখা গড়ে ওঠে, তখন সেসব জেলায়ও আমাকেই 'মাস্টারি' করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে সারা দেশে সংস্কৃতির মাস্টারির সূত্রেই আমার একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উদীচীর সদস্যরা আমাকে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির আসনে বসিয়ে দেন।
রাজনীতির সঙ্গে আমার সংযুক্তির সূত্রও এই মাস্টারিই। প্রশিক্ষণের নামে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে নানা তত্ত্বকথা নিয়ে বকাবাজি করেছি- অর্থাৎ মাস্টারি করেছি। এ রকম মাস্টারি ছাড়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটার তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। অথচ এটুকুর জন্যই আমি কি না 'রাজনীতিক' আর তারই ফলে আমার কারাবাস!
এখানেও তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা আমাকে মাস্টারি করার জন্য ধরে বসল। কারাবন্দি প্রবীণ নেতারাও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। তাই কারাগারে বসেও আমাকে মাস্টারি করতে হলো। এ রকম মাস্টারি করার মধ্য দিয়ে আমার নিজের চেতনায়ও যেমন শাণ দিয়ে যেতে পেরেছিলাম, তেমনি অন্যদের চৈতন্যকেও সজাগ করে তুলতে চেষ্টা করেছিলাম। তাই সবার পরামর্শে ও সহযোগিতায় সে মাস্টারির প্রকৃতি ও পদ্ধতি সবই ভিন্নভাবে বিন্যস্ত করে নেওয়া হয়েছিল। বকাউল্লা মাস্টার আর শোনাউল্লা ছাত্র- এ রকম অবস্থানের বদল ঘটিয়ে এমন সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো, যাতে প্রত্যেকের সরব ও সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত থাকে। এভাবেই বিভিন্ন জাতীয় দিবস বা বরণীয়জনের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানগুলোও যুগপৎ শিক্ষাপ্রদ ও আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। সে সময়ই মওলানা ভাসানী, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, মাও সে তুং প্রমুখ দেশি-বিদেশি বরণীয় ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটে। তাঁদের স্মরণসভায় যাঁরা আলোচনা করেছিলেন তাঁদের সবার বক্তব্যই ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ। এভাবে শুধু আমি একাই মাস্টারি করিনি, আমার সহবন্দি অনেকেই মাস্টার হয়ে উঠেছিলেন।
ময়মনসিংহ জেলের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আমার পাশের শয্যায়ই ছিলেন মুক্তাগাছার খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ। একসময়কার আওয়ামী লীগপন্থী ও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য শহীদুল্লাহ পরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাসদে যোগ দেন। জাসদ সদস্যরূপেই তিনি কারাবন্দি হন। বন্দিদশার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, "সেবার বিনা বিচারে দীর্ঘ ১৯ মাস ছিলাম জেলখানায়। এই ১৯ মাসের কারাজীবন অতীতে জেলে থাকার মতো মনে হয়নি। নানা কারণে এবারের জেলজীবন আমার কাছে অনেকটা ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এ সময় কারাগারের ভেতরে ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দিরা মিলে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনসহ বিভিন্ন সময় দেশের রাজনীতি ও নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা, সংগীতানুষ্ঠান, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পালন করতাম। প্রাথমিক অবস্থায় কঠোর বিধিনিষেধের কারণে ১৯৭৫ সালে বিজয় দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৬-এ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় পাশাপাশি কাঠের চেয়ার দাঁড় করিয়ে তা কালো কাপড়ে ঢেকে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। সেখানে ফুল দিয়ে সব বন্দির সমন্বয়ে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' প্রভাতফেরির অমর গান গেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করি। বিকেলে রফিক ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আলোচনা সভা করা হয়। সেখানে বক্তার তালিকায় তোফায়েল আহমেদ, রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া, আমি, খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক যতীন সরকারসহ অন্যরা ছিলেন। এর পর থেকে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ কোনো দিবস পালনের বিধিনিষেধই আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই সভাপতি হিসেবে রফিক ভাই আর নিয়মিত বক্তার তালিকায় তোফায়েল আহমেদ, যতীনবাবু, আমিসহ কয়েকজন ছিলাম।"
হ্যাঁ, ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা রফিক উদ্দিন ভুঁইয়ার সভাপতিত্বেই জেলখানায় আমরা নানা অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছি। শুধু গুরুগম্ভীর আলোচনা অনুষ্ঠানই নয়, ভুঁইয়া সাহেবকে সভাপতির আসনে বসিয়ে অনেক হালকাচালের হাসি-মশকরার অনুষ্ঠানও আমরা করেছি। সে সময়ের পত্রপত্রিকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেক অবিমৃষ্যকারিতাপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হতো। ওই সব লেখা পড়ে আমরা স্বভাবতই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠতাম। আবার তারই পাশাপাশি এসব লেখকের (তথা বাংলাদেশবিরোধী শয়তানদের) মূর্খতার পরিচয় পেয়ে আমরা হো হো করে হেসেও উঠতাম। একবার স্বাধীনতার দুশমনদের বক্তব্যের সূত্র ধরেই আমরা একটা রম্য বিতর্কের অনুষ্ঠান করলাম। বিতর্কের প্রস্তাব- 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বিদেশি উসকানির ফল'।
যথারীতি রফিক ভুঁইয়াকে সভাপতির আসনে বসিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। প্রস্তাবের পক্ষদলের নেতা আমি আর বিপক্ষদলের সৈয়দ আহমদ (তিনি ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ময়মনসিংহের আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম বিশিষ্টজন)। আমার দলের অন্য সবার সচিৎকার সমর্থন নিয়ে এমন উৎকট গলাবাজি আমি করেছিলাম যে বিপক্ষদলের সবাই একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। শুধু কোণঠাসা নয়, আমার কলিংবেল-নিন্দিত কণ্ঠের গর্জনের সামনে তাঁরা সব কথারই যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ রকম সব নোংরা বক্তব্য আমার মুখ থেকে বেরোতে পারে- এমনটি তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অনেক কুৎসিত কথা আমি অবলীলায় বলে যাচ্ছিলাম। সেসব কথার পেছনে চোখা চোখা যুক্তিও পেশ করছিলাম। তবে বলাই বাহুল্য, সেগুলো ছিল একান্তই কুযুক্তি বা অপযুক্তি। প্রকৃত যুক্তির চেয়ে কুযুক্তি বা অপযুুক্তি অনেক সময়ই অনেক বেশি জোরদার ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কুযুক্তি যেমন অনায়াসে ধূম্রজালের সৃষ্টি করতে পারে, প্রকৃত যুক্তি তেমনটা পারে না। সে কারণেই কুযুক্তির কুপ্রভাবে ফেলে মানুষকে চিরস্থায়ী না হলেও দীর্ঘস্থায়ী বিভ্রান্তির পাঁকে আটকে রাখা যায়। এ রকমটি করেই তো স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকার ও তাদের উত্তরসূরিরা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বুক চিতিয়ে চলছে, প্রতিনিয়ত নানা কুযুক্তির জাল বিস্তার করছে, সেই জালে নতুন প্রজন্মের মানুষদের অনেককেই আটকে ফেলছে।
তবে আশার কথা এই যে স্বাধীনতাবিরোধীদের কুযুক্তি বা অপযুক্তির জালে যারা ধরা পড়েনি, সেই সব মানুষই গুণে-মানে-প্রত্যয়ে অনেক বেশি উৎকর্ষমণ্ডিত। আর এ রকম মানুষের মধ্যে প্রাকৃতজনই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনক্ষর প্রাকৃতজন যে তথাকথিত শিক্ষিতজনদের মতো মতলববাজ নয়, জেলখানায়ই তার অনেক প্রমাণ পেয়েছিলাম।
আমাদের সেদিনকার বিতর্ক চলার সময় বেশ কিছুসংখ্যক সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দিও সেখানে এসে ভিড় করেছিল। ওই অনক্ষর বন্দিরা ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আশপাশেই থাকত। ওদের কয়েকজনকে জেল কর্তৃপক্ষই আমাদের রান্নাবান্না, কাপড় কাচাসহ নানা কাজকর্মের জন্য নিযুক্ত করে রেখেছিল। বিতর্কের শেষে আমি সেখান থেকে চলে আসার পরও ওরা সভাপতি রফিক ভুঁইয়ার কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করেছিল। ক্ষোভটা মূলত আমার ওপর। বিকেলবেলা ভুঁইয়া সাহেবই আমাকে সে কথা জানিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, 'জানেন, যতীনবাবু, আপনি যে স্বাধীনতাবিরোধী, সে কথা আজ সবাই জেনে গেছে। আপনার মতো স্বাধীনতাবিরোধীর সঙ্গে কেন আমরা মেলামেশা করি- এমন প্রশ্নও তারা তুলেছে।'
এটুকু বলেই ভুঁইয়া সাহেব মুখে একটা কৃত্রিম ভাব এনে বললেন, 'না, এখন থেকে আপনার সঙ্গে কেউ আমরা কথাই বলব না। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করলে আমরাও তো ওদের চোখে সন্দেহভাজন হয়ে যাব। তাই...'
কিন্তু বেশিক্ষণ তিনি এই কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রাখতে পারলেন না। আমার কাঁধে হাত রেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসি থামলে তিনি ওই সাধারণ কয়েদিদের সম্পর্কে অনেক প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করলেন, লেখাপড়া না জেনেও যে ওদের দেশপ্রেম একেবারে নিখাদ, সে কথাটাই বারবার বলে চললেন।
আমিও তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলাম। নিজেরা যেমন ওরা 'শিক্ষিত' লোকের মতো মনে এক রেখে মুখে আরেক বলতে পারে না, অন্য কেউ যে এমনটি করতে পারে, তাও ভাবতে পারে না। তাই বিতর্ক অনুষ্ঠানে আমার মুখে যা যা শুনেছে, সেসবকে আমার মনের কথা বলেই বিশ্বাস করেছে। সেই বিশ্বাস থেকেই তারা আমাকে দেশদ্রোহী বলে সাব্যস্ত করে নিয়ে আমার প্রতি তীব্র ঘৃণায় ফেটে পড়েছে।
অনক্ষর প্রাকৃতজনের অবস্থান যে স্বাধীনতার পক্ষে একান্ত দৃঢ়, জেলখানায় এসেও আমি তা-ই প্রত্যক্ষ করলাম। অথচ এদেরই বিপরীতে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ও 'শিক্ষিত' রাজবন্দিদের বেশ কয়েকজনের কথাবার্তায় অন্য রকম ভাবনার পরিচয় পেয়েছি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তরে যা ঘটেছে, তাকে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ বলেই স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, এটা ভারতীয় আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাঁদের কথা আমি শুনেই গেছি কেবল, তর্কে প্রবৃত্ত হওয়ার প্রবৃত্তিই আমার হয়নি। কিন্তু খাঁটি দেশপ্রেমিক সাধারণ কয়েদিরা যে আমাকে ঘৃণা করছে, এতে আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম। তবে ভুঁইয়া সাহেবই আমাকে আশ্বস্ত করলেন। জানালেন যে বিষয়টি বুঝিয়ে বলায় তাঁদের ভুল দূর হয়ে গেছে; এখন আর আমার প্রতি তাঁদের কোনো অভিযোগ নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments