পুরুষতন্ত্র-ঘটনাগুলো কি প্রেম, না নিপীড়ন? by নাসরিন সিরাজ
৩ জানুয়ারির সকালটা শুরু হয় টিভিতে খবর দেখে। খবরে প্রকাশ, একটি ছেলে একটি মেয়েকে ছুরিকাঘাত করেছে। মেয়েটির মুখে ও ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছে। ঘটনার গুরুত্বের কারণে মেয়েটি এই তীব্র শীতে একটি ঘরের (হাসপাতালের হতে পারে) মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।
৪ জানুয়ারির প্রথম আলোয় এ রকম একটি (বা একই) খবর বের হয়। ঘটনার সত্যতা ও ভয়াবহতা নয়, আমাকে অবাক করেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও বিভিন্ন কর্মজীবী নারীদের ওপর ঘটা সহিংস ঘটনার উপস্থাপন দেখে। যেভাবে গণমাধ্যমে এসব ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে, তা গুরুতর সহিংস ঘটনাকে হাস্যকর করে উপস্থাপনারই শামিল। একই সঙ্গে এটা ২০০৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া যৌন নিপীড়নবিরোধী নির্দেশনাকে অবমাননা করার সুযোগ তৈরি করছে। এমন উপস্থাপনা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা, কর্মপ্রতিষ্ঠানের যৌন নিপীড়নবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকেও খাটো করে। গণমাধ্যম তা করছে অপরাধী বা অভিযুক্তের (নিপীড়িতের নয়) বয়ানকে শিরোনাম করে, যা ‘প্রেম প্রত্যাখ্যান’ বা এজাতীয় কথার ওপর বেশি বেশি গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মেয়েদের ওপর সহিংসতার সামপ্রতিক ঘটনাগুলোর মিডিয়া ট্রিটমেন্ট দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রেমের মতো সহজ, সাবলীল, সুন্দর একটি সম্পর্কের চর্চা করে না। এটা একমাত্র তাদের পক্ষেই ভাবা সম্ভব, যারা বাংলাদেশকে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এই দৃষ্টিকোণটি ভাবে, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছেলেমেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত শুধু বাবারা নেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কনে দেখা অনুষ্ঠানেই শুধু ছেলেমেয়ের দেখা হয়, ছেলেটির বিয়ের প্রস্তাব ঘটক নামের এক পেশাদার ব্যক্তি নিয়ে আসেন আর আমাদের বিয়ের সম্পর্কগুলো শুধুই ‘নারী নির্যাতন’ অথবা ‘স্বামী আরাধনা’য় ভরপুর। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা বিজ্ঞাপন দেখতে কৌতুককর। এর মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি হয় ভালো। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বানানো নাটক-সিনেমা ঈদের সময় বিনোদন দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজে ঘটা সহিংস ঘটনাকে দেখলে সেটা মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের হূদয়হীনতাকেই প্রকাশ করে।
বাস্তবে আমরা যে ঘটনাগুলো দেখছি তাতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে (সাংবিধানিকভাবে যেটা ব্যবহারের সুযোগ সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত) মেয়েদের ‘উড়ো মন্তব্য’ করে বিরক্ত করা হচ্ছে, ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই মৌখিক আগ্রাসন হিসেবে থাকেনি, ঘটেছে শারীরিক আগ্রাসন। নিপীড়িত পক্ষ প্রতিবাদ করতে গেলে ঘটেছে খুন, জখম ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা। অপরাধী/অভিযুক্ত ব্যক্তিরা স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক ক্ষমতার আশ্রয়ের পাশাপাশি পেয়েছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। মানবজীবন ছাড়াও এসব অপরাধীর লক্ষ্য মানুষের সামাজিক সম্মান। বেশ কয়েক বছর দেখছি, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ভিডিও, ব্যক্তিগত জীবনের একান্ত ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। প্রতারণা চলেছে ফেসবুকের মতো ওয়েবভিত্তিক সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও। সমাজের যখন এই হাল তখন কিছু কিশোর তরুণকে ধরে ‘বখাটে’ চিহ্নিত করা হয়েছে। অপারেশন রোমিও হান্ট নামে র্যাবকে একটি ‘অপারেশন’ করতে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের এই সশস্ত্র বাহিনীটি যেহেতু ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ বা ত্বরিত কর্মকৌশলে চলে, তাই তাদের ধরা ‘বখাটে’ বা ‘রোমিও’ বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে বা তাদের কী অপরাধে ধরা হচ্ছে, কোন বিচারে তাদের কী শাস্তি হচ্ছে, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে।
অর্থাৎ বাস্তব জগতে পাবলিক পরিসর—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, যানবাহনে বাংলাদেশের মেয়েরা আজকাল নানা রকম সহিংস ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অপরাধের মোটিভকে প্রেম আখ্যা দিয়ে একদিকে মিডিয়া ঘটনার গুরুত্বকে হালকা করছে; বিশেষ করে, সংবাদ পরিবেশনের সময়ে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক সভায় গীতি আরা নাসরিন মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির এই আচরণকে মিডিয়ার একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবেও চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে মিডিয়া ঘটনাগুলোকে পরিচিত করাতে ইভ টিজিংয়ের মতো একটি পপুলার টার্মকে বেছে নিয়েছে মাত্র। অন্যদিকে সহিংস ঘটনাগুলোকে সামাল দিতে রাষ্ট্র সক্রিয় হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানেও অপরাধ ও অপরাধী নিয়ে ধোঁয়াটে ধারণা ও কর্মতৎপরতা আছে। আর মাঝখানে বলি হচ্ছে প্রেম ও রোমিও।
আমরা কি সবাই চাই না যে আমাদের সমাজের পুরুষেরা রোমিও হোক? একজন মানুষ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে, আরেকজন মানুষের প্রতি মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখলে, সুর সৃষ্টি করলে, গান গেয়ে উঠলে তো কারও অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রেমের সঙ্গে সামাজিক অপমান, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, জখম, খুন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, ভয় দেখানোর মতো ঘটনার কি তুলনা করা সম্ভব? প্রেম যেমন আমাদের সমাজে সত্য, প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে নীরবে পথ ছেড়ে দেওয়ার উদাহরণও তো সীমাহীন। রোমিও তাই সাধারণ মানুষেরই প্রতীক হতে পারে, অপরাধীর নয়।
ঘটনাগুলোতে অপরাধ ও অপরাধী চিনতে ২০০৯ সালে প্রদত্ত হাইকোর্টের যৌন নিপীড়নবিরোধী নির্দেশনাটিই একমাত্র পথ দেখাতে পারে। এই নির্দেশনায় যৌন নিপীড়ন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
১. অযাচিত যৌনজ আচরণ শারীরিক স্পর্শ বা আগ্রাসন (সরাসরি বা ইঙ্গিতবহ); ২. প্রশাসনিক, কর্তৃত্বের অথবা পেশাদারি ক্ষমতা অপব্যবহার করে যৌন ইঙ্গিতবাহী শারীরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বা কর্মতৎপরতা; ৩. যৌন ইঙ্গিতবাহী মৌখিক পুনঃ উপস্থাপনা করা; ৪. যৌনজ সুবিধার দাবি বা অনুরোধ করা; ৫. পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন; ৬. যৌনজ ইঙ্গিতবাহী উড়ো মন্তব্য বা ভঙ্গি; ৭. অভদ্র ভঙ্গি, কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত করা, বিরক্ত করা, যৌন ইঙ্গিতবাহী কৌতুক করা; ৮. যৌন ইঙ্গিতবাহী চিঠি, টেলিফোন কল, সেলফোন কল, ছোট টেক্সট মেসেজ, নোটিশ, কার্টুন, অযথা ঘুরে বেড়ানো, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিলে, নোটিশ বোর্ড, অফিস, স্কুলের, কারখানার ও প্রক্ষালনকক্ষের দেয়ালে লিখে অপমান করা; ৯. ব্ল্যাকমেইল ও চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থিরচিত্র বা ভিডিওচিত্র তোলা; ১০. যৌনতার ওপর ভিত্তি করে বা যৌন নিপীড়ন করার জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক, শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা প্রদান; ১১. ভালোবাসার প্রস্তাবের বা ভালোবাসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সময় চাপ প্রয়োগ বা হুমকি দেওয়া; ১২. ভয় দেখিয়ে, চক্রান্ত করে অথবা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা।
বাংলাদেশের মেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে পাবলিক পরিসরে ঘটা যৌন নিপীড়নকে ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে দেখার আসলে কোনো সুযোগ নেই। দুই বছরে হাইকোর্টের নির্দেশনাটি সমাজে কার্যকর করতে অনেকেই কাজ করছেন। এর মধ্যে আছেন নারী-পুরুষনির্বিশেষে আইনজীবী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মজীবী, লেখক, শিল্পী ও কারখানার শ্রমিকেরা। গণমাধ্যম ও রাষ্ট্র হাইকোর্টের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ঘটনাগুলোকে বুঝতে এগিয়ে এলে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হবে। আর সেটাই এই সমাজের একজন নারী হিসেবে আমার প্রত্যাশা।
ইংরেজি মূল নির্দেশনা থেকে অনুবাদ লেখকের
নাসরিন সিরাজ: গবেষক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা।
nasrinsiraj@yahoo.com
মেয়েদের ওপর সহিংসতার সামপ্রতিক ঘটনাগুলোর মিডিয়া ট্রিটমেন্ট দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রেমের মতো সহজ, সাবলীল, সুন্দর একটি সম্পর্কের চর্চা করে না। এটা একমাত্র তাদের পক্ষেই ভাবা সম্ভব, যারা বাংলাদেশকে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এই দৃষ্টিকোণটি ভাবে, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছেলেমেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত শুধু বাবারা নেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কনে দেখা অনুষ্ঠানেই শুধু ছেলেমেয়ের দেখা হয়, ছেলেটির বিয়ের প্রস্তাব ঘটক নামের এক পেশাদার ব্যক্তি নিয়ে আসেন আর আমাদের বিয়ের সম্পর্কগুলো শুধুই ‘নারী নির্যাতন’ অথবা ‘স্বামী আরাধনা’য় ভরপুর। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা বিজ্ঞাপন দেখতে কৌতুককর। এর মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি হয় ভালো। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বানানো নাটক-সিনেমা ঈদের সময় বিনোদন দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজে ঘটা সহিংস ঘটনাকে দেখলে সেটা মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের হূদয়হীনতাকেই প্রকাশ করে।
বাস্তবে আমরা যে ঘটনাগুলো দেখছি তাতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে (সাংবিধানিকভাবে যেটা ব্যবহারের সুযোগ সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত) মেয়েদের ‘উড়ো মন্তব্য’ করে বিরক্ত করা হচ্ছে, ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই মৌখিক আগ্রাসন হিসেবে থাকেনি, ঘটেছে শারীরিক আগ্রাসন। নিপীড়িত পক্ষ প্রতিবাদ করতে গেলে ঘটেছে খুন, জখম ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা। অপরাধী/অভিযুক্ত ব্যক্তিরা স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক ক্ষমতার আশ্রয়ের পাশাপাশি পেয়েছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। মানবজীবন ছাড়াও এসব অপরাধীর লক্ষ্য মানুষের সামাজিক সম্মান। বেশ কয়েক বছর দেখছি, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ভিডিও, ব্যক্তিগত জীবনের একান্ত ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। প্রতারণা চলেছে ফেসবুকের মতো ওয়েবভিত্তিক সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও। সমাজের যখন এই হাল তখন কিছু কিশোর তরুণকে ধরে ‘বখাটে’ চিহ্নিত করা হয়েছে। অপারেশন রোমিও হান্ট নামে র্যাবকে একটি ‘অপারেশন’ করতে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের এই সশস্ত্র বাহিনীটি যেহেতু ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ বা ত্বরিত কর্মকৌশলে চলে, তাই তাদের ধরা ‘বখাটে’ বা ‘রোমিও’ বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে বা তাদের কী অপরাধে ধরা হচ্ছে, কোন বিচারে তাদের কী শাস্তি হচ্ছে, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে।
অর্থাৎ বাস্তব জগতে পাবলিক পরিসর—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, যানবাহনে বাংলাদেশের মেয়েরা আজকাল নানা রকম সহিংস ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অপরাধের মোটিভকে প্রেম আখ্যা দিয়ে একদিকে মিডিয়া ঘটনার গুরুত্বকে হালকা করছে; বিশেষ করে, সংবাদ পরিবেশনের সময়ে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক সভায় গীতি আরা নাসরিন মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির এই আচরণকে মিডিয়ার একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবেও চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে মিডিয়া ঘটনাগুলোকে পরিচিত করাতে ইভ টিজিংয়ের মতো একটি পপুলার টার্মকে বেছে নিয়েছে মাত্র। অন্যদিকে সহিংস ঘটনাগুলোকে সামাল দিতে রাষ্ট্র সক্রিয় হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানেও অপরাধ ও অপরাধী নিয়ে ধোঁয়াটে ধারণা ও কর্মতৎপরতা আছে। আর মাঝখানে বলি হচ্ছে প্রেম ও রোমিও।
আমরা কি সবাই চাই না যে আমাদের সমাজের পুরুষেরা রোমিও হোক? একজন মানুষ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে, আরেকজন মানুষের প্রতি মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখলে, সুর সৃষ্টি করলে, গান গেয়ে উঠলে তো কারও অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রেমের সঙ্গে সামাজিক অপমান, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, জখম, খুন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, ভয় দেখানোর মতো ঘটনার কি তুলনা করা সম্ভব? প্রেম যেমন আমাদের সমাজে সত্য, প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে নীরবে পথ ছেড়ে দেওয়ার উদাহরণও তো সীমাহীন। রোমিও তাই সাধারণ মানুষেরই প্রতীক হতে পারে, অপরাধীর নয়।
ঘটনাগুলোতে অপরাধ ও অপরাধী চিনতে ২০০৯ সালে প্রদত্ত হাইকোর্টের যৌন নিপীড়নবিরোধী নির্দেশনাটিই একমাত্র পথ দেখাতে পারে। এই নির্দেশনায় যৌন নিপীড়ন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
১. অযাচিত যৌনজ আচরণ শারীরিক স্পর্শ বা আগ্রাসন (সরাসরি বা ইঙ্গিতবহ); ২. প্রশাসনিক, কর্তৃত্বের অথবা পেশাদারি ক্ষমতা অপব্যবহার করে যৌন ইঙ্গিতবাহী শারীরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বা কর্মতৎপরতা; ৩. যৌন ইঙ্গিতবাহী মৌখিক পুনঃ উপস্থাপনা করা; ৪. যৌনজ সুবিধার দাবি বা অনুরোধ করা; ৫. পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন; ৬. যৌনজ ইঙ্গিতবাহী উড়ো মন্তব্য বা ভঙ্গি; ৭. অভদ্র ভঙ্গি, কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত করা, বিরক্ত করা, যৌন ইঙ্গিতবাহী কৌতুক করা; ৮. যৌন ইঙ্গিতবাহী চিঠি, টেলিফোন কল, সেলফোন কল, ছোট টেক্সট মেসেজ, নোটিশ, কার্টুন, অযথা ঘুরে বেড়ানো, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিলে, নোটিশ বোর্ড, অফিস, স্কুলের, কারখানার ও প্রক্ষালনকক্ষের দেয়ালে লিখে অপমান করা; ৯. ব্ল্যাকমেইল ও চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থিরচিত্র বা ভিডিওচিত্র তোলা; ১০. যৌনতার ওপর ভিত্তি করে বা যৌন নিপীড়ন করার জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক, শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা প্রদান; ১১. ভালোবাসার প্রস্তাবের বা ভালোবাসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সময় চাপ প্রয়োগ বা হুমকি দেওয়া; ১২. ভয় দেখিয়ে, চক্রান্ত করে অথবা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা।
বাংলাদেশের মেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে পাবলিক পরিসরে ঘটা যৌন নিপীড়নকে ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে দেখার আসলে কোনো সুযোগ নেই। দুই বছরে হাইকোর্টের নির্দেশনাটি সমাজে কার্যকর করতে অনেকেই কাজ করছেন। এর মধ্যে আছেন নারী-পুরুষনির্বিশেষে আইনজীবী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মজীবী, লেখক, শিল্পী ও কারখানার শ্রমিকেরা। গণমাধ্যম ও রাষ্ট্র হাইকোর্টের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ঘটনাগুলোকে বুঝতে এগিয়ে এলে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হবে। আর সেটাই এই সমাজের একজন নারী হিসেবে আমার প্রত্যাশা।
ইংরেজি মূল নির্দেশনা থেকে অনুবাদ লেখকের
নাসরিন সিরাজ: গবেষক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা।
nasrinsiraj@yahoo.com
No comments