শেয়ারবাজার-স্ফীতি ও ধসের মধ্যে ফাটকা খেলা by আসজাদুল কিবরিয়া
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্য দিয়েই শুরু করা যাক। গত রোববার রাতে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে বলে বসলেন, ‘বাজার যখন বাড়ে তখন তো কেউ রাস্তায় নেমে আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করেন না।
কিন্তু দরপতন হলে রাস্তায় নেমে ভাঙচুর শুরু করে দেন। ভাঙচুর কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।’
এটা ঠিক যে ভাঙচুর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শেয়ারের দরপতন ঘটলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী ও কারবারিরা মাঝেমধ্যেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান, কখনো ভাঙচুরও করেন। সাম্প্রতিক কালে শেয়ারের দরপতনকালে এই চিত্র বারবার দেখা গেছে। কিন্তু এর বিপরীতে দাম বাড়লে মিষ্টি বিতরণ না করার যে কথাটি দেশের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তা পুঁজিবাজারে যখন ধস নেমেছে, তখন তাঁর বলা শোভন হয়নি। বরং এর মধ্য দিয়ে বাজারের, বিশেষত, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি একধরনের অসংবেদনশীলতাই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ তিন মাস আগে তিনিই বলেছিলেন, শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত নয়।
মনে হচ্ছে, শেয়ারবাজার ঘিরে জাতীয় অর্থনীতিতে যে একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, অর্থমন্ত্রী তথা সরকারের শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকেরা এখনো তা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আসলে তাঁদের এই না পারার বিষয়টি গত দেড়-দুই বছরে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। আর তাই পুঁজিবাজার বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোনো নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণের প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি।
আর সেই প্রচেষ্টা না থাকায় গত দুই বছরে এমন এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা পুঁজিবাজারের একটি ধারাবাহিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর বদলে এই বাজারকে যুক্তিবুদ্ধিহীনভাবে টাকা বানানোর একটি ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। সে জন্য বাজার যখন ক্রমেই স্ফীত হয়েছে, তখন এর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সেটা হয়নি বলেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে মানুষজন প্রলুব্ধ হয়েছে। আর এই প্রলোভনকে নানাভাবে উসকে দিতে সহায়তা করেছে সরকারি বিভিন্ন নীতি। আর এসব নীতি-বিধি বহুলাংশে রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় এসেছে। ভাবতে অবাক লাগে যে শেয়ারবাজারে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত কিছু প্রভাবশালী মহল বা চক্র দেশের নীতিনির্ধারকদের কীভাবে দ্রুত প্রভাবিত করতে পারে, তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। এই চাপে নতি স্বীকার করার ফল যে ভালো হয় না, তা তো এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কালে শেয়ারবাজারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের প্রস্তাব এসেছিল। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে ব্যক্তির বিনিয়োগ থেকে বছরে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে আর ১০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়। তবে মুনাফা ৭ লাখ টাকার নিচে হলে তা করমুক্ত থাকার কথা বলা হয়। গণমাধ্যমে খবরটি আসা মাত্র বিনিয়োগকারীদের কিছু অংশ রাস্তায় নেমে মিছিল ও ভাঙচুর করে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাজারে সূচক পড়ে যায়। আর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নেতারা সরকারের উচ্চ মহলে এই ধারণা দিতে থাকেন যে এভাবে করারোপ করলে বাজার পড়ে যাবে, যা সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হবে। শেষ পর্যন্ত সরকার আর ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ করেনি। করেছে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ওপর ১০ শতাংশ হারে। একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে করারোপ করা হয়, যা উৎসে কর্তনযোগ্য। এর মধ্য দিয়ে সরকার প্রকারান্তরে শেয়ারবাজারে ফাটকা খেলাকেই উৎসাহিত করে।
আর তাই হু হু করে বেড়ে চলে বাজার। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ডিএসইর মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, যা জুন মাসে হয় ৩৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর ডিসেম্বর মাসে তা ছিল ৩৮ হাজার ৭১৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক জানুয়ারির শেষে যেখানে ছিল চার হাজার ৩৮১ পয়েন্ট, সেখানে ডিসেম্বরের শেষে এসে তা হয় আট হাজার ২৯০ দশমিক ৪১ পয়েন্ট। তার মানে এক বছরের মধ্যে বাজারের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু, অর্থনীতিতে কী এমন জোরালো কর্মকাণ্ড ছিল, যা পুঁজিবাজারকে এতটা তেজি ও স্ফীত করে তোলে?
আসলে, এর পেছনে প্রকৃত অর্থনীতির তেমন সমর্থন ছিল না। থাকবেই বা কীভাবে? জ্বালানিসংকটে শিল্প খাতে বিনিয়োগ তেমন একটা বাড়তে পারেনি। রপ্তানিমুখী খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়ায়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় বিভিন্ন দিক থেকে টাকা এসে প্রবেশ করেছে শেয়ারবাজারে। ব্যাংক থেকে শিল্প খাতের জন্য ঋণ নেওয়া টাকা বিনিয়োগের বদলে ঢালা হয়েছে এই বাজারে। এমনকি কিছু বিদেশি পুঁজিও ঢুকেছে। আর এটা এনেছে এ দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে বাজারে অর্থপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে শেয়ারের পরিমাণ তেমন একটা না বাড়ায় বিদ্যমান শেয়ারের দামও বাড়তে থাকে। বলা যায়, দাম বাড়তে থাকে হাওয়ার ওপরে।
কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ার এই প্রবণতাকে উসকে দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে এসইসিও বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে। সব শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকায় নির্ধারণ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করা এবং প্রাথমিক শেয়ারে বুকবিল্ডিং নামের নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো এর মধ্যে অন্যতম।
ফুলে-ফেঁপে ওঠা বাজারে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ছুটে আসতে থাকে। যারা বড় ফাটকা কারবারি, তারা বিভিন্নভাবে গুজব-গল্প ছড়িয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে থাকে। এক লাখ টাকা খাটালে এক সপ্তাহে তা দু্ই লাখ টাকা হয়ে যায়—এমন লোভনীয় প্রচারণা-আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে শেয়ারবাজার ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন। তাঁরা এটাকে বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ বলে বিভ্রান্তিকর যুক্তি দিতে থাকেন। আর তাই একপর্যায়ে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। নিঃসন্দেহে এদের ৯০ শতাংশেরই বড় পুঁজি নেই। থাকার কথাও নয়। তার পরও তারা বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি যে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে কয়েক কোটি বা শতকোটি টাকার পুঁজির সঙ্গে ফাটকা খেলায় পেরে ওঠা সম্ভব নয়।
এভাবে গত দুই বছরে দফায় দফায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মহলের স্বার্থে ও চাপে শেয়ারবাজারকে ঘিরে নানা ধরনের খেলা হয়েছে। ঘন ঘন নীতি-বিধি পাল্টে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগ করে মুনাফার প্রতিযোগিতা। বছর শেষে ব্যাংকগুলোর যে পরিচালনগত মুনাফার চিত্র পাওয়া যায়, তাতে এটা স্পষ্ট যে স্ফীত শেয়ারবাজার থেকে তারা মোটা মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকেই বিনিয়োগের আইনি সীমা লঙ্ঘন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ জন্য সতর্ক করলেও তারা তোয়াক্কা করেনি। আর তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যদি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা না থাকে, যদি আইনকানুন মেনে চলতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে না পারে, যদি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট চাপের কাছে বিচলিত বোধ করে, তাহলে চলবে কী করে?
সর্বোপরি কৃত্রিমভাবে স্ফীত বাজার একটা সময় চুপসে যেতে যে বাধ্য, সেটা যেন কেউ বিবেচনায় নিতে চাচ্ছিল না। অথচ ডিসেম্বর মাসে তা-ই ঘটল। একদিন তো রীতিমতো ধস নামল। সমস্যাটা দেখা দিল নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রকদের অস্থিরতায়। তারা আবার বাজারকে দ্রুত বাড়ানোর জন্য বা ঠেকা দেওয়ার জন্য কিছু নীতি-বিধি পাল্টে ফেলে। এতে করে একটা সংকেত দেওয়া হয় যে বাজার পড়লেও ক্ষতি নেই, সরকারই তা উঠিয়ে দেবে। আর এভাবেই বাজারের সংশোধন-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। যে কারণে জানুয়ারি মাসে টানা পাঁচ দিন দরপতনের পর ষষ্ঠ দিনে নামল ধস। তার পরের কার্যদিবসে ৫০ মিনিট লেনদেন হতেই তা স্থগিত করা হলো বিরাট দরপতনের আশঙ্কায়। বেধে গেল তুমুল হইচই। ফলে মঙ্গলবার সকালে দুই ঘণ্টার মধ্যেই ডিএসইর মূল্যসূচক লাফ দিয়ে বাড়ল প্রায় এক হাজার পয়েন্ট।
অর্থাৎ পুঁজিবাজার যে বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় ও পরিপক্ব হয়, তা যেন কেউ মানতে নারাজ। বরং সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারকে একটি চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। বড় পুঁজির মালিকেরা এই বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে মোটা মুনাফা তুলে নিল। বিভ্রান্ত-আতঙ্কিত ছোট বিনিয়োগকারীরা খোয়াল তাদের স্বল্প পুঁজি। এর প্রতিকার কী?
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
এটা ঠিক যে ভাঙচুর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শেয়ারের দরপতন ঘটলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী ও কারবারিরা মাঝেমধ্যেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান, কখনো ভাঙচুরও করেন। সাম্প্রতিক কালে শেয়ারের দরপতনকালে এই চিত্র বারবার দেখা গেছে। কিন্তু এর বিপরীতে দাম বাড়লে মিষ্টি বিতরণ না করার যে কথাটি দেশের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তা পুঁজিবাজারে যখন ধস নেমেছে, তখন তাঁর বলা শোভন হয়নি। বরং এর মধ্য দিয়ে বাজারের, বিশেষত, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি একধরনের অসংবেদনশীলতাই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ তিন মাস আগে তিনিই বলেছিলেন, শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত নয়।
মনে হচ্ছে, শেয়ারবাজার ঘিরে জাতীয় অর্থনীতিতে যে একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, অর্থমন্ত্রী তথা সরকারের শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকেরা এখনো তা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আসলে তাঁদের এই না পারার বিষয়টি গত দেড়-দুই বছরে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। আর তাই পুঁজিবাজার বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোনো নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণের প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি।
আর সেই প্রচেষ্টা না থাকায় গত দুই বছরে এমন এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা পুঁজিবাজারের একটি ধারাবাহিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর বদলে এই বাজারকে যুক্তিবুদ্ধিহীনভাবে টাকা বানানোর একটি ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। সে জন্য বাজার যখন ক্রমেই স্ফীত হয়েছে, তখন এর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সেটা হয়নি বলেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে মানুষজন প্রলুব্ধ হয়েছে। আর এই প্রলোভনকে নানাভাবে উসকে দিতে সহায়তা করেছে সরকারি বিভিন্ন নীতি। আর এসব নীতি-বিধি বহুলাংশে রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় এসেছে। ভাবতে অবাক লাগে যে শেয়ারবাজারে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত কিছু প্রভাবশালী মহল বা চক্র দেশের নীতিনির্ধারকদের কীভাবে দ্রুত প্রভাবিত করতে পারে, তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। এই চাপে নতি স্বীকার করার ফল যে ভালো হয় না, তা তো এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কালে শেয়ারবাজারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের প্রস্তাব এসেছিল। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে ব্যক্তির বিনিয়োগ থেকে বছরে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে আর ১০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়। তবে মুনাফা ৭ লাখ টাকার নিচে হলে তা করমুক্ত থাকার কথা বলা হয়। গণমাধ্যমে খবরটি আসা মাত্র বিনিয়োগকারীদের কিছু অংশ রাস্তায় নেমে মিছিল ও ভাঙচুর করে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাজারে সূচক পড়ে যায়। আর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নেতারা সরকারের উচ্চ মহলে এই ধারণা দিতে থাকেন যে এভাবে করারোপ করলে বাজার পড়ে যাবে, যা সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হবে। শেষ পর্যন্ত সরকার আর ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ করেনি। করেছে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ওপর ১০ শতাংশ হারে। একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে করারোপ করা হয়, যা উৎসে কর্তনযোগ্য। এর মধ্য দিয়ে সরকার প্রকারান্তরে শেয়ারবাজারে ফাটকা খেলাকেই উৎসাহিত করে।
আর তাই হু হু করে বেড়ে চলে বাজার। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ডিএসইর মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, যা জুন মাসে হয় ৩৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর ডিসেম্বর মাসে তা ছিল ৩৮ হাজার ৭১৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক জানুয়ারির শেষে যেখানে ছিল চার হাজার ৩৮১ পয়েন্ট, সেখানে ডিসেম্বরের শেষে এসে তা হয় আট হাজার ২৯০ দশমিক ৪১ পয়েন্ট। তার মানে এক বছরের মধ্যে বাজারের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু, অর্থনীতিতে কী এমন জোরালো কর্মকাণ্ড ছিল, যা পুঁজিবাজারকে এতটা তেজি ও স্ফীত করে তোলে?
আসলে, এর পেছনে প্রকৃত অর্থনীতির তেমন সমর্থন ছিল না। থাকবেই বা কীভাবে? জ্বালানিসংকটে শিল্প খাতে বিনিয়োগ তেমন একটা বাড়তে পারেনি। রপ্তানিমুখী খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়ায়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় বিভিন্ন দিক থেকে টাকা এসে প্রবেশ করেছে শেয়ারবাজারে। ব্যাংক থেকে শিল্প খাতের জন্য ঋণ নেওয়া টাকা বিনিয়োগের বদলে ঢালা হয়েছে এই বাজারে। এমনকি কিছু বিদেশি পুঁজিও ঢুকেছে। আর এটা এনেছে এ দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে বাজারে অর্থপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে শেয়ারের পরিমাণ তেমন একটা না বাড়ায় বিদ্যমান শেয়ারের দামও বাড়তে থাকে। বলা যায়, দাম বাড়তে থাকে হাওয়ার ওপরে।
কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ার এই প্রবণতাকে উসকে দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে এসইসিও বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে। সব শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকায় নির্ধারণ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করা এবং প্রাথমিক শেয়ারে বুকবিল্ডিং নামের নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো এর মধ্যে অন্যতম।
ফুলে-ফেঁপে ওঠা বাজারে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ছুটে আসতে থাকে। যারা বড় ফাটকা কারবারি, তারা বিভিন্নভাবে গুজব-গল্প ছড়িয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে থাকে। এক লাখ টাকা খাটালে এক সপ্তাহে তা দু্ই লাখ টাকা হয়ে যায়—এমন লোভনীয় প্রচারণা-আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে শেয়ারবাজার ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন। তাঁরা এটাকে বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ বলে বিভ্রান্তিকর যুক্তি দিতে থাকেন। আর তাই একপর্যায়ে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। নিঃসন্দেহে এদের ৯০ শতাংশেরই বড় পুঁজি নেই। থাকার কথাও নয়। তার পরও তারা বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি যে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে কয়েক কোটি বা শতকোটি টাকার পুঁজির সঙ্গে ফাটকা খেলায় পেরে ওঠা সম্ভব নয়।
এভাবে গত দুই বছরে দফায় দফায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মহলের স্বার্থে ও চাপে শেয়ারবাজারকে ঘিরে নানা ধরনের খেলা হয়েছে। ঘন ঘন নীতি-বিধি পাল্টে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগ করে মুনাফার প্রতিযোগিতা। বছর শেষে ব্যাংকগুলোর যে পরিচালনগত মুনাফার চিত্র পাওয়া যায়, তাতে এটা স্পষ্ট যে স্ফীত শেয়ারবাজার থেকে তারা মোটা মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকেই বিনিয়োগের আইনি সীমা লঙ্ঘন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ জন্য সতর্ক করলেও তারা তোয়াক্কা করেনি। আর তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যদি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা না থাকে, যদি আইনকানুন মেনে চলতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে না পারে, যদি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট চাপের কাছে বিচলিত বোধ করে, তাহলে চলবে কী করে?
সর্বোপরি কৃত্রিমভাবে স্ফীত বাজার একটা সময় চুপসে যেতে যে বাধ্য, সেটা যেন কেউ বিবেচনায় নিতে চাচ্ছিল না। অথচ ডিসেম্বর মাসে তা-ই ঘটল। একদিন তো রীতিমতো ধস নামল। সমস্যাটা দেখা দিল নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রকদের অস্থিরতায়। তারা আবার বাজারকে দ্রুত বাড়ানোর জন্য বা ঠেকা দেওয়ার জন্য কিছু নীতি-বিধি পাল্টে ফেলে। এতে করে একটা সংকেত দেওয়া হয় যে বাজার পড়লেও ক্ষতি নেই, সরকারই তা উঠিয়ে দেবে। আর এভাবেই বাজারের সংশোধন-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। যে কারণে জানুয়ারি মাসে টানা পাঁচ দিন দরপতনের পর ষষ্ঠ দিনে নামল ধস। তার পরের কার্যদিবসে ৫০ মিনিট লেনদেন হতেই তা স্থগিত করা হলো বিরাট দরপতনের আশঙ্কায়। বেধে গেল তুমুল হইচই। ফলে মঙ্গলবার সকালে দুই ঘণ্টার মধ্যেই ডিএসইর মূল্যসূচক লাফ দিয়ে বাড়ল প্রায় এক হাজার পয়েন্ট।
অর্থাৎ পুঁজিবাজার যে বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় ও পরিপক্ব হয়, তা যেন কেউ মানতে নারাজ। বরং সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারকে একটি চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। বড় পুঁজির মালিকেরা এই বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে মোটা মুনাফা তুলে নিল। বিভ্রান্ত-আতঙ্কিত ছোট বিনিয়োগকারীরা খোয়াল তাদের স্বল্প পুঁজি। এর প্রতিকার কী?
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments