বোরো ধান বাজারে-স্বস্তির ফলনে অস্বস্তির বীজ

শুক্রবার সমকাল ও প্রথম আলো বোরো ধানের বাম্পার ফলনের খবর প্রকাশ করেছে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। সমকালের খবরে বিশেষভাবে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের খবর। প্রথম আলোতে রয়েছে ময়মনসিংহ, শেরপুর ও সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকার চিত্র। বোরো ধানের মৌসুম এখন খাদ্যশস্যের প্রধান মৌসুম হয়ে উঠেছে।


খাদ্য চাহিদার অর্ধেকের বেশি মেলে এ সময়ে। ধান কাটার পুরোদস্তুর মৌসুম শুরু হতে আরও কয়েকটি দিন বাকি। ইতিমধ্যে অপেক্ষাকৃত নিচু জমির ধান কাটা শুরু হয়েছে। বাজারে এ ধানের দাম অপেক্ষাকৃত কম। সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'প্রতি মণ ধানের উৎপাদন ব্যয় ১৮ টাকা, প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে দশ টাকা।' বাজারে মোটা চালের দামও যথেষ্ট কম। চালের ক্রেতাদের জন্য এ চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী, যাদের মাসের মোট ব্যয়ের ৭০-৮০ শতাংশ চলে যায় খাদ্য কিনতে তারা খানিকটা স্বস্তিতে আছে। তারা হয়তো খানিকটা আক্ষেপ করেই বলছে_ সারা বছর যদি এমন অবস্থা বিরাজ করত! কিন্তু মুদ্রার অপর দিকও দেখা দরকার। ধানের উৎপাদনে জড়িত বিপুলসংখ্যক কৃষক যদি লোকসান দিয়ে শ্রমে-ঘামে ফলানো ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় তার বিরূপ পড়ে তাদের নিজেদের জীবনযাপনে এবং একই সঙ্গে অর্থনীতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে ধান, আলু, পেঁয়াজ, সবজি প্রভৃতি কৃষিপণ্যের উৎপাদক কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন বোরো মৌসুমেও সেটা ঘটতে চলেছে, এমন আশঙ্কাই প্রকট। এভাবে চলতে থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় কৃষকরা উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে_ অর্থনীতির তত্ত্ব সেটাই বলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চালের ক্রেতারা এগিয়ে আসবে না। শহর ও গ্রামের বিপুলসংখ্যক নির্দিষ্ট আয়ের স্বল্পবিত্ত মানুষ সস্তায় চাল-সবজি-মসলা কিনতে পারলে খুশি থাকবে। কিন্তু উৎপাদকরা বঞ্চিত হতে থাকলে তাদের হাতে শিল্পজাত বিভিন্ন পণ্য কেনার মতো অর্থ থাকে না, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা-ঘরবাড়ি সংস্কার বা নির্মাণের মতো অপরিহার্য কাজে ব্যয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। অ-কৃষক জনগোষ্ঠীকে স্বল্পমূল্যে খাদ্য জোগান দিয়ে চলার দায় কি কেবল তাদেরই_ এ প্রশ্ন হাল আমলে উঠছে। তবে এমন পরিস্থিতি অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। এ অবস্থায় সরকারের জন্য জরুরি কাজ হচ্ছে বাজারে হস্তক্ষেপ করা। আপদকালীন খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার জন্য সরকার প্রতি বছর বাজার থেকে ধান-চাল-গম সংগ্রম করে। দেশের বাজারে পর্যাপ্ত শস্য না মিললে আমদানি করেও এটা করা হয়। কিন্তু এখন বিশ্ববাজারে চালের দাম চড়া এবং দেশের বাজারে সস্তা। তদুপরি বাজারে ধান-চালের দাম খুব পড়ে যাওয়ায় কৃষকরা বড় ধরনের লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন। সরকার যদি উপযুক্ত সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে দেশের বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করে, তাহলে কৃষকের মুখের বাম্পার ফলনের হাসি মিলিয়ে যাবে না। মৌসুমের শুরুতে এ পদক্ষেপ দরিদ্র চাষিদের জন্য বিশেষ সহায়ক হবে। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে একটা ঝুঁকি অবশ্যই থাকে_ বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়া, যা ক্রেতাদের জন্য অস্বস্তির এবং কখনও কখনও তা থেকে জন্ম নেয় ক্ষোভের। কিন্তু অর্থনীতির সম্ভাবনার দিকটি বিবেচনায় রাখলে এ পথের বিকল্প নেই। সরকারকে কৃষি উপকরণের মূল্য ক্ষুদ্র চাষিদের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার বিষয়েও যত্নবান থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.