গন্তব্য ঢাকা-জল, মাটি আর খেতের স্মৃতি by শর্মিলা সিনড্রেলা
কয়েকটি মাত্র টিনের ঘর, দূর-দূরান্তে আর কোনো বাড়ি নেই। চারপাশে সবুজ খেত, পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলভরা নদী আর মাথার ওপর সীমান্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। গ্রামের কথা বললে এমন সৌন্দর্যময় দৃশ্যই ভেসে আসে মনের চোখে। আর মোহাম্মদ মুসলেমের স্মৃতিতে এসব দৃশ্যের অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে আরও কিছু মুহূর্ত।
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় একটি স্মৃতি হলো সেই সময়টি, যখন ধানখেতে জন্মে থাকত সারি সারি ইরি ধানের গাছ। তখন মাঠে পানি দেওয়ার জন্য পাশে রাখা হতো মেশিন। পুরো মাঠে ছড়িয়ে যেত সেই মেশিনে তোলা পানি। পাশে জেগে থাকা ছোট ছোট বাড়িকে দ্বীপের মতো মনে হতো। তখন ছোট্ট মুসলেম আর তার সব সময়ের খেলার সাথি শহীদ লুটোপুটি খেলত ধানগাছ লাগানো সেই মাঠে; জলের স্রোতে। কী মজাই না পেত তারা! এখনো সেই ইরি ধানের গাছ, জলের ধারা, দ্বীপের মতো বাড়ি—সবই আছে; নেই কেবল সেই সময়টা। আজ সবকিছুই বদলে গেছে।
শীতের তীব্রতায় পথে ধোঁয়া ওঠা কোনো খাবার দেখলেই পথচারীর জিভে জল আসে—এটাই মুসলেমের কাম্য। কেননা, তাঁর কাছেও পাওয়া যায় ধোঁয়া ওঠা খাবার। শীত যত বাড়ে, বিক্রিও তত বাড়ে, আর শীত কমলে বিক্রিও কমে যায় আনুপাতিক হারে। রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সামনের ফুটপাতে রোজই ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা নিয়ে বসেন মুসলেম। বেলা তিনটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি ভোক্তাদের সেবা দিয়ে চলেন নির্বিকারভাবে।
মুসলেমের বাবা রজব আলী করেছিলেন তিন বিয়ে। মুসলেমের মা কাঞ্চন ছিলেন দ্বিতীয় বউ। সব মিলিয়ে পাঁচ ভাই, দুই বোন হলেও আদর-সোহাগের কমতি ছিল না মুসলেমের। কিন্তু বিধি বাম! মা মারা গেলেন ছোটবেলাতেই। বাবা আবার বিয়ে করলেন। পরবর্তী সময়ে বড় ভাই আর ছোট ভাইদের সঙ্গে তেমন বনিবনা হলো না। তাই থাকতে হলো ঢাকাতেই। ১৯৮২ সাল থেকে ঢাকায় থাকেন মুসলেম।
মুসলেম নিজের দুঃখগাথা বর্ণনা করছিলেন এভাবে, ‘১৯৬৮ সালে আমার জন্ম। আমার বয়স যহন ১৪, তহন আমার এক ফুপু আমাকে ঢাকায় নিয়ে আইছে। তারপর আমারে ক্যানটিনে কাজে লাগাইছে। অনেক দিন পর আমি সেই কাজ ছাইরা ফজলুল হক হলের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) ক্যানটিনে কাজ নিছি। আমার ছোট ভাই মান্নানও সেখানে কাজ নিছে কিছুদিন পর। সেখানে আমার সাথে ভাইয়ের ঝামেলা হইছিল দেইখ্যা আমি সেই কাজ ছেড়ে দিছি ২০০৭ সালে। অহন শুধু এই পিঠার ব্যবসাই করি।’
গ্রামে যেতে খুব ইচ্ছে হয় মো. মুসলেমের। ওখানেই তাঁর স্ত্রী কাজল রেখা ও আদরের সন্তান সোহাগ, দিনার, আনোয়ার আর ২৬ মাসের মেয়ে এপি থাকে। কিন্তু কীভাবে সেখানে যাবেন তিনি; ভাইয়েরা যে বিরোধিতা করেন! আবার ঢাকায় আনলেই বা কীভাবে রাখবেন স্ত্রী-সন্তানকে? ঢাকায় ছয়জনের সংসার তো একার আয়ে চালানো সম্ভব নয়। তাই সারাক্ষণই একধরনের দুশ্চিন্তায় ভোগেন মোহাম্মদ মুসলেম। মুসলেম বলেন, ‘কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানার চান্দলা ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রামে আমাগো বাড়ি। ভাইদের ওপর রাগ করে অনেক দিন বাড়িত যাইনি। কোরবানির ঈদে তিন বছর পর বাড়িত গেছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা শহরে। আগে ওখানে যেয়ে বউ-বাচ্চার লগে দেখা করতাম। আবার কখনো শালার বাড়িতে দেখা করতাম।’
প্রতি মাসেই বাড়ি টাকা পাঠিয়ে দেন মোহাম্মদ মুসলেম। ছেলেমেয়েরা তো ছোট, ওরা কেউ কোনো কাজ করে না। এখন শীত বেশি। তাই এখন প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকার মতো আয় হয়। কিন্তু শীত একটু কমলেই তো আয় নেমে আসে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। আর শীত যখন একেবারেই চলে যায়, তখন খুঁজতে হয় অন্য ব্যবসা—কখনো কমলা আবার কখনো পেয়ারা বা আমের।
ঢাকায় একা একা থাকতে কষ্টই হয় মুসলেমের। কিন্তু বাড়ি গেলেও ভাইদের সঙ্গে ঝামেলা হয় বলে খুব খারাপ লাগে। স্ত্রী-সন্তান-ভাইদের সঙ্গে মিলেমিশে গ্রামেই থাকতে চান মুসলেম।
বিকেল হয়ে এসেছে। তাই ক্রেতার সমাগমও বেড়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজন এসে খেয়েছে এবং নিয়ে গেছে পিঠা। প্রতিটি পিঠা পাঁচ টাকা। কিন্তু এভাবে কত দিন? গ্রামে ফেরার টানটা মনের মধ্যে প্রবল। কিন্তু ভাইদের সহযোগিতা না পেলে সেটা কি সম্ভব? তা না হলে বউ-ছেলেমেয়েকে ঢাকায় আনতে হবে। তখন তো এই আয় দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। তাহলে? একটা ছোট হোটেল খোলার স্বপ্ন দেখেন মুসলেম। তাহলে হয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে।
শীতের তীব্রতায় পথে ধোঁয়া ওঠা কোনো খাবার দেখলেই পথচারীর জিভে জল আসে—এটাই মুসলেমের কাম্য। কেননা, তাঁর কাছেও পাওয়া যায় ধোঁয়া ওঠা খাবার। শীত যত বাড়ে, বিক্রিও তত বাড়ে, আর শীত কমলে বিক্রিও কমে যায় আনুপাতিক হারে। রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সামনের ফুটপাতে রোজই ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা নিয়ে বসেন মুসলেম। বেলা তিনটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি ভোক্তাদের সেবা দিয়ে চলেন নির্বিকারভাবে।
মুসলেমের বাবা রজব আলী করেছিলেন তিন বিয়ে। মুসলেমের মা কাঞ্চন ছিলেন দ্বিতীয় বউ। সব মিলিয়ে পাঁচ ভাই, দুই বোন হলেও আদর-সোহাগের কমতি ছিল না মুসলেমের। কিন্তু বিধি বাম! মা মারা গেলেন ছোটবেলাতেই। বাবা আবার বিয়ে করলেন। পরবর্তী সময়ে বড় ভাই আর ছোট ভাইদের সঙ্গে তেমন বনিবনা হলো না। তাই থাকতে হলো ঢাকাতেই। ১৯৮২ সাল থেকে ঢাকায় থাকেন মুসলেম।
মুসলেম নিজের দুঃখগাথা বর্ণনা করছিলেন এভাবে, ‘১৯৬৮ সালে আমার জন্ম। আমার বয়স যহন ১৪, তহন আমার এক ফুপু আমাকে ঢাকায় নিয়ে আইছে। তারপর আমারে ক্যানটিনে কাজে লাগাইছে। অনেক দিন পর আমি সেই কাজ ছাইরা ফজলুল হক হলের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) ক্যানটিনে কাজ নিছি। আমার ছোট ভাই মান্নানও সেখানে কাজ নিছে কিছুদিন পর। সেখানে আমার সাথে ভাইয়ের ঝামেলা হইছিল দেইখ্যা আমি সেই কাজ ছেড়ে দিছি ২০০৭ সালে। অহন শুধু এই পিঠার ব্যবসাই করি।’
গ্রামে যেতে খুব ইচ্ছে হয় মো. মুসলেমের। ওখানেই তাঁর স্ত্রী কাজল রেখা ও আদরের সন্তান সোহাগ, দিনার, আনোয়ার আর ২৬ মাসের মেয়ে এপি থাকে। কিন্তু কীভাবে সেখানে যাবেন তিনি; ভাইয়েরা যে বিরোধিতা করেন! আবার ঢাকায় আনলেই বা কীভাবে রাখবেন স্ত্রী-সন্তানকে? ঢাকায় ছয়জনের সংসার তো একার আয়ে চালানো সম্ভব নয়। তাই সারাক্ষণই একধরনের দুশ্চিন্তায় ভোগেন মোহাম্মদ মুসলেম। মুসলেম বলেন, ‘কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানার চান্দলা ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রামে আমাগো বাড়ি। ভাইদের ওপর রাগ করে অনেক দিন বাড়িত যাইনি। কোরবানির ঈদে তিন বছর পর বাড়িত গেছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা শহরে। আগে ওখানে যেয়ে বউ-বাচ্চার লগে দেখা করতাম। আবার কখনো শালার বাড়িতে দেখা করতাম।’
প্রতি মাসেই বাড়ি টাকা পাঠিয়ে দেন মোহাম্মদ মুসলেম। ছেলেমেয়েরা তো ছোট, ওরা কেউ কোনো কাজ করে না। এখন শীত বেশি। তাই এখন প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকার মতো আয় হয়। কিন্তু শীত একটু কমলেই তো আয় নেমে আসে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। আর শীত যখন একেবারেই চলে যায়, তখন খুঁজতে হয় অন্য ব্যবসা—কখনো কমলা আবার কখনো পেয়ারা বা আমের।
ঢাকায় একা একা থাকতে কষ্টই হয় মুসলেমের। কিন্তু বাড়ি গেলেও ভাইদের সঙ্গে ঝামেলা হয় বলে খুব খারাপ লাগে। স্ত্রী-সন্তান-ভাইদের সঙ্গে মিলেমিশে গ্রামেই থাকতে চান মুসলেম।
বিকেল হয়ে এসেছে। তাই ক্রেতার সমাগমও বেড়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজন এসে খেয়েছে এবং নিয়ে গেছে পিঠা। প্রতিটি পিঠা পাঁচ টাকা। কিন্তু এভাবে কত দিন? গ্রামে ফেরার টানটা মনের মধ্যে প্রবল। কিন্তু ভাইদের সহযোগিতা না পেলে সেটা কি সম্ভব? তা না হলে বউ-ছেলেমেয়েকে ঢাকায় আনতে হবে। তখন তো এই আয় দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। তাহলে? একটা ছোট হোটেল খোলার স্বপ্ন দেখেন মুসলেম। তাহলে হয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে।
No comments