কতদিন হরতাল চলবে, স্পষ্ট করা হোক by ফজলুল বারী
ইলিয়াস আলীর অবস্থান সম্ভবত সরকারের পাশাপাশি বিএনপিও জানে। এরপরও ইলিয়াস আলীর উদ্ধারের নামে সরকারি নাটক আর তার না ফেরা পর্যন্ত হরতাল চালু রাখার বিএনপির সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে দেশের মানুষের উদ্দেশে উভয়পক্ষের সুস্পষ্ট বক্তব্য দরকার।
বিএনপিকে বলতে হবে সব জেনেও কতদিন পর্যন্ত তারা এই হরতাল সিরিজ টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন! হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় কী তাদের পক্ষে হরতাল চালু রাখার দুঃসাহস আছে? চলতি সিরিজ হরতালকে কেন্দ্র করে দেশের লাখ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থী এরই মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।ভোটার অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আবার এই রবি-সোমবারের পরীক্ষা শুক্র-শনিবার নেবার সূচি হয়েছে। আরও হরতাল চলতে থাকলে এ সূচি আরও পাল্টাতে হবে। এসব ক্ষতি যে কতদূর যাবে তা এখনও কেউ জানে না! ছুটির দিনে ছাত্রছাত্রীদের টার্ম ফাইন্যাল পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। অথচ সভ্য ও উন্নত দেশগুলোতে ছুটির দিনে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হোমওয়ার্ক পর্যন্ত দেয়া হয় না। ছুটিতো ছুটিই। এনজয় করার জন্যই তো অবসর আর বিরতি।
কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি ও বিরোধীদল উভয়পক্ষই এসব বিষয়ে উদাসীন, কান্ডজ্ঞানহীন! পাবলিককে তারা খালি দেশের স্বার্থের বুলি আওড়ান! ক্ষমতা পেলে তারা দেশের কী কী উদ্ধার করেন, তা তো এরই মাঝে কারও আর দেখতে-জানতে বাকি নেই! অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের ঢোলটা পর্যন্ত এখন আর বাজাবার লোক নেই। নিজেদের ঢোল তাই নিজেদেরকেই বাজাতে হচ্ছে। পাবলিক এসব শুনে হাসে। সাধে কী আর বলা হয়: ‘‘আপনার (নিজের) ঢাক আপনি (নিজে) পিটাইবে, অপরে পিটাইলে তাহা ফাটিয়া যাইতে পারে!’’
হরতালে দেশের কী কী বিনাশ হয় তা সম্পর্কে নানান মূল্যবান ভাষণ এর আগে আমরা বিএনপির কাছে ঢের শুনেছি, এখন শুনছি আওয়ামী লীগের কাছে! এভাবে পাঁচ বছর পরপর এ দুটি দলের মধ্যে শুধু হরতালের পক্ষে-বিপক্ষের বক্তাদেরই অদলবদল হচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগ হরতালের বিপক্ষে বলছে। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে বিরোধীদলে গেলে সর্বনাশা এই হরতাল যে তারা আর করবে না, তা কিন্তু একবারও বলছে না! একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে গেলে আর হরতাল করবে না। শাসকদলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরে তাতে সংশোধনী দিয়ে বলেন, এটি সাহারা খাতুনের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নয়। এর মানে দাঁড়ায় আগামী দিনেও এই হরতাল চলবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার-কর্মসূচির নামে একটা দেশ এমন অবিরাম নৈরাজ্যের পথে চলতে পারে না। এবার হরতালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহারের কথা বলেছেন, এতে আরও ভীতি ছড়াবে। সরকার এভাবে বরাবর ভীতি ছড়িয়ে বিরোধীদলের হরতাল সফলে সহায়তা করে।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর তার সৃষ্ট র্যাবের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন খালেদা জিয়া। পরে অবশ্য বিএনপি নেতারা তা পালটে একটি বিশেষ সংস্থার কথা বলা শুরু করেন। এক নেতা একটি বিদেশি সংস্থার কথাও বলেছেন। এসব ধারাবাহিক বক্তব্যে নিশ্চিত, আসল খবর তাদের কাছেও আছে। তারা ক্ষমতায় ছিলেন, বিদেশি সংস্থা নিয়ে থাকলে কী হয় তাও জানেন। আমাদের প্রধান এই দলগুলো স্বাধীনতার পর থেকে যার যার ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এসব বিশেষ বাহিনী, সংস্থা, বিদেশি সংস্থা এসবকেই যার যার সুবিধামতো লালন ও অপব্যবহার করে আসছে। আওয়ামী লীগের রক্ষীবাহিনীর অপরাধকে গালি দিয়ে ক্ষমতায় আসা বিএনপি গড়ে তুলেছে র্যাব, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এসব সংস্কৃতি! আওয়ামী লীগ এসবকে গালি দিতে দিতে ক্ষমতায় এসে এসবের একটিকেও খারিজ করেনি। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বেশুমার চলছেই। শুধু বাজেটের প্যারিস কনসোর্টিয়ামের বৈঠকের আগে কিছুদিন বিরতি দেয়া হয়। সে বৈঠকটি হয়ে গেলে আবার সব শুরু হয় মহাসমারোহে! আওয়ামী লীগের নেতারা আজকাল সুযোগ পেলেই ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার এসবের পক্ষে ওয়াজি মাওলানার মতো বয়ান করেন!
বিএনপির ‘লুকিং ফর শত্রুজ’, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের মতো চলতি স্বরাষ্টমন্ত্রী সাহারা খাতুনও ফতোয়া দিয়ে বলেন, আত্মরক্ষার্থে গুলি করার অধিকার আইন শৃংখলা বাহিনীর আছে! এসব কথা বিশ্বাস করলে মানতে হয় দেশটিকে তারা এখনও ভয়ের উপত্যকা করে রাখতে চান।র্যাব দেখলেই নাকি তারা গুলি চালায়! আর ‘‘আত্মরক্ষায় র্যাব চালায় পাল্টা গুলি।’’ সুশাসনের নামে ক্ষমতায় এসে পরপর এই দু’দল বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের বিপদজ্জনক এক সংস্কৃতি চালু করেছে! সে ধারায় হেঁটে আসা নতুন বিপদের নাম ‘গুম’! কেউ এখন নিখোঁজ-গুম হলে আর তার লাশ আর পাওয়া যায় না! বহুদিন পর খালে-বিলে পাওয়ায় যায় পরিত্যক্ত কংকাল!
এক সময় কুষ্টিয়ার সন্ত্রাসী সিরাজ বাহিনী কাউকে খুন করলে কোনো প্রমাণ না রাখতে লাশ কেটে মাগুর মাছের খামারে ফেলে দিত! চুয়াডাঙ্গার লাল্টু বাহিনী লাশ ফেলতো ইটভাঁটিতে! এখন আবার লাশ গুম করার অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে! রাষ্ট্র যেহেতু নিখোঁজ হওয়া মানুষ উদ্ধার করতে পারছে না, তাই এসব অভিযোগ খণ্ডাতেও পারছে না! অথবা আসল সত্য জানে বলে উদ্ধারে মন লাগাচ্ছে না। উদ্ধারের নামে নাটক করছে! যে খরচ হয়ে গেছে সেক্ষেত্রে নাটক করা ছাড়াই বা বা করার আর কীই বা আছে? সে কারণে বিএনপির কমিশনার চৌধুরী আলমের মতো আওয়ামী লীগের ক্যাডার, সাবেক যুবলীগ নেতা লিয়াকতেরও আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি! ইস্কাটনের লিয়াকতকে আওয়ামী লীগের নানান নেতা নানাভাবে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু সে নিখোঁজ-গুম হয়ে যাবার পর কেউ কোথাও একটু উহ-আহ শব্দও করেননি! গত তিন-চার বছরে এমন একশ’র বেশি মানুষ গুম হলেও এসব নিয়ে কখনও হরতাল করেনি বিএনপি! লিমনের পা কাটা গেলেও তারা নিষ্ঠুর-নির্দয়ভাবে নীরব থেকেছে! এখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে লিয়াকতের মতো ইলিয়াসের ঘটনা ঘটলে তারা কী এ নিয়ে টু শব্দটি করতো? বা এখন র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়া কী কোথাও একবার বলেছেন যে, এই বাহিনী গড়ে তিনি ভুল করেছিলেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে আর এটি রাখবেন না, ভেঙ্গে দেবেন! না আগামীতে ক্ষমতায় গেলে এটি দিয়ে আবার দেখে দেখে আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘ইলিয়াস আলী’ বানানোর ফন্দি করা হবে? বিরোধীদলীয় নেত্রী এসব নিয়ে ঝেড়ে কেশে কথা বলছেন না কেন?
হরতাল আমাদের একসময় অনেক কিছু দিয়েছে। এখন শুধু দিচ্ছে ধবংস আর নৈরাজ্য! মুক্তিযুদ্ধের আগে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় হরতালের সঙ্গে যে গণসম্পৃক্ততা ছিলো, তা এখন আর ছিটেফোঁটাও নেই। এখন এসব ধবংসাত্মক হরতালের বিরুদ্ধে সব সময় বলি এই কারণেই যে, যেখানে আমাদের দেশে ওয়ার্কিং ডে’তেই কাজের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, আট ঘন্টার অফিসে চার ঘন্টা কাজও ঠিকমতো হয় না, বিদ্যুত সহ নানা সমস্যায় নষ্ট হয় অনেক কর্ম ঘন্টা, সেখানে দেশের মানুষকে একদিন ঘোষণা দিয়ে কাজ করতে না করতে বলাটাকে আত্মঘাতী মনে হয়। এমনিতে নানা অব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্প-কারখানা ভারতীয় শিল্পকারখানার কাছে মার খাচ্ছে। একমাত্র গার্মেন্টস সেক্টরই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে, এখনকার মতো কাজ করে যেতে পারলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ চীন সহ সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফেছনে ফেলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সারা দুনিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করার কথা, সেখানে এভাবে আজকের বিএনপির আগামীতে আওয়ামী লীগের হরতাল-সিরিজ কিন্তু সব সম্ভাবনাকে গিলে খাবে।
এখন পোল্ট্রির ডিমের মার্কেটটিও যেমন ভারতীয় দখলে চলে যাচ্ছে, এভাবে চললে আগামীতে এই গার্মেন্টস সেক্টরটিও যাবে। সে কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থে হরতালকে ‘কবিরাহ গুনাহ’ বলে ঘোষণা করা উচিত। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একমত না হলে কিন্তু হবে না। আগে আওয়ামী লীগের হরতালে এর নেতাদের বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, নূর হোসেন স্কোয়ার পর্যন্ত আটকে রাখতো বিএনপি, এখন বিএনপির হরতালে এর নেতাদের নয়া পল্টনের অফিসে আটকে রাখে বিএনপি, হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে এই রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য বন্ধ হওয়া দরকার।
সবচেয়ে অমানবিক বিষয় এসব হরতালে সাধারন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়, বন্ধ হয়ে যায় তাদের রু্টিরুজির পথ, জিনিসপত্রের দাম বাড়ালে আরও চাপের মধ্যে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষেরা, ভ্যান-রিকশায় ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াতকে কেন্দ্র অনেকের অফিসে যাতায়াতের খরচও বেড়ে যায়। গত ৩০-৩৫ বছর ধরে এভাবে বড়দলগুলোর ক্ষমতায় যাবার হরতাল প্রতিযোগিতায় এভাবে সাধারণ মানুষ শুধু কষ্টই পেয়েছে! কিন্তু এই সাধারণ মানুষগুলোর জীবনের কষ্টের কথা কেউ কখনো ভাবে না! লেবাননে হিজবুল্লাহ’র সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধে পনের হাজার লোকজনের বাড়িঘর ধবংস হয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে হিজবুল্লাহ’র পক্ষে ওই ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ হাজার পরিবারপিছু দেয়া হয় পনের হাজার ডলার। এর ১২ হাজার ডলার পরিবারগুলোর এক বছরের বিকল্প বাড়িভাড়া, বাকি ৩ হাজার ডলার খাবার সহ জরুরি জিনিসপত্র কেনার জন্য। আমাদের দলগুলো হরতালে যে সাধারণ মানুষজনের রুটিরুজির সংস্থান বন্ধ করে, তাদের জরুরি প্রয়োজন নিয়ে কিছু কখনো ভাবে? গত হরতাল শুরু উপলক্ষে বিএনপির এক বুদ্ধিজীবী তার কলামে লিখেছেন, ‘‘আমরা হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে চাই, কিন্তু বাস পোড়ানোর বিপক্ষে।’’
এসব রাজনৈতিক স্বার্থধান্ধার হরতাল চললে কিন্তু বাস পুড়বেই, আগুনে পুড়ে বদর আলীর মতো শ্রমজীবী মানুষেরা ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যাবেন, তখনও একদল আরেক দলকে দোষারোপ করবে, ইলিয়াস আলী একটি দলের নেতা বলে, বনানীতে বাড়ির মালিক হয়েছেন বলে তার জীবন মূল্যবান! কিন্তু শ্রমজীবী বদর আলীদের জীবন মূল্যহীন—এসব তো রাজনৈতিক শঠতা। ইলিয়াস আলী কোথায় তা জানা সত্ত্বেও বিএনপি হরতাল সিরিজ করছে, সরকার পক্ষ করছে উদ্ধার-নাটক, হরতাল নৈরাজ্যের পাশাপাশি দেশের মানুষের সঙ্গে এসব রাজনৈতিক অসততাও বন্ধ হওয়া দরকার।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি ও বিরোধীদল উভয়পক্ষই এসব বিষয়ে উদাসীন, কান্ডজ্ঞানহীন! পাবলিককে তারা খালি দেশের স্বার্থের বুলি আওড়ান! ক্ষমতা পেলে তারা দেশের কী কী উদ্ধার করেন, তা তো এরই মাঝে কারও আর দেখতে-জানতে বাকি নেই! অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের ঢোলটা পর্যন্ত এখন আর বাজাবার লোক নেই। নিজেদের ঢোল তাই নিজেদেরকেই বাজাতে হচ্ছে। পাবলিক এসব শুনে হাসে। সাধে কী আর বলা হয়: ‘‘আপনার (নিজের) ঢাক আপনি (নিজে) পিটাইবে, অপরে পিটাইলে তাহা ফাটিয়া যাইতে পারে!’’
হরতালে দেশের কী কী বিনাশ হয় তা সম্পর্কে নানান মূল্যবান ভাষণ এর আগে আমরা বিএনপির কাছে ঢের শুনেছি, এখন শুনছি আওয়ামী লীগের কাছে! এভাবে পাঁচ বছর পরপর এ দুটি দলের মধ্যে শুধু হরতালের পক্ষে-বিপক্ষের বক্তাদেরই অদলবদল হচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগ হরতালের বিপক্ষে বলছে। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে বিরোধীদলে গেলে সর্বনাশা এই হরতাল যে তারা আর করবে না, তা কিন্তু একবারও বলছে না! একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে গেলে আর হরতাল করবে না। শাসকদলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরে তাতে সংশোধনী দিয়ে বলেন, এটি সাহারা খাতুনের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নয়। এর মানে দাঁড়ায় আগামী দিনেও এই হরতাল চলবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার-কর্মসূচির নামে একটা দেশ এমন অবিরাম নৈরাজ্যের পথে চলতে পারে না। এবার হরতালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহারের কথা বলেছেন, এতে আরও ভীতি ছড়াবে। সরকার এভাবে বরাবর ভীতি ছড়িয়ে বিরোধীদলের হরতাল সফলে সহায়তা করে।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর তার সৃষ্ট র্যাবের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন খালেদা জিয়া। পরে অবশ্য বিএনপি নেতারা তা পালটে একটি বিশেষ সংস্থার কথা বলা শুরু করেন। এক নেতা একটি বিদেশি সংস্থার কথাও বলেছেন। এসব ধারাবাহিক বক্তব্যে নিশ্চিত, আসল খবর তাদের কাছেও আছে। তারা ক্ষমতায় ছিলেন, বিদেশি সংস্থা নিয়ে থাকলে কী হয় তাও জানেন। আমাদের প্রধান এই দলগুলো স্বাধীনতার পর থেকে যার যার ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এসব বিশেষ বাহিনী, সংস্থা, বিদেশি সংস্থা এসবকেই যার যার সুবিধামতো লালন ও অপব্যবহার করে আসছে। আওয়ামী লীগের রক্ষীবাহিনীর অপরাধকে গালি দিয়ে ক্ষমতায় আসা বিএনপি গড়ে তুলেছে র্যাব, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এসব সংস্কৃতি! আওয়ামী লীগ এসবকে গালি দিতে দিতে ক্ষমতায় এসে এসবের একটিকেও খারিজ করেনি। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বেশুমার চলছেই। শুধু বাজেটের প্যারিস কনসোর্টিয়ামের বৈঠকের আগে কিছুদিন বিরতি দেয়া হয়। সে বৈঠকটি হয়ে গেলে আবার সব শুরু হয় মহাসমারোহে! আওয়ামী লীগের নেতারা আজকাল সুযোগ পেলেই ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার এসবের পক্ষে ওয়াজি মাওলানার মতো বয়ান করেন!
বিএনপির ‘লুকিং ফর শত্রুজ’, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের মতো চলতি স্বরাষ্টমন্ত্রী সাহারা খাতুনও ফতোয়া দিয়ে বলেন, আত্মরক্ষার্থে গুলি করার অধিকার আইন শৃংখলা বাহিনীর আছে! এসব কথা বিশ্বাস করলে মানতে হয় দেশটিকে তারা এখনও ভয়ের উপত্যকা করে রাখতে চান।র্যাব দেখলেই নাকি তারা গুলি চালায়! আর ‘‘আত্মরক্ষায় র্যাব চালায় পাল্টা গুলি।’’ সুশাসনের নামে ক্ষমতায় এসে পরপর এই দু’দল বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের বিপদজ্জনক এক সংস্কৃতি চালু করেছে! সে ধারায় হেঁটে আসা নতুন বিপদের নাম ‘গুম’! কেউ এখন নিখোঁজ-গুম হলে আর তার লাশ আর পাওয়া যায় না! বহুদিন পর খালে-বিলে পাওয়ায় যায় পরিত্যক্ত কংকাল!
এক সময় কুষ্টিয়ার সন্ত্রাসী সিরাজ বাহিনী কাউকে খুন করলে কোনো প্রমাণ না রাখতে লাশ কেটে মাগুর মাছের খামারে ফেলে দিত! চুয়াডাঙ্গার লাল্টু বাহিনী লাশ ফেলতো ইটভাঁটিতে! এখন আবার লাশ গুম করার অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে! রাষ্ট্র যেহেতু নিখোঁজ হওয়া মানুষ উদ্ধার করতে পারছে না, তাই এসব অভিযোগ খণ্ডাতেও পারছে না! অথবা আসল সত্য জানে বলে উদ্ধারে মন লাগাচ্ছে না। উদ্ধারের নামে নাটক করছে! যে খরচ হয়ে গেছে সেক্ষেত্রে নাটক করা ছাড়াই বা বা করার আর কীই বা আছে? সে কারণে বিএনপির কমিশনার চৌধুরী আলমের মতো আওয়ামী লীগের ক্যাডার, সাবেক যুবলীগ নেতা লিয়াকতেরও আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি! ইস্কাটনের লিয়াকতকে আওয়ামী লীগের নানান নেতা নানাভাবে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু সে নিখোঁজ-গুম হয়ে যাবার পর কেউ কোথাও একটু উহ-আহ শব্দও করেননি! গত তিন-চার বছরে এমন একশ’র বেশি মানুষ গুম হলেও এসব নিয়ে কখনও হরতাল করেনি বিএনপি! লিমনের পা কাটা গেলেও তারা নিষ্ঠুর-নির্দয়ভাবে নীরব থেকেছে! এখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে লিয়াকতের মতো ইলিয়াসের ঘটনা ঘটলে তারা কী এ নিয়ে টু শব্দটি করতো? বা এখন র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়া কী কোথাও একবার বলেছেন যে, এই বাহিনী গড়ে তিনি ভুল করেছিলেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে আর এটি রাখবেন না, ভেঙ্গে দেবেন! না আগামীতে ক্ষমতায় গেলে এটি দিয়ে আবার দেখে দেখে আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘ইলিয়াস আলী’ বানানোর ফন্দি করা হবে? বিরোধীদলীয় নেত্রী এসব নিয়ে ঝেড়ে কেশে কথা বলছেন না কেন?
হরতাল আমাদের একসময় অনেক কিছু দিয়েছে। এখন শুধু দিচ্ছে ধবংস আর নৈরাজ্য! মুক্তিযুদ্ধের আগে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় হরতালের সঙ্গে যে গণসম্পৃক্ততা ছিলো, তা এখন আর ছিটেফোঁটাও নেই। এখন এসব ধবংসাত্মক হরতালের বিরুদ্ধে সব সময় বলি এই কারণেই যে, যেখানে আমাদের দেশে ওয়ার্কিং ডে’তেই কাজের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, আট ঘন্টার অফিসে চার ঘন্টা কাজও ঠিকমতো হয় না, বিদ্যুত সহ নানা সমস্যায় নষ্ট হয় অনেক কর্ম ঘন্টা, সেখানে দেশের মানুষকে একদিন ঘোষণা দিয়ে কাজ করতে না করতে বলাটাকে আত্মঘাতী মনে হয়। এমনিতে নানা অব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্প-কারখানা ভারতীয় শিল্পকারখানার কাছে মার খাচ্ছে। একমাত্র গার্মেন্টস সেক্টরই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে, এখনকার মতো কাজ করে যেতে পারলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ চীন সহ সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফেছনে ফেলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সারা দুনিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করার কথা, সেখানে এভাবে আজকের বিএনপির আগামীতে আওয়ামী লীগের হরতাল-সিরিজ কিন্তু সব সম্ভাবনাকে গিলে খাবে।
এখন পোল্ট্রির ডিমের মার্কেটটিও যেমন ভারতীয় দখলে চলে যাচ্ছে, এভাবে চললে আগামীতে এই গার্মেন্টস সেক্টরটিও যাবে। সে কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থে হরতালকে ‘কবিরাহ গুনাহ’ বলে ঘোষণা করা উচিত। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একমত না হলে কিন্তু হবে না। আগে আওয়ামী লীগের হরতালে এর নেতাদের বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, নূর হোসেন স্কোয়ার পর্যন্ত আটকে রাখতো বিএনপি, এখন বিএনপির হরতালে এর নেতাদের নয়া পল্টনের অফিসে আটকে রাখে বিএনপি, হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে এই রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য বন্ধ হওয়া দরকার।
সবচেয়ে অমানবিক বিষয় এসব হরতালে সাধারন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়, বন্ধ হয়ে যায় তাদের রু্টিরুজির পথ, জিনিসপত্রের দাম বাড়ালে আরও চাপের মধ্যে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষেরা, ভ্যান-রিকশায় ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াতকে কেন্দ্র অনেকের অফিসে যাতায়াতের খরচও বেড়ে যায়। গত ৩০-৩৫ বছর ধরে এভাবে বড়দলগুলোর ক্ষমতায় যাবার হরতাল প্রতিযোগিতায় এভাবে সাধারণ মানুষ শুধু কষ্টই পেয়েছে! কিন্তু এই সাধারণ মানুষগুলোর জীবনের কষ্টের কথা কেউ কখনো ভাবে না! লেবাননে হিজবুল্লাহ’র সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধে পনের হাজার লোকজনের বাড়িঘর ধবংস হয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে হিজবুল্লাহ’র পক্ষে ওই ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ হাজার পরিবারপিছু দেয়া হয় পনের হাজার ডলার। এর ১২ হাজার ডলার পরিবারগুলোর এক বছরের বিকল্প বাড়িভাড়া, বাকি ৩ হাজার ডলার খাবার সহ জরুরি জিনিসপত্র কেনার জন্য। আমাদের দলগুলো হরতালে যে সাধারণ মানুষজনের রুটিরুজির সংস্থান বন্ধ করে, তাদের জরুরি প্রয়োজন নিয়ে কিছু কখনো ভাবে? গত হরতাল শুরু উপলক্ষে বিএনপির এক বুদ্ধিজীবী তার কলামে লিখেছেন, ‘‘আমরা হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে চাই, কিন্তু বাস পোড়ানোর বিপক্ষে।’’
এসব রাজনৈতিক স্বার্থধান্ধার হরতাল চললে কিন্তু বাস পুড়বেই, আগুনে পুড়ে বদর আলীর মতো শ্রমজীবী মানুষেরা ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যাবেন, তখনও একদল আরেক দলকে দোষারোপ করবে, ইলিয়াস আলী একটি দলের নেতা বলে, বনানীতে বাড়ির মালিক হয়েছেন বলে তার জীবন মূল্যবান! কিন্তু শ্রমজীবী বদর আলীদের জীবন মূল্যহীন—এসব তো রাজনৈতিক শঠতা। ইলিয়াস আলী কোথায় তা জানা সত্ত্বেও বিএনপি হরতাল সিরিজ করছে, সরকার পক্ষ করছে উদ্ধার-নাটক, হরতাল নৈরাজ্যের পাশাপাশি দেশের মানুষের সঙ্গে এসব রাজনৈতিক অসততাও বন্ধ হওয়া দরকার।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
No comments