সুদান-গণভোটেই ভাগ্য নির্ধারিত by কাজী জহিরুল ইসলাম

আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশের সম্মান আর থাকছে না সুদানের ললাটে। সুদানের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দক্ষিণ সুদানের রাজনৈতিক দল সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্টের নেতা সালভা কির মায়ারদিতের নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন দেশ দক্ষিণ সুদান।


সুদান ভাঙবে না অখণ্ড থাকবে—এই প্রশ্নে দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ২০০৫ সালে দুই পক্ষ একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির মূল অংশই ছিল আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার প্রশ্নে দক্ষিণ সুদানিদের গণভোট। অবশেষে সুদান সরকার আয়োজন করেছে গণভোট। সাত দিনব্যাপী আয়োজিত গণভোট শুরু হয়েছে ৯ জানুয়ারি, চলে ১৫ তারিখ পর্যন্ত। তিন দিনের মাথায় গণভোটের বৈধতার শর্ত ৬০ শতাংশ ভোট গ্রহণ হয়ে গেছে। লৌহমানবখ্যাত ২৬ বছর ধরে সুদানের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির বলেছেন, ‘গণভোটের ফলাফল যা-ই হোক, আমি তা মেনে নেব।’ বিশ্বনেতৃত্ব তাঁর এই উদার আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছেন। যদিও নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট বশির দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবা পরিদর্শনে যান এবং ফিরে এসে প্রেসকে জানান, একটি দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের একতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং যোগ্যতা থাকা দরকার, তা দক্ষিণ সুদানের নেই। দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলে ওখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে, যার প্রভাব উত্তরাংশে এসে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। দেশবাসীকে একতার আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির অখণ্ডতার পক্ষে ভোট দিতে অনুরোধ করেন।
সারা সুদানেই একযোগে ভোট গ্রহণ চলছে। দক্ষিণ সুদানের অধিবাসী যিনি যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, এই গণভোটে অংশ নিতে পারছেন। এমনকি সুদানের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী দক্ষিণ সুদানিরা এই গণভোটে অংশ নিতে পারছেন। গতকাল ভোটাভুটি শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এটা এখন শতভাগ নিশ্চিত যে ‘দক্ষিণ সুদান’ অথবা ‘নতুন সুদান’ নামের এটি নতুন দেশ আর মাত্র দুই দিন পরই জন্ম নিতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ২৫ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ছয় লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড।
সম্প্রতি সুদানে তেল আবিষ্কারের ফলে দেশটির অর্থনীতি কিছুটা চাঙা হয়ে ওঠে। ৮৩ লাখ মানুষের দেশ সুদানের গড় মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪০০ ডলার এবং জিডিপির গ্রোথ রেট ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশটির প্রধান খনিজ সম্পদ এখন জ্বালানি তেল, যার ৭৫ শতাংশই দক্ষিণ সুদানে অবস্থিত, যদিও শোধনাগারগুলো অবস্থিত উত্তর সুদানে। সুদান প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। গণভোটের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ সুদান আলাদা রাষ্ট্র হয়ে গেলেও তেলসমৃদ্ধ একটি প্রভিন্স ‘আবিই’র বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি। দক্ষিণ সুদানের নেতৃত্ব মনে করছেন, উত্তরের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি সন্তোষজনক সমাধানে আসা যাবে।
উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসক দক্ষিণ সুদানকে উত্তর সুদানের হাতে তুলে দেয়; যার পেছনে ছিল মিসরীয়দের সমর্থন। মুসলিম-অধ্যুষিত উত্তর সুদানের অধিবাসীরা মূলত সেমেটিক। কয়েক জেনারেশন আগে মিসর থেকে আসা আরব্য অধিবাসীদের সঙ্গে নেটিভ সুদানিদের মিলনের ফলে মিশ্র বর্ণের মানুষ সৃষ্টি হয়। এই মিশ্র বর্ণের মানুষজনও নিজেদের আরব গোত্রভুক্ত মনে করে। সারা সুদানে এই সম্প্রদায়ের লোকজনই প্রভাবশালী। দক্ষিণীরা কালো আফ্রিকান। এনিমিস্ট এবং পরে এক বৃহৎ অংশ ধর্মান্তরিত ক্যাথলিক। আরব শাসকেরা দক্ষিণের উন্নয়নে মোটেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে তারা বারবার আলাদা হওয়ার প্রশ্নে আন্দোলনে নেমেছে।
খ্রিষ্টান ও এনিমিস্ট-অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদানে নানা ট্রাইবের বসবাস। ডিস্কা, নুয়ের ও শিলুক উল্লেখযোগ্য ট্রাইব হলেও ডিস্কারাই সংখ্যাধিক্য ও প্রভাবশালী। পুরো সুদানের ৫ শতাংশ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষের প্রায় সবারই বাস দক্ষিণ সুদানে। দক্ষিণ সুদানে তেমন কোনো অবকাঠামো ও ইনস্টিটিউশন নেই। ৪০ কিলোমিটারও পাকা রাস্তা নেই সেখানে। জনসংখ্যার প্রায় সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। যদিও উত্তরের চেয়ে দক্ষিণের ভূমি উর্বর, জলবায়ু অপেক্ষাকৃত আর্দ্র ও শীতল। এ রকম অবস্থা থেকে দক্ষিণ সুদানকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দরকার যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং প্রচুর অর্থের জোগান। সালভা কির কি পারবেন সেই কঠিন কাজটি করতে? যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন রয়েছে সালভা কিরের প্রতি। সুদানকে আমেরিকার স্যাংশন দেওয়ার পর হুড়মুড় করে চায়নিজ কোম্পানিগুলো সুদানে ঢুকে পড়ে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের দখল নিয়ে নেয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণ সুদানকে বিভক্ত করে সেখানে ঢোকা মার্কিনদের জন্য খুব দরকার ছিল।
গণভোট ১৫ জানুয়ারি শেষ হলেও ফল প্রকাশ করা হবে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর মুদ্রাসহ অন্য বিষয়গুলো ফয়সালা করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দক্ষিণ সুদানকে পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করতে প্রায় ছয় মাস লেগে যাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
দারফুর, সুদান থেকে
কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.