বঞ্চনা-একজন মা ও একটি সরকারি হাসপাতাল by জোবাইদা নাসরীন
সরকারি কর্মজীবী নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হলো। একজন নারী তাঁর কর্মজীবনে সর্বোচ্চ দুবার এই ছুটি ভোগ করতে পারবেন। ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর উদ্দেশ্য, পূর্ণ ছয় মাসই যেন একটি শিশু মায়ের দুধ পায় আর শিশুর মৃত্যুহার যাতে কমে। তবে এই ছুটি
নারীর জন্য কল্যাণকর হবে, নাকি নারীর পদোন্নতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা তৈরি করবে, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। মাতৃত্বকালে নারী ছয় মাস ছুটিতে থাকবেন অর্থাৎ একটি বড় সময় শ্রম দিতে পারবেন না—এই অজুহাতে পিতৃতান্ত্রিক শ্রমদুনিয়ায় নারীর চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে নারীর নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এটি যেন কোনো অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়। কোনো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বৈষম্যের কারণে কোনো মা কিংবা সন্তান যেন অবহেলিত না হন, এ বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।
সেদিন প্রথম আলোর তৃতীয় পাতায় প্রকাশিত একটি খবরে দেখলাম, তাতে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে নারীর আপাত স্বস্তি হোঁচট খায়। সংবাদটি ছোট পরিসরে ছাপা হলেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এক নবজাতক ও মাকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে না রেখে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বারান্দায়। অপারেশন হওয়া মা ও নবজাতক কনকনে শীতের মধ্যে বারান্দাতেই কাটায়। রোগীর থাকার জায়গা পরিবর্তনের কারণ, সেখানকার চিকিৎসকেরা জানতে পেরেছিলেন, সদ্য মা হওয়া নারীটি একজন যৌনকর্মী। এই অমানবিক ঘটনটি ঘটেছে দেশের সবচেয়ে নামী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (প্রথম আলো ১২ জানুয়ারি)। বোঝা যায়, মায়েদের জন্য আন্তরিক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও একজন মায়ের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা নানাভাবে নিরাপদ মাতৃত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিষয়টি অবগত ছিলেন। এই মাকে আলাদা রাখার কারণ হিসেবে তিনি হাজির করেছেন যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি/এইডসসহ যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ থাকার আশঙ্কাকে। অন্য শিশু ও প্রসূতি মায়েদের যাতে কোনো ঝুঁকিতে পড়তে না হয়, সে জন্য ওই মাকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা। চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগীর প্রতি এমন অসংবেদনশীলতা একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
হতে পারেন তিনি একজন যৌনকর্মী, তাতে সমস্যা কোথায়? তিনি একজন মা, তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন। সুচিকিৎসা পাওয়া তাঁর মৌলিক অধিকার। একটি সরকারি হাসপাতাল তাঁর এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সব করবে—এ রকমই তো হওয়ার কথা। চিকিৎসক হয়ে কারও এইচআইভি/এইডস আছে কি না, তা পরীক্ষা না করেই সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক অচরণ করার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? সেই মায়ের যদি এইচআইভি/এইডস থেকেও থাকে, তবু তো তাঁর প্রতি এমন আচরণ চলতে পারে না। এটা তো সবার আগে চিকিৎসকেরই জানার কথা।
একজন রোগীর পেশা নিঃসন্দেহে তাঁর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা কিংবা বাড়তি সুবিধা তৈরি করতে পারে না। চিকিৎসকেরা তাঁদের সাধ্যমতো সবাইকে চিকিৎসা দেবেন। যৌনকর্মী হলে তাঁর প্রতি বৈষম্য করা হবে—আইনের কোথাও এ রকম লেখা নেই। চিকিৎসক হিসেবে কীভাবে তিনি এমন ব্যবস্থা নিতে পারলেন! রোগের ধারণা করে কি কোনো চিকিৎসক রোগীকে ওষুধ দেন? আর নবজাতকের বেলায়? যৌনকর্মীর জঠরে জন্মেছে—এ-ই তার অপরাধ? জন্মেই বৈষম্যের শিকার। যে সন্তান মানুষের, তাকে কীভাবে ওয়ার্ড থেকে খোলা বারান্দায়, ঠান্ডা বাতাসে রাখার মতো সিদ্ধান্ত চিকিৎসক নিতে পারলেন? তাহলে কার সেবা করেন তাঁরা?
শিশুমৃত্যুর হার কমানো কিংবা নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকার যত আইনি ব্যবস্থাই করুক না কেন, তা বাস্তবায়ন করতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে। না হলে এসব পদক্ষেপ নারীর জন্য অর্থবহ হয়ে উঠবে না।
বাংলাদেশ সরকারের জন্য শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এমন ঘটনা সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পথে বড় হুমকি। বাংলাদেশের জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের ৫ নম্বর লক্ষ্য, ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুহার প্রতি লাখে ৫৭০ (১৯৯০ সালের তথ্য) জন থেকে কমিয়ে ১৪৪ জনে নামিয়ে আনা। শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও মাতৃমৃত্যুহার তেমন কমেনি। এ লক্ষ্য অর্জনে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এখনো এক লাখ গর্ভবতী মায়ের মধ্যে ৩৫১ জনই প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেন। সেই হিসাবে দেশে প্রতিবছর প্রসবকালেই প্রায় ২০ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও প্রায় ছয় লাখ নারী প্রসবজনিত নানা সমস্যায় ভোগেন। এভাবে চললে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুহার দাঁড়াবে প্রতি লাখে ৩১০ জন। মায়েদের প্রতি নানা ধরনের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও এর পেছনে কাজ করছে, যার অনেকগুলো চিত্রের একটিমাত্র আমরা পত্রিকায় পড়েছি।
তাই আইন ও পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি এই বিষয়গুলো নিয়ে সবার সচেতনতা তৈরিতে সদা তৎপর থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরই আগে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতার সঙ্গে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং নারীর নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য প্রয়োজন অধিক সচেতনতা ও সামাজিক পদক্ষেপ।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
সেদিন প্রথম আলোর তৃতীয় পাতায় প্রকাশিত একটি খবরে দেখলাম, তাতে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে নারীর আপাত স্বস্তি হোঁচট খায়। সংবাদটি ছোট পরিসরে ছাপা হলেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এক নবজাতক ও মাকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে না রেখে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বারান্দায়। অপারেশন হওয়া মা ও নবজাতক কনকনে শীতের মধ্যে বারান্দাতেই কাটায়। রোগীর থাকার জায়গা পরিবর্তনের কারণ, সেখানকার চিকিৎসকেরা জানতে পেরেছিলেন, সদ্য মা হওয়া নারীটি একজন যৌনকর্মী। এই অমানবিক ঘটনটি ঘটেছে দেশের সবচেয়ে নামী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (প্রথম আলো ১২ জানুয়ারি)। বোঝা যায়, মায়েদের জন্য আন্তরিক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও একজন মায়ের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা নানাভাবে নিরাপদ মাতৃত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিষয়টি অবগত ছিলেন। এই মাকে আলাদা রাখার কারণ হিসেবে তিনি হাজির করেছেন যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি/এইডসসহ যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ থাকার আশঙ্কাকে। অন্য শিশু ও প্রসূতি মায়েদের যাতে কোনো ঝুঁকিতে পড়তে না হয়, সে জন্য ওই মাকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা। চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগীর প্রতি এমন অসংবেদনশীলতা একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
হতে পারেন তিনি একজন যৌনকর্মী, তাতে সমস্যা কোথায়? তিনি একজন মা, তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন। সুচিকিৎসা পাওয়া তাঁর মৌলিক অধিকার। একটি সরকারি হাসপাতাল তাঁর এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সব করবে—এ রকমই তো হওয়ার কথা। চিকিৎসক হয়ে কারও এইচআইভি/এইডস আছে কি না, তা পরীক্ষা না করেই সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক অচরণ করার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? সেই মায়ের যদি এইচআইভি/এইডস থেকেও থাকে, তবু তো তাঁর প্রতি এমন আচরণ চলতে পারে না। এটা তো সবার আগে চিকিৎসকেরই জানার কথা।
একজন রোগীর পেশা নিঃসন্দেহে তাঁর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা কিংবা বাড়তি সুবিধা তৈরি করতে পারে না। চিকিৎসকেরা তাঁদের সাধ্যমতো সবাইকে চিকিৎসা দেবেন। যৌনকর্মী হলে তাঁর প্রতি বৈষম্য করা হবে—আইনের কোথাও এ রকম লেখা নেই। চিকিৎসক হিসেবে কীভাবে তিনি এমন ব্যবস্থা নিতে পারলেন! রোগের ধারণা করে কি কোনো চিকিৎসক রোগীকে ওষুধ দেন? আর নবজাতকের বেলায়? যৌনকর্মীর জঠরে জন্মেছে—এ-ই তার অপরাধ? জন্মেই বৈষম্যের শিকার। যে সন্তান মানুষের, তাকে কীভাবে ওয়ার্ড থেকে খোলা বারান্দায়, ঠান্ডা বাতাসে রাখার মতো সিদ্ধান্ত চিকিৎসক নিতে পারলেন? তাহলে কার সেবা করেন তাঁরা?
শিশুমৃত্যুর হার কমানো কিংবা নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকার যত আইনি ব্যবস্থাই করুক না কেন, তা বাস্তবায়ন করতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে। না হলে এসব পদক্ষেপ নারীর জন্য অর্থবহ হয়ে উঠবে না।
বাংলাদেশ সরকারের জন্য শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এমন ঘটনা সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পথে বড় হুমকি। বাংলাদেশের জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের ৫ নম্বর লক্ষ্য, ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুহার প্রতি লাখে ৫৭০ (১৯৯০ সালের তথ্য) জন থেকে কমিয়ে ১৪৪ জনে নামিয়ে আনা। শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও মাতৃমৃত্যুহার তেমন কমেনি। এ লক্ষ্য অর্জনে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এখনো এক লাখ গর্ভবতী মায়ের মধ্যে ৩৫১ জনই প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেন। সেই হিসাবে দেশে প্রতিবছর প্রসবকালেই প্রায় ২০ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও প্রায় ছয় লাখ নারী প্রসবজনিত নানা সমস্যায় ভোগেন। এভাবে চললে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুহার দাঁড়াবে প্রতি লাখে ৩১০ জন। মায়েদের প্রতি নানা ধরনের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও এর পেছনে কাজ করছে, যার অনেকগুলো চিত্রের একটিমাত্র আমরা পত্রিকায় পড়েছি।
তাই আইন ও পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি এই বিষয়গুলো নিয়ে সবার সচেতনতা তৈরিতে সদা তৎপর থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরই আগে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতার সঙ্গে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং নারীর নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য প্রয়োজন অধিক সচেতনতা ও সামাজিক পদক্ষেপ।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
No comments