ব্যক্তিত্ব-প্রেরণাদায়িনী সোনিয়া by সুভাষ সাহা

যাই হোক ভারতের ক্ষমতার রশিটা যে এখন সোনিয়া গান্ধীর হাতেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী না হয়েও তিনি প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে ইতালির ছোট্ট গ্রামের মেয়েটি ভারতীয়দের কাছে 'দেশ কি বহু' থেকে দেবীতে পরিণত হচ্ছেন


ভারতের শাসক জোট ইউপিএ ও কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধী সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক অটিজম সম্মেলনে যোগ দেবেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় পদক তিনি গ্রহণ করবেন। দক্ষিণ এশিয়ার এ প্রভাবশালী নেত্রী সম্পর্কে এখানে জানার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। এক সময় হতোদ্যম কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়িনীর ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতকে সম্মানের জায়গায় পেঁৗছে দেওয়া এবং বাংলাদেশসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ায় তার নেতৃত্বগুণ প্রশংসনীয়। তার এই বাংলাদেশ সফর অটিজম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে হলেও তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও উন্নত করায় অবদান রাখবে। তার ইতালীয় থেকে ভারতীয় হয়ে ওঠার কাহিনীটিও অনেকের কাছে আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে। ইদানীং সোনিয়া গান্ধী সরকারের বাইরে থেকেও রাজনৈকিভাবে কলকাঠি নাড়ার অধিকারী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না বলেও কথা উঠেছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এ ধরনের জল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, তিনি প্রতি সপ্তাহেই সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা চমৎকার। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন। তবে বিরোধী দলগুলো, এমনকি আন্না হাজারের মতো সিভিল সোসাইটি নেতৃবৃন্দ এর উল্টোটাই মনে করেন।
সোনিয়া মাইনো থেকে সোনিয়া গান্ধী হয়ে ওঠা_ সে এক লম্বা ইতিহাস। ইতালির তুরিন সংলগ্ন ছোট্ট গ্রাম ওরবাসানোর ১৮ বছরের কিশোরী সোনিয়া মাইনো। বাবা স্টিফানো আর মা পাওলোর তিন মেয়ের মধ্যে সোনিয়াই বড়। ইংরেজিতে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের জন্য যখন তারা সোনিয়াকে ক্যামব্রিজে পড়তে পাঠান তখন কি তারা তাদের মেয়ের ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে তা সামান্যও আঁচ করতে পেরেছিলেন!
ক্যামব্রিজে এক বছর যেতে না যেতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি রাজীব গান্ধীর। সুদর্শন-সুপুরুষ রাজীবকে তরুণীর স্বপি্নল চোখে মনে হয়েছিল তেপান্তরের মাঠে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা যুবরাজ। সেই প্রথম দেখাতেই প্রেম। কিন্তু ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন আদৌ সম্ভব হবে কি-না এ নিয়ে নানা টানাপড়েন তো ছিলই। তার বাবা-মাও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন। তার ওপর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নাতবৌ ও আগামী দিনের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর পুত্রবধূ হওয়ার ঝক্কি তো কম নয়। অতসব তাদের মেয়ে সামলাবে কী করে তা নিয়ে বাবা-মার চিন্তার অন্ত ছিল না। সোনিয়াও কি এ নিয়ে কম ভেবেছেন? তবে সব অনিশ্চয়তা ভালোবাসার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় এক সময়। রাজীব যখন তাকে প্রথম ভারতে নিয়ে আসেন তখন ইন্দিরা গান্ধীর সাহচর্য তার জীবনের ভবিষ্যৎ রেখাকে এক আঁচড়ে নির্দিষ্ট করে দেয়। এরপর ১৯৬৮ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসা। যে শাড়ি পরে তার শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধী একদিন ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন সেই ঝলমলে শাড়ি পরেই স্কার্ট পরতে অভ্যস্ত মেয়েটি বৌ সাজলেন। এরপর কোন সময় স্কার্ট পরা পুরোপুরি ছেড়েই দিলেন এবং ভারতীয় নারীর ভূষণ শাড়ি পরাকেই সার করলেন সেই ক্ষণটির কথা এখনও মনে আছে! এভাবেই আপাদমস্তক একজন ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টায় তিনি এগিয়ে গেলেন। কষ্ট করে হিন্দি শিখলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন ভারতীয় সংস্কৃতি। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে তিনিই থাকতেন হোস্ট। তাই তাকে সবার সঙ্গে মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতে হয়। ঘটে মতের আদান-প্রদান। আর এদিকে ততদিনে নেহরু প্রয়াত। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এভাবে ভারতীয় পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতির কেন্দ্র গান্ধী পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কাজটি চমৎকারভাবে সম্পন্ন করেন তিনি। কিন্তু ততদিনেও তিনি বুঝে উঠতে পারেননি, তার পরিবার ও তার সামনে কী উত্তাল রাজনৈতিক সময় অপেক্ষা করছে।
কংগ্রেসের ভাঙন, '৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি, '৭৭ সালের নির্বাচনে প্রথম স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবি, মোররজি দেশাই গংয়ের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পতন এবং ১৯৮০ সালের নির্বাচনে আবার ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা পুনরুদ্ধার। এই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ছেলে রাহুল ও মেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে লালন-পালন আর ঘরগেরস্তালি করেই তার সময় কেটে যেত। রাজীব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আর গেলেন না। তিনি হয়ে গেলেন কমার্শর্িয়াল পাইলট। স্বামী, দুই সন্তান, দেবর-জা আর শাশুড়ির সাহচর্যে মন্দ কাটছিল না ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টারত সোনিয়ার।
ইন্দিরা গান্ধী রাজনীতিতে উত্তরাধিকার হিসেবে ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু সঞ্জয় ১৯৮০ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে উত্তরাধিকারের অঙ্ক পাল্টে যায়। ইন্দিরা গান্ধী তখন তার বড় ছেলে রাজীব গান্ধীকে রাজনীতিতে আসার জন্য চাপ দেন। সোনিয়া গান্ধী কিছুতেই তার স্বামীকে রাজনীতিতে জড়াতে দিতে চাননি। শেষ পর্যন্ত মায়ের নির্দেশে রাজীব যখন তার ভাইয়ের আসন থেকে নির্বাচন করতে রাজি হয়ে যান, তখন সোনিয়া আর স্বামীর সঙ্গে দ্বিমত করতে পারেননি। এরপর ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তার শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারানোর পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ডাক পেলে তখনও সোনিয়া তার স্বামীর জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে গান্ধী পরিবারের একের পর এক সদস্যের দুর্ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলো তাকে আরও রাজনীতিবিমুখ করে তোলে। তবে তাকে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হওয়ার কারণে ন্যাশনাল গ্যালারির কাজটি ছেড়ে দিতে হয়। তারপর কংগ্রেসে ফের বিদ্রোহ এবং আরেক কংগ্রেসী ভিপি সিংয়ের নেতৃত্বে নতুন দল ও জোট গঠন করে নির্বাচনে কংগ্রেসকে হটিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে। এ সময় সোনিয়াও রাজনীতির বিতর্কে চলে আসেন। সুইডিশ কোম্পানিকে বোফর্স কামান কেনার অর্ডার পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে সোনিয়ার বল্পুব্দ এ কোম্পানিটি থেকে ঘুষ নিয়েছেন এবং ওই ঘুষের হিস্যা রাজীব পরিবারও পেয়েছে বলে সারা ভারতে বিরোধী দলের প্রচারণা চলে। তখন ওই প্রচারণার পালে বাতাসও লেগেছিল। নির্বাচনে এ বোফর্স কেলেঙ্কারি রাজীব এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচারণার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হয়। ভিপি সিংয়ের নেতৃত্বে স্বল্পস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় বসে। আরও দু'বার প্রধানমন্ত্রী বদল ঘটে। অবশেষে অকংগ্রেসী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে পুনরায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পায়। ওই নির্বাচনী প্রচারণার সময় সোনিয়া গান্ধীর জীবনে ঘটে যায় সবচেয়ে মর্মান্তিক শোকাবহ ঘটনাটি। তামিল বিদ্রোহী বোমায় রাজীব গান্ধী নিহত হন। সে থেকে সোনিয়া গান্ধী আবার অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে গেলেন। স্বামী হারানোর বেদনা এবং দুটি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। এ সময় তিনি রাজীবের নামে ট্রাস্ট গঠন এবং রাজি ও রাজি ওয়ার্ল্ড নামে দুটি পুস্তক প্রকাশ করা ছাড়া রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংযোগই রাখেননি।
কিন্তু দল নির্বাচনে খারাপ ফল করতে থাকায় রাজনীতিতে ও দলের নেতৃত্বে আসার জন্য তার ওপর নেতা, কর্মী, সমর্থকদের চাপ বেড়ে যায়। তারা দলে দলে ধরণা দিতে থাকেন সোনিয়া গান্ধীর কাছে। কিন্তু রাজীবের মৃত্যুর পর ছয়টি বছর কোনো অনুরোধই তার মত পাল্টাতে পারেনি। কংগ্রেস এ পর্যায়ে কাণ্ডারিহীন হয়ে পড়লে ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়ে রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পদার্পণ করেন তিনি। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি উল্কার মতো ছুটে বেড়ান রাজ্য থেকে রাজ্যে। নিজেও লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন। রাহুল-প্রিয়াঙ্কাকেও দেখা যায় মায়ের আসনে ভোটভিক্ষা করতে। আবার গান্ধী পরিবারের একাট্টা ছবি মানুষের মানসপটে ভেসে ওঠে। ১৯৯৯ সালে আবার লোকসভা নির্বাচন হয়। এবার অবশ্য বিজেপির নেতৃত্বে অকংগ্রেসী এনডিএ সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনে সমর্থ হয়। কংগ্রেসবিরোধী দলগুলো বরাবরের মতো নির্বাচনে সোনিয়া গান্ধীর বিদেশি অরিজিন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এ ব্যাপারে আদালতে মামলাও হয়। অথচ সোনিয়া গান্ধী ১৯৮৩ সালেই ভারতীয় নাগরিকত্বও লাভ করেছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত তার পক্ষে রায় দিলেও তার বিরুদ্ধে বিদেশিনী প্রচারণা কিন্তু এখনও বন্ধ হয়নি।
২০০৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ও তার মিত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে স্বাভাবিকভাবেই সোনিয়া গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। অনেক দেশি-বিদেশি মিডিয়া সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন মর্মে সংবাদও প্রকাশ করে। কিন্তু তিনি শেষ মুহূর্তে সবাইকে হতাশ করে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণে অসম্মত হন। তার অন্তরাত্মা এতে সায় দেয়নি বলে এই পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান তিনি। অবশ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করলে বিদেশিনী ইস্যুটি আবার জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হতো। তিনি আস্থার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারতেন না। এতে দেশ ও দল দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে_ এ আশঙ্কায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃত হন।
আস্থাভাজন ও নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ নরসিমা রাওয়ের সময়কার সফল অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের সবচেয়ে যোগ্য মনে করে তাকেই মনোনীত করেন। তবে দলের ও জোটের ক্ষমতা ভিন্ন ব্যক্তির হাতে থাকার কারণে ক্ষমতা নিয়ে
টানাপড়েন সৃষ্টি হয় কি-না, প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি-না, এ নিয়ে শুরু থেকেই আলোচনা-সমালোচনা ছিল। এখনও এই আলোচনাই বেশি করে হচ্ছে।
যাই হোক, ভারতের ক্ষমতার রশিটা যে এখন সোনিয়া গান্ধীর হাতেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী না হয়েও তিনি প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে ইতালির ছোট্ট গ্রামের মেয়েটি ভারতীয়দের কাছে 'দেশ কি বহু' থেকে দেবীতে পরিণত হচ্ছেন।

সুভাষ সাহা : সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.