মানুষের মুখ-স্বপ্নদলের শেষ গান by আজাদুর রহমান
পর্যাপ্ত সবুজ কামিজের মতো উজাড় করা গাছগাছালি, গেরুয়া ধানের মাঠ, নীল জলেশ্বরী আর পাথারিখেজুর যেন নিজ ভাষায় বয়ান করছে। ক্রমাগত দেখা দিচ্ছে সাদা বক আর খয়েরি শালিক। হঠাৎ করেই লম্বা ঘের। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, কে জানে! জলাভূমি ছেড়ে খেত, তারপর জলাভূমি, ফের ধানখেত লাফ দিয়ে দিয়ে থিতু হয়েছে জঙ্গলের পায়ের তলায়।
ভাবতে গিয়ে ঝাপসা হয়ে আসে গুটিধরা গ্রাম। পিচ, ইট বিছানো পথ, কোথাও বা পুরোটাই কাদা, ভাঙাচোরা আর খানাখন্দকে জবরদস্ত হাঙ্গামা—সব মিলিয়ে রোদ-ছায়ার ঝিলিমিলি মাড়িয়ে নোনা হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উড়ে যাচ্ছে বাউণ্ডুলে মোটরসাইকেল। সাতক্ষীরা থেকে আশাশুনি হয়ে পাইকগাছায় ঢুকে তবে বোরহানপুর। গোড়াতেই বেহারাবাড়ি। খসে পড়া সুপারিপাতায় আড়াল তুলে আঁটসাঁট আঙিনার পরে মাটির ঘর। করিম সরদারের বাড়িতে এই প্রথম নয়। চেনা দাওয়ায় পাটিতে বসে দবির, মোকলেস, করিম, জহর, সানোয়ার, মসলেমরা গোল হয়ে বসে বলে যেতে থাকেন পুরোনো গল্প। একটা কিছু না করলে বউবাচ্চা খাবে কী! বাধ্য হয়ে করিম বাওলা ঘাসের ব্যবসা করেন। মামুলি কারবার। ঘেরের অযাচিত শ্যাওলা যখন কামলারা সাফ করতে থাকে, তখন সেই ফেলনা ঘাস কুড়িয়ে গৃহস্থের কাছে বিক্রি করে যা হয়, তা-ই দিয়ে জীবিকা। মনের জোর বাড়াতে নামের শেষে ‘সরদার’ উপাধি যোগ করলেও সমাজের অন্য লোকেরা সরদার তো দূরের কথা, ‘বেহারা’ও বলে না, বলে ‘কাহার’। লোকসমাজ চোখ নিচু করলে কেমন কষ্ট হয়, তা ভালো করেই জানেন বৃদ্ধ দবিরুদ্দিন, ‘দ্যাকেন আমরা নাচগান, বাজনাবাজি করতি করতি বিয়েবাড়িতি যাপো। যাইয়ে পর আমাদেরকে রাকে নিচে। কুনো খোঁজখবর করে না। বাপ-দাদার আমলে মান-মইর্যাদা যাও একটুকুন ছিল, এখন কুনো মইর্যাদা নাই। বেহারা বলে লোকজন আমাদের ছেলিমেইয়ের সাথে বিয়ের সম্পর্ক করে না।’ তাচ্ছিল্য দবিরুদ্দিন, করিমেরা মানলেও প্রজন্মের ছেলেরা মানবে কেন? করিমের ছেলের মতো অন্যরাও তাই পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাপ-দাদার পালকি। পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং টানে পড়ে আবার যাতে পালকি ধরতে না হয়, সে জন্য ভ্যান বাওয়া, জোন (কিষান) খাটা, মাছ কিংবা ঘাস বেচার মতো কাজকেই বেছে নিয়েছেন তাঁরা। হজরত ব্যাটার বউকে দেখিয়ে বললেন, ‘এ তো গাজী বংশের মেয়ে। পালকির কাজ করি না, তাই আর সমস্যা নাই। কারও নাক উঁচু ভাবটাও নাই।’ ছেলেরা রাগে-অভিমানে সাধের পালকি পুড়িয়ে দিলেও হজরত, করিমদের মনের মধ্যে দলাপাকানো স্মৃতিকে তো ওভাবে পুড়িয়ে নিঃশেষ করা যায় না। দবিরুদ্দিন হাত ইশারায় গান ধরতে বললে করিম তাই লাজুকভাবে ওজর তোলেন, ‘চাচা, উ গান আমি কবে গায়িছি, এখন কি আর মনে আছেনি।’ জবাব শুনে কলপাড় থেকে করিমের বউ গলা বাড়ান, ‘মেয়েআলার বাড়িত যে গানটা গায়িলে, সেইটে গাও।’ তারপর খুঁটিতে ঠেস দিয়ে করিম আপনিতেই গান ধরেন—
ছেলেতে কয় বাপেরে কাছে/ আমার বিয়ের ভাব লেগেছে
আমার শাড়ি-গয়না কিছুই লাগবে না/ মনো রে, ও মন ঘটক লেগেছে...
গায়েন দলে একজন থাকেন প্রধান গানদার। নাচদারও থাকেন একজন। নাচতে নাচতেই তিনি হাতলে পা তুলে দেন। তারপর তড়াক করে উল্টো ঝুলে পড়েন এবং ঝুল খেয়েই রেজগিওয়ালা গামলায় মুখ ডোবান। চুমুক দিয়ে যত রেজগি তুলতে পারেন, সেটাই হলো বাহাদুরি। এদিক-ওদিক পয়সাপাতি ছাড়াও কখনো-সখনো গেঞ্জি, স্যান্ডেল, লুঙ্গির মতো উপহারও জুটে যেত। গল্পকথায় পুরোনো ছবি ভাসতে শুরু করলে জাবরকাটা স্মৃতিগুলো মুখ থেকে মুখে লাফাতে শুরু করে। মেয়েছেলেরাও কথা তোলে একসময়। কথার লাইন থাকে না। এখন দল নেই, পালকিও নেই। পালকি পেতে যেতে হবে সাহাপাড়ায়। আবারও পথে নামলাম। মোটরসাইকেল থেকে ছুড়ে দেওয়া কথা লোকেরা সহজে ধরতে পারে না। কিলোমিটার সম্পর্কেও তাদের ধারণা কম। তিন কিলোমিটার পরও যাকে জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে, সে-ই বলছে, সামনে। অবশেষে পথটা ঘাটে গিয়ে থেমে গেল। এত নরম স্বভাবী নদী তেমন চোখে পড়ে না। ঘাটোয়ালকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, নদীর নাম কী? বললেন, ‘শিববাটি’। পরে জেনেছি, আসলে এটি কপোতাক্ষ। মাইকেল মধুসূদনের কপোতাক্ষ। গ্রামবাসী এতই নদী-ন্যাওটা যে আদর করে নদীকে গ্রামের নামে ডাকে। সাহাপাড়ায় যখন পৌঁছলাম, তখন টাটকা বিকেল। বৃদ্ধ বক্কর বললেন, ‘বাবাজি, বসেন তো টংয়ের ওপর, লোক সব এহানেই ডাকাচ্ছি।’ মোড়ে মজমা বসে গেল। টাইপ মেশিনের জায়গায় কম্পিউটার বসে গেলে টাইপিস্টদের মনের যেমন করুণ অবস্থা হয়, তাঁদের অবস্থাও এখন সেইমতো। আগে সাহাপাড়ার খুব নামডাক ছিল। আট জোড়া পালকি কমতে কমতে এখন জোড়া দুই আছে। টেনেটুনে মোটে দু-একটার বেশি খেপ হয় না। পুরোনো কথা মনে করে তাঁরা ফের নতুন করে গল্প তোলেন। গল্পের সঙ্গে যোগ হয় গান। বহু দিন পর বৃদ্ধ লোকমান আজ আবার গান ধরলেন—
‘হাতে লাঠি, কান্দে ছাতি
ওই আসতিছে প্রাণের পতি
যোগী ভিক্ষে দাও, ভিক্ষে দাও...।’
গান থামে না। জো উঠে গেছে। সাদা-কালো মুখগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। কল্পনা ছুঁয়ে খসে পড়ে একটি আনন্দময় গান।
ছেলেতে কয় বাপেরে কাছে/ আমার বিয়ের ভাব লেগেছে
আমার শাড়ি-গয়না কিছুই লাগবে না/ মনো রে, ও মন ঘটক লেগেছে...
গায়েন দলে একজন থাকেন প্রধান গানদার। নাচদারও থাকেন একজন। নাচতে নাচতেই তিনি হাতলে পা তুলে দেন। তারপর তড়াক করে উল্টো ঝুলে পড়েন এবং ঝুল খেয়েই রেজগিওয়ালা গামলায় মুখ ডোবান। চুমুক দিয়ে যত রেজগি তুলতে পারেন, সেটাই হলো বাহাদুরি। এদিক-ওদিক পয়সাপাতি ছাড়াও কখনো-সখনো গেঞ্জি, স্যান্ডেল, লুঙ্গির মতো উপহারও জুটে যেত। গল্পকথায় পুরোনো ছবি ভাসতে শুরু করলে জাবরকাটা স্মৃতিগুলো মুখ থেকে মুখে লাফাতে শুরু করে। মেয়েছেলেরাও কথা তোলে একসময়। কথার লাইন থাকে না। এখন দল নেই, পালকিও নেই। পালকি পেতে যেতে হবে সাহাপাড়ায়। আবারও পথে নামলাম। মোটরসাইকেল থেকে ছুড়ে দেওয়া কথা লোকেরা সহজে ধরতে পারে না। কিলোমিটার সম্পর্কেও তাদের ধারণা কম। তিন কিলোমিটার পরও যাকে জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে, সে-ই বলছে, সামনে। অবশেষে পথটা ঘাটে গিয়ে থেমে গেল। এত নরম স্বভাবী নদী তেমন চোখে পড়ে না। ঘাটোয়ালকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, নদীর নাম কী? বললেন, ‘শিববাটি’। পরে জেনেছি, আসলে এটি কপোতাক্ষ। মাইকেল মধুসূদনের কপোতাক্ষ। গ্রামবাসী এতই নদী-ন্যাওটা যে আদর করে নদীকে গ্রামের নামে ডাকে। সাহাপাড়ায় যখন পৌঁছলাম, তখন টাটকা বিকেল। বৃদ্ধ বক্কর বললেন, ‘বাবাজি, বসেন তো টংয়ের ওপর, লোক সব এহানেই ডাকাচ্ছি।’ মোড়ে মজমা বসে গেল। টাইপ মেশিনের জায়গায় কম্পিউটার বসে গেলে টাইপিস্টদের মনের যেমন করুণ অবস্থা হয়, তাঁদের অবস্থাও এখন সেইমতো। আগে সাহাপাড়ার খুব নামডাক ছিল। আট জোড়া পালকি কমতে কমতে এখন জোড়া দুই আছে। টেনেটুনে মোটে দু-একটার বেশি খেপ হয় না। পুরোনো কথা মনে করে তাঁরা ফের নতুন করে গল্প তোলেন। গল্পের সঙ্গে যোগ হয় গান। বহু দিন পর বৃদ্ধ লোকমান আজ আবার গান ধরলেন—
‘হাতে লাঠি, কান্দে ছাতি
ওই আসতিছে প্রাণের পতি
যোগী ভিক্ষে দাও, ভিক্ষে দাও...।’
গান থামে না। জো উঠে গেছে। সাদা-কালো মুখগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। কল্পনা ছুঁয়ে খসে পড়ে একটি আনন্দময় গান।
No comments