চারদিক-শেরপুরের মাছের মেলা by আকমল হোসেন
মাছের সঙ্গে বাঙালির পরিচয়, সেটা তো জন্মসূত্রেই। যদিও মাছের সেই সুদিন বা রমরমা সময় এখন নেই! সময় এখন এমন, অনেকের পক্ষে পছন্দের মাছ কিনে খাওয়া বা খুঁজে পাওয়া কঠিনই হয়ে উঠেছে। হাওর-বাঁওড়, বিল-বাদাড়, নদী-নালা থেকে হারিয়ে গেছে স্থানীয় জাতের অনেক মাছ। অনেক প্রজাতির মাছই বিপন্ন। তবু মাছ বলে কথা।
প্রাকৃতিক জলে সেই মাছের দেখা না মিলুক, সেই মাছ পাতে না উঠুক—একসঙ্গে অনেক রকমের, অনেক জাতের জলের এই রুপালি শস্যের যদি দেখা মেলে। সেই চোখে দেখার সুযোগটা কজনই বা হাতছাড়া করতে চাইবে!
এটা বোঝা যায়, প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর মাছের মেলায় মানুষের ঢল দেখে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো এটাও একটা কারণ, বাঙালি উৎসবের ছুতো পেলে আর ঘরের কোনায় বসে থাকতে রাজি নয়। হাজার মাইল দূরে ছুটে হয়তো সবাই যায় না। কিন্তু ঘরের পাশে, বাড়ির পাশে কোনো মেলা-উৎসব! আর কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, সেটা হয় না। মেলায় তার আসা চাই। মেলায় তার ভাসা চাই। শেরপুরের মাছের মেলা এই অঞ্চলবাসীর কাছেও আলাদা একটি পার্বণ, নিজেদের একটি উৎসব। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও মনে মনে মেলার জন্য চলে গোপন অপেক্ষা।
বছরে অন্তত একটা দিন শেরপুরের মাছের মেলা সবাইকে জানিয়ে যায়, বাঙালির মাছ-ভাতের একটা প্রবাদ আছে। মাছের এখন দুর্দিন চলছে, তা চলুক। কিন্তু পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে যেন কোনো এক গোপন খনি থেকে উঠে আসে মাছ আর মাছ। বোয়াল, চিতল, আইড়, রুই, মৃগেল, কাতলা...। কোনো কোনো মাছের ওজনও ভারী। সাধারণত বছরের অন্য সময় হাটবাজারে অমন ওজনের মাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেমন আর সব প্রাণী থেকে আলাদা, তেমনই মাছ হলেও আর সব মাছ থেকে এই মেলায় আলাদা ভাব নিয়েই থাকে ‘বাঘাইড়’। অনেকে বলে বাঘ মাছ। এই বাঘাইড় মাছের ওজন এক থেকে পাঁচ-ছয় মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। দামও হাঁকা হয় লাখ টাকার ওপর। এমন দামের ক্রেতাও আছেন। মাছের এই রাজত্বে এসে মাছের আকাল কথাটা কিছু সময়ের জন্য হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলবে! মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা হয়তো তখন মনে পড়বেই।
প্রায় প্রতিবছরই শেরপুরের মেলায় ‘মাছবাণিজ্য’ করতে আসেন, এমন অনেকে বলেছেন, এই মাছের মেলার জন্য মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইল হাওর, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরের কিছু কিছু বিল আছে। মনু, কুশিয়ারাসহ বেশ কিছু ছোট-বড় নদীর নির্দিষ্ট স্থান আছে, যা এই মাছের মেলার জন্য সযত্নে সংরক্ষণে থাকে। মেলার সময় এসব বিল ও নদী থেকে মাছ ধরা হয়। পাইকারেরা সেই মাছগুলো কিনে নিয়ে আসেন মাছের মেলায়। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন মৎস্য খামার। খামারগুলোও মাছের মেলায় মাছের জোগান দেয়। এখান থেকে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের খুচরা বিক্রেতা মাছ কিনে ট্রাক ও টেম্পো বোঝাই করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ছোট-বড় হাটবাজারে ছড়িয়ে পড়েন। মাছের মেলা বলেই কিনা, মাছের দামে বেশ ঝাঁজ থাকে। পৌষের শীতেও গরম আঁচ লাগে গায়ে। মাঝারি আকারের একটি মাছের দামও ১০-২০ হাজার টাকা হাঁকা হয়। এর নিচে দাম হাঁকালে যেন মাছটার মানসম্মানে লাগবে। বড় আকারের দামি মাছগুলোর ক্রেতা সাধারণত প্রবাসী ও শৌখিন লোকেরাই।
এলাকার লোকজনের ধারণা, এরই মধ্যে শেরপুরের মাছের মেলার বয়স শত বছর পার হয়ে গেছে। প্রথমে মেলা শুরু হয়েছিল মনু ও কুশিয়ারা নদীর মিলনস্থল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ নামক স্থানে। মনু নদের পাড়ে মেলা বসত। তখন নদীপথে নানা স্থান থেকে মাছের ক্রেতা-বিক্রেতারা আসতেন। পরে মনুমুখ বাজারটি নদীভাঙনের কবলে পড়ে। মেলাটি সরে যায় শেরপুর এলাকার হামরকোনায়। ৩০-৩৫ বছর ধরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর বাজারের দক্ষিণ দিকে কুশিয়ারা নদীর পশ্চিম পাড়ে মাছের মেলা বসছে। মেলাটি বসে পৌষসংক্রান্তির এক দিন আগে। ১৪ জানুয়ারি ছিল সেই দিন।
এটি মাছের মেলা হলেও এখন একটি বার্ষিক বাণিজ্যিক উৎসব। এখানে মাছের আড়ত বসে ৩০-৪০টি। এবারও খুচরা মাছের দোকান বসেছিল তিন শতাধিক। মেলার আগের দিন থেকেই সুনামগঞ্জ, মার্কুলিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরা মাছ নিয়ে আসতে শুরু করেন। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল রুপালি মাছের আঁষটে ঘ্রাণ। মেলাটি মাছের সন্দেহ নেই। কিন্তু একপর্যায়ে এটি বারোয়ারি মেলায় রূপ নেয়। বিশাল মেলাজুড়ে থাকে গরম জিলাপি, ঝোল মাংসের ধোঁয়া ওড়া তরকারি আর পরোটা, আখনি, ডিম ভুনা, তিলুয়া-বাতাসা, খই-মুড়িসহ নানা রকম মৌসুমি ফল থাকে ছড়ানো-ছিটানো। শিশুদের খেলনা, কিশোরী-তরুণীর প্রসাধনী। শীতের কাপড়চোপড়। বাঁশ-বেত ও কাঠের তৈরি আসবাব। ঘর-সংসারের নানা রকম মাটির বাসন, কাঠের জিনিস, লোহালক্কড়ের সামগ্রী। থাকে নাগরদোলা, বায়োস্কোপসহ হরেক রকম চোখধাঁধানো পণ্য। এলাকাটি কয়েক দিনের জন্য হয়ে ওঠে চনমনে। এই মেলা এখন এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। যেন এই মেলা ছাড়া এলাকার পূর্ণতাই নেই। এ রকম মেলাগুলো বারবার বলে দেয়, এই পার্বণ ছাড়া বাঙালির পরিচয়টিই ম্লান।
এটা বোঝা যায়, প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর মাছের মেলায় মানুষের ঢল দেখে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো এটাও একটা কারণ, বাঙালি উৎসবের ছুতো পেলে আর ঘরের কোনায় বসে থাকতে রাজি নয়। হাজার মাইল দূরে ছুটে হয়তো সবাই যায় না। কিন্তু ঘরের পাশে, বাড়ির পাশে কোনো মেলা-উৎসব! আর কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, সেটা হয় না। মেলায় তার আসা চাই। মেলায় তার ভাসা চাই। শেরপুরের মাছের মেলা এই অঞ্চলবাসীর কাছেও আলাদা একটি পার্বণ, নিজেদের একটি উৎসব। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও মনে মনে মেলার জন্য চলে গোপন অপেক্ষা।
বছরে অন্তত একটা দিন শেরপুরের মাছের মেলা সবাইকে জানিয়ে যায়, বাঙালির মাছ-ভাতের একটা প্রবাদ আছে। মাছের এখন দুর্দিন চলছে, তা চলুক। কিন্তু পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে যেন কোনো এক গোপন খনি থেকে উঠে আসে মাছ আর মাছ। বোয়াল, চিতল, আইড়, রুই, মৃগেল, কাতলা...। কোনো কোনো মাছের ওজনও ভারী। সাধারণত বছরের অন্য সময় হাটবাজারে অমন ওজনের মাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেমন আর সব প্রাণী থেকে আলাদা, তেমনই মাছ হলেও আর সব মাছ থেকে এই মেলায় আলাদা ভাব নিয়েই থাকে ‘বাঘাইড়’। অনেকে বলে বাঘ মাছ। এই বাঘাইড় মাছের ওজন এক থেকে পাঁচ-ছয় মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। দামও হাঁকা হয় লাখ টাকার ওপর। এমন দামের ক্রেতাও আছেন। মাছের এই রাজত্বে এসে মাছের আকাল কথাটা কিছু সময়ের জন্য হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলবে! মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা হয়তো তখন মনে পড়বেই।
প্রায় প্রতিবছরই শেরপুরের মেলায় ‘মাছবাণিজ্য’ করতে আসেন, এমন অনেকে বলেছেন, এই মাছের মেলার জন্য মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইল হাওর, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরের কিছু কিছু বিল আছে। মনু, কুশিয়ারাসহ বেশ কিছু ছোট-বড় নদীর নির্দিষ্ট স্থান আছে, যা এই মাছের মেলার জন্য সযত্নে সংরক্ষণে থাকে। মেলার সময় এসব বিল ও নদী থেকে মাছ ধরা হয়। পাইকারেরা সেই মাছগুলো কিনে নিয়ে আসেন মাছের মেলায়। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন মৎস্য খামার। খামারগুলোও মাছের মেলায় মাছের জোগান দেয়। এখান থেকে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের খুচরা বিক্রেতা মাছ কিনে ট্রাক ও টেম্পো বোঝাই করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ছোট-বড় হাটবাজারে ছড়িয়ে পড়েন। মাছের মেলা বলেই কিনা, মাছের দামে বেশ ঝাঁজ থাকে। পৌষের শীতেও গরম আঁচ লাগে গায়ে। মাঝারি আকারের একটি মাছের দামও ১০-২০ হাজার টাকা হাঁকা হয়। এর নিচে দাম হাঁকালে যেন মাছটার মানসম্মানে লাগবে। বড় আকারের দামি মাছগুলোর ক্রেতা সাধারণত প্রবাসী ও শৌখিন লোকেরাই।
এলাকার লোকজনের ধারণা, এরই মধ্যে শেরপুরের মাছের মেলার বয়স শত বছর পার হয়ে গেছে। প্রথমে মেলা শুরু হয়েছিল মনু ও কুশিয়ারা নদীর মিলনস্থল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ নামক স্থানে। মনু নদের পাড়ে মেলা বসত। তখন নদীপথে নানা স্থান থেকে মাছের ক্রেতা-বিক্রেতারা আসতেন। পরে মনুমুখ বাজারটি নদীভাঙনের কবলে পড়ে। মেলাটি সরে যায় শেরপুর এলাকার হামরকোনায়। ৩০-৩৫ বছর ধরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর বাজারের দক্ষিণ দিকে কুশিয়ারা নদীর পশ্চিম পাড়ে মাছের মেলা বসছে। মেলাটি বসে পৌষসংক্রান্তির এক দিন আগে। ১৪ জানুয়ারি ছিল সেই দিন।
এটি মাছের মেলা হলেও এখন একটি বার্ষিক বাণিজ্যিক উৎসব। এখানে মাছের আড়ত বসে ৩০-৪০টি। এবারও খুচরা মাছের দোকান বসেছিল তিন শতাধিক। মেলার আগের দিন থেকেই সুনামগঞ্জ, মার্কুলিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরা মাছ নিয়ে আসতে শুরু করেন। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল রুপালি মাছের আঁষটে ঘ্রাণ। মেলাটি মাছের সন্দেহ নেই। কিন্তু একপর্যায়ে এটি বারোয়ারি মেলায় রূপ নেয়। বিশাল মেলাজুড়ে থাকে গরম জিলাপি, ঝোল মাংসের ধোঁয়া ওড়া তরকারি আর পরোটা, আখনি, ডিম ভুনা, তিলুয়া-বাতাসা, খই-মুড়িসহ নানা রকম মৌসুমি ফল থাকে ছড়ানো-ছিটানো। শিশুদের খেলনা, কিশোরী-তরুণীর প্রসাধনী। শীতের কাপড়চোপড়। বাঁশ-বেত ও কাঠের তৈরি আসবাব। ঘর-সংসারের নানা রকম মাটির বাসন, কাঠের জিনিস, লোহালক্কড়ের সামগ্রী। থাকে নাগরদোলা, বায়োস্কোপসহ হরেক রকম চোখধাঁধানো পণ্য। এলাকাটি কয়েক দিনের জন্য হয়ে ওঠে চনমনে। এই মেলা এখন এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। যেন এই মেলা ছাড়া এলাকার পূর্ণতাই নেই। এ রকম মেলাগুলো বারবার বলে দেয়, এই পার্বণ ছাড়া বাঙালির পরিচয়টিই ম্লান।
No comments