বিজ্ঞানে সৃজনশীল প্রশ্ন : শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্যোগ by মনজুর রহমান শান্ত

২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা ও ধর্ম বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের মাধ্যমে আংশিকভাবে চালু হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতি। এরপর জেএসসি পরীক্ষায় গণিত ও বাংলা দ্বিতীয় পত্র ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি এবং সবশেষে ২০১১ সালের এসএসসি পরীক্ষার চারটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র এই পদ্ধতির আওতায় আনা হয়েছে।


দেশের জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবীদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে এ পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা করা হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ওই সরকারের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড অবৈধ বললেও বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তাদের প্রণীত সৃজনশীল পদ্ধতি সাদরে গ্রহণ করেছে শিক্ষা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে।
এবার দেখা যাক, গত দুই বছরে শিক্ষা কতটা যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী হয়েছে। প্রথমেই দৃষ্টি দিচ্ছি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ওপর। পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলল, সরকার শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ায় এবং বিদ্যালয়গুলোয় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বেড়েছে। ফলে পাসের হার বেড়েছে। কিন্তু কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও খাতা মূল্যায়নকারী একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবার শিক্ষকদের ওপর উদার মনোভাব নিয়ে খাতা মূল্যায়ন করার নির্দেশ ছিল। ছাত্রছাত্রীদের খাতায় দুই হাত উজাড় করে নম্বর দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ফলাফলেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। প্রথমেই আসা যাক, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে। এতে টাঙ্গাইলের ছেলে ইয়াসা ৫৯৮ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান, এর চেয়ে দুই নম্বর কম অর্থাৎ ৫৯৬ নম্বর পেয়ে মাদারীপুরের সাদিয়া ও টাঙ্গাইলের নাঈম দ্বিতীয় স্থান এবং ৫৯৫ নম্বরে শ্রীমঙ্গলের সপ্তর্ষি চন্দ ও মনোহরদীর তানভীর আঞ্জুম তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।
ইয়াসা ও অন্যদের এই অর্জন নিঃসন্দেহে ভালো খবর এবং আমরা গর্বিত। তবে কথা হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে ১০০-তে ১০০ নম্বর পাওয়ার খবর নতুন নয়। কিন্তু সমাপনী পরীক্ষার মতো একটা পাবলিক পরীক্ষায় বাংলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও সাধারণ বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে ১০০-তে ১০০ পাওয়া কাল্পনিক ব্যাপার। তবে এবারের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে শিক্ষার্থীদের অমাবস্যার চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো কাল্পনিক ব্যাপার বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা বিষয়ে ১৪ নম্বর প্রশ্নের একটি কবিতার অন্তর্নিহিত মূলভাব লেখায় ৮-এর মধ্যে ৮ পাওয়া এবং ১৫ নম্বর প্রশ্নে একটি রচনা লেখায় ১৫-এর মধ্যে ১৫ পাওয়া সত্যিই অবাস্তব। সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে চারটি রচনামূলক প্রশ্নের নম্বর ৩২। ইতিহাস, ভূগোল ও পৌরনীতির চারটি জটিল প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে ৩২ নম্বরের মধ্যে ৩২ পাওয়া অস্বাভাবিক। সাধারণ বিজ্ঞানেও অনুরূপ হিসাব চোখে পড়ে।
উলি্লখিত জটিল প্রশ্নগুলোতে যদি ১ নম্বর করেও কম দেওয়া হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৫৯০-এর নিচে পাওয়ার কথা। সুতরাং পত্রপত্রিকায় শিক্ষকদের উজাড় করে নম্বর দেওয়ার যে প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তা নির্ভুল বলেই আমি মনে করি। তবে খাতা মূল্যায়নকারী শিক্ষকদের কাছে আমার প্রশ্ন_এতই যখন দিলেন, ওই দুই নম্বর বাকি রাখলেন কেন? এ তো গেল উচ্চ নম্বরের প্রসঙ্গ। অল্প নম্বরের জন্য ফেল করা শিক্ষার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অনেক শিক্ষক তথ্য দিয়েছেন, যার ফলে পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৯২.৩৪ শতাংশ। জেএসসি পরীক্ষার চালচিত্র আরো ভয়াবহ। এবারই প্রথম শুরু হওয়া এই পাবলিক পরীক্ষায় আটটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫৩৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করেছে আট লাখ ২২ হাজার ২৭৫ জন। পাসের হার ৭১.৩৪ শতাংশ। পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিন লাখ ৬৯ হাজার ২০০ জন অর্থাৎ প্রায় ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে 'সি' গ্রেডে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও খাতা মূল্যায়নকারী একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাঁদের ওপর খাতায় বেশি বেশি নম্বর দেওয়ার নির্দেশ ছিল। 'সি' গ্রেড প্রাপ্ত প্রায় পৌনে চার লাখ পরীক্ষার্থীর বেশির ভাগই ফেল করেছিল গণিত অথবা সাধারণ বিজ্ঞান অথবা সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে। যারা অন্তত উলি্লখিত বিষয়ে ২৩ নম্বর পেয়েছে তাদের খাতায় ১০ নম্বর বাড়িয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর প্রথম বছরের যুগোপযোগী শিক্ষার যে নমুনা পাওয়া গেল তার কিছু কারণ তুলে ধরছি। আমাদের দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট-নির্ভর হয়ে পড়ছে দিন দিন। শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে নিজ বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতে বেশি পছন্দ করেন। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার মতো দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। অনেক শিক্ষক এ পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরিতে অনভিজ্ঞ হওয়ায় গাইড-নির্ভর হয়ে পড়ছেন। সর্বোপরি এবারের জেএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিষয়ের দুর্বোধ্য প্রশ্ন শিক্ষার্থীরা বুঝতে না পারায় অনেক মেধাবীও এর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে; যার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। এ ছাড়া আরো অনেক কারণে সৃজনশীল পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে।
শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়ানোর অভিযোগ খোদ মন্ত্রী পর্যায়েও শোনা গেছে বহুবার। এটা বন্ধ করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতে হবেও না। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পাশাপাশি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণী পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ে ৩০ নম্বরের এসবিএ চালু করা হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণী শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হচ্ছে। যেখানে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর বিরুদ্ধে স্বয়ং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাই সোচ্চার, আবার তাদের হাতে এসবিএর ৩০ নম্বর দেওয়াটা প্রাইভেট পড়ানোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার নামান্তর বলে বিজ্ঞমহল মনে করে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী শ্রেণী শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদের এসবিএ নম্বর সর্বোচ্চ, আর যেসব শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে না তারা নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা এবং শ্রেণী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা সত্ত্বেও তাদের এসবিএ নম্বর ২০-এর নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার কারণে শিক্ষকরা পাঠদান করার উপযুক্ত সময় পান না। আমি গাজীপুর জেলার দুটি শীর্ষস্থানীয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০১০ সালের প্রথম চার মাসের শিক্ষার পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। নতুন বছরের পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও বনভোজনের কারণে ওই স্কুল দুটিতে জানুয়ারি মাসে তেমন ক্লাস হয়নি বা কখনো হলেও একটি বা দুটি ক্লাস নেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষার কারণে ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ থেকে মার্চ মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত স্কুল দুটির ক্লাস বন্ধ রাখা হয়। ১৭ মার্চ স্কুল খুলে আবার ১৮ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হয় প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। তাহলে শিক্ষার্থীরা কি শিখল আর সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে তারা কতটুকু ধারণা নিয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলো? শুধু গাজীপুরের এ বিদ্যালয় দুটিতেই নয়, সারা দেশে যেসব স্কুলে পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র পড়ে সেসব স্কুলের চালচিত্র
একই রকম।
অষ্টম শ্রেণীর সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ে মোট ২৬টি অধ্যায়। প্রথম ১৩টি প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ও পরের ১৩টি দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার সিলেবাসে করা হয়েছে এবং জেএসসি পরীক্ষার আগেই। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় মার্চ মাসে শুধু বিজ্ঞান বিষয়েরই ১৩টি অধ্যায়ের বিশাল চাপের বোঝা সহ্য করতে হয় শিক্ষার্থীদের। একইভাবে অন্যান্য বিষয়েরও চাপ পড়ে সমানতালে_এটি রীতিমতো শিক্ষাযন্ত্রের নিষ্পেষণ। বিজ্ঞান বিষয়ে প্রশ্নের দুর্বোধ্যতার কারণে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই 'সি' গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়েছে। আসলে বিজ্ঞান বিষয়ে প্রয়োগমূলক ও উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো হাতে-কলমে শিক্ষা আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোয় হয় কি না তা যাচাই করা দরকার। আর হলেও তা দেশের কয়টি প্রতিষ্ঠানে হয়, তা হিসাব করা জরুরি। পাসের হার কখনো প্রকৃত শিক্ষার মানদণ্ড হতে পারে না। নম্বর বাড়িয়ে পাসের হার বৃদ্ধিকে শিক্ষার অগ্রগতি বলা যাবে না। পাসের হার বাড়ানোর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালু হয়েছিল ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সে বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৭ শতাংশের ওপর, যা পূর্ববর্তী বছরের পাসের হার অপেক্ষা প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। বিজ্ঞজনরা বলেন, পাসের হার সাধারণত ২-৩ শতাংশ উঠানামা করতে পারে। এক লাফে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া বাস্তবতাবর্জিত। তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা উচ্চ পাসের হার দেখে সগর্বে বলেছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু খাতা মূল্যায়নকারী অসংখ্য শিক্ষক প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, তাদের ওপর বেশি বেশি নম্বর দেওয়ার নির্দেশ ছিল বলে পাসের হার বেড়েছে। এ ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন দেশে গণতন্ত্র ছিল না, ছিল জরুরি অবস্থা।
সাহিত্যের বিষয়গুলোতে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র তৈরিতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তায় লেখার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো বাস্তবমুখী শিক্ষা আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে নেই। সুতরাং বিজ্ঞান বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতেও পাবলিক পরীক্ষার পাসের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য নম্বর বাড়িয়ে জোড়াতালি মার্কা ফলাফল তৈরি করতে হবে সন্দেহ নেই। তাই সাহিত্যের বিষয়গুলোতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু রেখে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো এ পদ্ধতির আওতামুক্ত রাখা যায় কি না আরেকবার ভেবে দেখা জরুরি।

লেখক : নাট্যকার

No comments

Powered by Blogger.