উগ্রবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক মেরুকরণ by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্মাণ নিয়ে বড় দুই ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ রয়েছে। একটি হচ্ছে, আধুনিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা-সংক্রান্ত রাজনৈতিক মতাদর্শ। অন্যটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বক্তব্য। প্রথমটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশি, যা গণতান্ত্রিক ধারায় গড়তে চায়,
দ্বিতীয়টি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শের কাছাকাছি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যারা এর স্বপ্ন দেখে। এর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নয়। বড় মাপে রাজনীতিকে এমন দুটি ধারায় বিভক্ত করা গেলেও রাজনৈতিক দল, শক্তি ও ব্যক্তি-গোষ্ঠী কিন্তু সেভাবে সংগঠিত নয়, বরং বহুধাবিভক্ত দল ও গোষ্ঠীতে এরা অবস্থান করছে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম ধারার রাজনীতি ও দলের অবস্থান নিরঙ্কুশ ছিল, দ্বিতীয় ধারাটি তখন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, আত্মগোপনকারী এবং বেশ ছোট আকারের ছিল। তবে প্রথম ধারায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি এবং নেতৃত্ব প্রজ্ঞার পরিপূর্ণ পরিচয় দিতে পারেনি। কারো কারো রাষ্ট্রচিন্তা ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক, সেটিও আবার বহু ধারায় বিভক্ত উগ্র হঠকারী তত্ত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ এবং বিভ্রান্তিকর ছিল। ফলে দেশে মূলধারার রাজনীতির বিকাশ সুনির্দিষ্ট হতে পারেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বাস্তবতাকে দ্রুত কাটিয়ে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণে তখন সব পক্ষেরই করণীয় নির্ধারণ, ভূমিকা পালন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির পুনরুত্থানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকার বিষয়টিতে ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। সেটিরই সুযোগ নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তি ১৯৭৫ সালের আগস্ট-নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতি, পর্যুদস্ত করা হয় প্রথম ধারার রাজনীতি ও রাষ্ট্র নির্মাণের সব সম্ভাবনাকে।
রাজনীতিতে অতি ডান, অতি বাম শক্তি_যাদের অবস্থান জাদুঘরে প্রায় চলে গিয়েছিল, তারাই পুনরুজ্জীবিত হলো। নতুন এবং প্রায় এককভাবে মেরুকরণ ঘটতে শুরু করে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সেই ধারার প্রধান শক্তি বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি আর পুরোপুরিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সহজে হতে পারবে না। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বে সব দ্বিতীয় ধারাপন্থী শক্তির একটি জোট তৈরি হয়। সেই জোট থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরে বের হয়ে এলেও দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে আস্থাশীল জাতীয় পার্টির অন্তত দুটি ছোট অংশ থেকে যায়। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের অবিস্মরণীয় বিষয় দ্বিতীয় ধারার সব রাজনৈতিক শক্তিকে কতখানি উদ্দীপিত, উজ্জীবিত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রচিন্তামুখী করেছিল, তা তাদের পাঁচ বছরের শাসন, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে স্পষ্ট হয়। তখন ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ধারার সব রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কোনো দিন প্রথম ধারার অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনীতির ক্ষমতায় আরোহণ সম্ভব হবে না। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক ছোট ছোট শক্তি, উগ্র বাম আদর্শের সব হঠকারী ব্যক্তি এবং সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুদূরপ্রসারী অবস্থান গ্রহণ করে। মধ্য-ডানের বিএনপিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের নামধারী প্রায় সব রাজনৈতিক সংগঠন, সংস্থা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাজনীতিতে যে ধরনের মেরুকরণ ঘটায়, তা দ্বিতীয় ধারার রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিকল্পনা থেকেই করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দুইভাবে করা হচ্ছিল। একটি দৃশ্যমান, অন্যটি অদৃশ্যমান। জঙ্গিবাদের বিস্তার, মদদদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে তাদের আদর্শের বিস্তার, সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ধারা উন্মুক্ত করা ইত্যাদিকে নগ্নভাবে সমর্থন দান করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চরমভাবে বিকৃতির মাধ্যমে একটি বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরি করা, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেভাবে রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। সে লক্ষ্যেই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়, ২০০৬ সালের ঘটনাবলি এবং ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই করা হয়। ২২ জানুয়ারির তথাকথিত 'নির্বাচনে' উতরে যাওয়া সম্ভব হলে দ্বিতীয় মেয়াদে জোট সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রকে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে প্রবাহিত করার আয়োজন সম্পন্ন করত। কিন্তু ১/১১-এর কারণে তা করা সেই সময়ে সম্ভব হয়নি।
বিএনপিকে কেন্দ্র করে ধর্মের নামধারী, উগ্র ডান ও বাম ছোট ছোট গোষ্ঠী ২০০৮ সালের নির্বাচনে এতখানি পরাজয় বরণ করবে তা ভাবতে পারেনি। ফলে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল, বছর দুই কিছুটা আড়ালে-আবডালে অবস্থান করেছিল। তা ছাড়া বিএনপি নিজেই তখন নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংকটে থাকায় উগ্রবাদী দলগুলো আশ্রয় লাভে কিছুটা সমস্যায় ছিল। তবে গত দুই বছরের রাজনৈতিক বক্তৃতা, বিবৃতি, আলোচনা, মিডিয়ায় একটি অংশের প্রচার-প্রচারণায় স্পষ্ট হয় যে দ্বিতীয় ধারায় অবস্থানকারী সব দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি তাদের অতীত রাজনৈতিক বিশ্বাসের অবস্থানে এখনো অনড়। তারা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মাঠ গরম করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে, মানুষকে ধর্মের নাম করে বিভ্রান্ত করার জন্য গ্রামেগঞ্জে। ধর্মীয় স্থানকে তারা রাজনীতির কেন্দ্র বানাতে চেয়েছে। নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বানে ৪ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল পালন করেছে। ওই হরতালকে নৈতিকভাবে বিএনপি সমর্থন প্রদান করে। একই সঙ্গে 'ইসলামবিরোধী' কোনো আইন দেশে বাস্তবায়িত হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। অথচ বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হয়নি নারীনীতির কোন কোন ধারায় ইসলাম তথা কোরআন, সুন্নাহবিরোধী বিষয় রয়েছে। হরতালকে কেন্দ্র করে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বিএনপিকে কেন্দ্র করে আবার উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত হচ্ছে, আন্দোলনের কর্মসূচিতে একে অপরকে সমর্থন দিতে শুরু করেছে। গত সংসদ অধিবেশনে যোগদান করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিল নির্বাচনে বিজয়ী নেতাদের দেওয়া সংবর্ধনা সভায় তিনি আবার ওই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। ওই ট্রাইব্যুনালকে 'তথাকথিত' বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি প্রকৃতই দেশে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের বিচার তিনি চান না। এর মাধ্যমে তিনি তাদের সমর্থন লাভের অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শে বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি ধারার রাষ্ট্র হিসেবে পেতে চায়_এমন আবেগ ও অন্ধবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব উপলব্ধিতে সক্ষম এমন মানুষের সংখ্যাও নানা কারণেই সেভাবে দেশে গড়ে উঠতে পারেনি। সেই সুযোগটি অতীতেও বিএনপি কয়েকবার নিতে পেরেছে। এ ধরনের বাস্তবতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন, চর্চা ও উদ্যোগ জরুরি তা আওয়ামী লীগ নিতে পারছে না, আওয়ামী লীগ প্রথম ধারার রাজনীতির ওপর নির্ভর করার প্রধান দল হওয়া সত্ত্বেও তা করতে পারছে না। ২০০৯ সাল থেকে প্রথম ধারার রাজনীতির মেরুকরণকে স্থায়ী রূপ দানে ব্যর্থ হলে উগ্রবাদী রাজনৈতিক শক্তি আবারও তাদের রাজনৈতিক মেরুকরণকে সংহত করতে সক্ষম হবে এটিই স্বাভাবিক। পরস্পরবিরোধী এই দুই রাজনৈতিক ধারার মধ্যে ক্রিয়াশীল লড়াইয়ে মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির লড়াইটি আদর্শিক, দেশপ্রেম, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ত্যাগ-তিতিক্ষাভিত্তিক; অন্যদিকে দ্বিতীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক ধারাটি পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল, উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে মানুষকে নিয়ে যাওয়ার একটি অপশক্তি। বিষয়গুলো স্পষ্ট করার কাজ সব অগ্রসর রাজনীতিবিদ, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রচার-সংশ্লিষ্ট মানুষ ও গোষ্ঠীর। তাহলেই কেবল মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় মানুষ অগ্রসর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারায় ক্রমাগত যুক্ত হতে থাকবে, তাহলেই রাষ্ট্রের আধুনিকায়ন সম্ভব হতে পারবে।
লেখক : ইতিহাসতত্ত্ববিদ, অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনীতিতে অতি ডান, অতি বাম শক্তি_যাদের অবস্থান জাদুঘরে প্রায় চলে গিয়েছিল, তারাই পুনরুজ্জীবিত হলো। নতুন এবং প্রায় এককভাবে মেরুকরণ ঘটতে শুরু করে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সেই ধারার প্রধান শক্তি বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি আর পুরোপুরিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সহজে হতে পারবে না। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বে সব দ্বিতীয় ধারাপন্থী শক্তির একটি জোট তৈরি হয়। সেই জোট থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরে বের হয়ে এলেও দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে আস্থাশীল জাতীয় পার্টির অন্তত দুটি ছোট অংশ থেকে যায়। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের অবিস্মরণীয় বিষয় দ্বিতীয় ধারার সব রাজনৈতিক শক্তিকে কতখানি উদ্দীপিত, উজ্জীবিত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রচিন্তামুখী করেছিল, তা তাদের পাঁচ বছরের শাসন, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে স্পষ্ট হয়। তখন ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ধারার সব রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কোনো দিন প্রথম ধারার অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনীতির ক্ষমতায় আরোহণ সম্ভব হবে না। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক ছোট ছোট শক্তি, উগ্র বাম আদর্শের সব হঠকারী ব্যক্তি এবং সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুদূরপ্রসারী অবস্থান গ্রহণ করে। মধ্য-ডানের বিএনপিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের নামধারী প্রায় সব রাজনৈতিক সংগঠন, সংস্থা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাজনীতিতে যে ধরনের মেরুকরণ ঘটায়, তা দ্বিতীয় ধারার রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিকল্পনা থেকেই করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দুইভাবে করা হচ্ছিল। একটি দৃশ্যমান, অন্যটি অদৃশ্যমান। জঙ্গিবাদের বিস্তার, মদদদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে তাদের আদর্শের বিস্তার, সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ধারা উন্মুক্ত করা ইত্যাদিকে নগ্নভাবে সমর্থন দান করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চরমভাবে বিকৃতির মাধ্যমে একটি বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরি করা, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেভাবে রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। সে লক্ষ্যেই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়, ২০০৬ সালের ঘটনাবলি এবং ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই করা হয়। ২২ জানুয়ারির তথাকথিত 'নির্বাচনে' উতরে যাওয়া সম্ভব হলে দ্বিতীয় মেয়াদে জোট সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রকে দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে প্রবাহিত করার আয়োজন সম্পন্ন করত। কিন্তু ১/১১-এর কারণে তা করা সেই সময়ে সম্ভব হয়নি।
বিএনপিকে কেন্দ্র করে ধর্মের নামধারী, উগ্র ডান ও বাম ছোট ছোট গোষ্ঠী ২০০৮ সালের নির্বাচনে এতখানি পরাজয় বরণ করবে তা ভাবতে পারেনি। ফলে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল, বছর দুই কিছুটা আড়ালে-আবডালে অবস্থান করেছিল। তা ছাড়া বিএনপি নিজেই তখন নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংকটে থাকায় উগ্রবাদী দলগুলো আশ্রয় লাভে কিছুটা সমস্যায় ছিল। তবে গত দুই বছরের রাজনৈতিক বক্তৃতা, বিবৃতি, আলোচনা, মিডিয়ায় একটি অংশের প্রচার-প্রচারণায় স্পষ্ট হয় যে দ্বিতীয় ধারায় অবস্থানকারী সব দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি তাদের অতীত রাজনৈতিক বিশ্বাসের অবস্থানে এখনো অনড়। তারা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মাঠ গরম করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে, মানুষকে ধর্মের নাম করে বিভ্রান্ত করার জন্য গ্রামেগঞ্জে। ধর্মীয় স্থানকে তারা রাজনীতির কেন্দ্র বানাতে চেয়েছে। নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বানে ৪ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল পালন করেছে। ওই হরতালকে নৈতিকভাবে বিএনপি সমর্থন প্রদান করে। একই সঙ্গে 'ইসলামবিরোধী' কোনো আইন দেশে বাস্তবায়িত হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। অথচ বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হয়নি নারীনীতির কোন কোন ধারায় ইসলাম তথা কোরআন, সুন্নাহবিরোধী বিষয় রয়েছে। হরতালকে কেন্দ্র করে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বিএনপিকে কেন্দ্র করে আবার উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত হচ্ছে, আন্দোলনের কর্মসূচিতে একে অপরকে সমর্থন দিতে শুরু করেছে। গত সংসদ অধিবেশনে যোগদান করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিল নির্বাচনে বিজয়ী নেতাদের দেওয়া সংবর্ধনা সভায় তিনি আবার ওই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। ওই ট্রাইব্যুনালকে 'তথাকথিত' বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি প্রকৃতই দেশে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের বিচার তিনি চান না। এর মাধ্যমে তিনি তাদের সমর্থন লাভের অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শে বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি ধারার রাষ্ট্র হিসেবে পেতে চায়_এমন আবেগ ও অন্ধবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব উপলব্ধিতে সক্ষম এমন মানুষের সংখ্যাও নানা কারণেই সেভাবে দেশে গড়ে উঠতে পারেনি। সেই সুযোগটি অতীতেও বিএনপি কয়েকবার নিতে পেরেছে। এ ধরনের বাস্তবতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন, চর্চা ও উদ্যোগ জরুরি তা আওয়ামী লীগ নিতে পারছে না, আওয়ামী লীগ প্রথম ধারার রাজনীতির ওপর নির্ভর করার প্রধান দল হওয়া সত্ত্বেও তা করতে পারছে না। ২০০৯ সাল থেকে প্রথম ধারার রাজনীতির মেরুকরণকে স্থায়ী রূপ দানে ব্যর্থ হলে উগ্রবাদী রাজনৈতিক শক্তি আবারও তাদের রাজনৈতিক মেরুকরণকে সংহত করতে সক্ষম হবে এটিই স্বাভাবিক। পরস্পরবিরোধী এই দুই রাজনৈতিক ধারার মধ্যে ক্রিয়াশীল লড়াইয়ে মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির লড়াইটি আদর্শিক, দেশপ্রেম, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ত্যাগ-তিতিক্ষাভিত্তিক; অন্যদিকে দ্বিতীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক ধারাটি পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল, উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে মানুষকে নিয়ে যাওয়ার একটি অপশক্তি। বিষয়গুলো স্পষ্ট করার কাজ সব অগ্রসর রাজনীতিবিদ, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রচার-সংশ্লিষ্ট মানুষ ও গোষ্ঠীর। তাহলেই কেবল মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় মানুষ অগ্রসর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারায় ক্রমাগত যুক্ত হতে থাকবে, তাহলেই রাষ্ট্রের আধুনিকায়ন সম্ভব হতে পারবে।
লেখক : ইতিহাসতত্ত্ববিদ, অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
No comments