সহজিয়া কড়চা-অলার শরম নাই, দেখনেঅলার শরম by সৈয়দ আবুল মকসুদ
উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি যথেষ্ট ভালো এবং আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত খারাপ করায় পরদিন সকালে এক স্বনামধন্য আমাকে বললেন, ‘লজ্জা, বড়ই লজ্জার কথা।’ ওই নির্বাচনে ৭২টি পৌরসভার মেয়র পদে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী ৩৫, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ২৩, জামায়াত-সমর্থিত পাঁচ এবং জাতীয় পার্টি-সমর্থিত দুই এবং নির্দলীয় সাতজন নির্বাচিত হন।
স্বনামধন্যকে আমি বললাম, খুনখারাবি ও মাথা ফাটাফাটিমুক্ত নির্বাচন হয়েছে, এতে লজ্জার কী? খুশির কথা।
তিনি বললেন, বিএনপি-জামায়াত ৪০ আর আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি ২৫—এ লজ্জা রাখি কোথায়?
আমি তাঁকে বললাম, নির্বাচনে হারা-জেতা কোনো লজ্জা- শরমের ব্যাপার নয়। এটাই গণতন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষ যখন যাঁকে চাইবে, তিনিই নির্বাচিত হবেন, যে দলকে অধিকাংশ মানুষ ভোট দেবে, সে দলই ক্ষমতায় যাবে। গণতন্ত্রের সেটাই বিধান। যাঁরা দলীয় রাজনীতি করেন, নির্বাচনে পরাজিত হলে তাঁদের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিপক্ষের ওপর অথবা ভোটারদের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়াও উচিত নয়। তবে তাঁর লজ্জিত হওয়ার কথায় আমার অনেক দিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ল।
সেবার দিল্লিতে গিয়ে উঠেছিলাম বিপিন চন্দ্র পাল মেমোরিয়াল ট্রাস্টের গেস্টহাউসে। সেটি বাঙালি-অধ্যুষিত চিত্তরঞ্জন পার্কে। সকালবেলা কিছু একটা কিনতে আমি দোকানে গেছি। সেখানে কথাবার্তা হচ্ছিল কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যে। ওই পাড়ার কোনো এক লোকের হাতেনাতে ঘুষ খাওয়া ধরা পড়ায় চাকরি চলে গেছে। একজন বললেন, ছি-ছি-ছি, লজ্জা লজ্জা। আরেক ভদ্রলোক থলে নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। তিনি বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ঘুষ খেয়ে সে চাকরি খুইয়েছে, লজ্জা তো তারই পাওয়ার কথা। আপনার কিসের লজ্জা। এ হলো হাগনেঅলার শরম নাই, দেখনেঅলার শরম।
অর্থাৎ ফাঁকা জায়গায় বসে পায়খানা করতে গিয়ে যদি কেউ শরম না পায়, যারা তাকে দ্যাখে, তাদের আর লজ্জা কী?
নানা কারণে কোনো নির্বাচনে বিশেষ দল বা প্রার্থী খারাপ করেন। বর্তমান পৌর নির্বাচনেও তা হতে পারে। আওয়ামী লীগ উত্তরাঞ্চলে যোগ্যতর প্রার্থী দেয়নি, অথবা মহাজোটের অন্যান্য দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য কাজ করেনি, দলীয় কোন্দলও থাকতে পারে অথবা শাসক দলের দুই বছরের কাজে মানুষ অসন্তুষ্ট। তাই তাদের মনোভাব ভোটের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। তাতে বিএনপি-জামায়াত ভালো করেছে। এই ভালো করার অর্থ এই নয় যে, দুই বছর বিএনপি-জামায়াত মানুষের কল্যাণে প্রচুর কাজ করেছে। হতে পারে তুলনামূলকভাবে তাদের প্রার্থী জনপ্রিয় ও যোগ্য।
আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েক বছর ধরে বলে আসছি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না করতে। নির্দলীয়ভাবে করতে। তাতে দলের বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে যেসব সম্মানিত সমাজকর্মী ও যোগ্য ব্যক্তি আছেন, তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যদিও যে কারও বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্য থাকতেই পারে, হতে পারেন তিনি কোনো দলের সদস্য। কোনো দলের স্থানীয় নেতাও হতে পারেন। দলীয় ভিত্তিতে হলে ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে তার প্রার্থীকে জয়ী করতে। পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতিতে প্রশাসন নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের সেই প্রস্তাব মহাজোট সরকার, এমনকি প্রধান বিরোধী দলও নাকচ করে দেয়। কোন ভীতি থেকে তারা তা করেছে, তা বোঝা যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। একটি ইমারতের মতো নিচের থেকে ধাপে ধাপে গণতন্ত্র গড়ে ওঠে। শুধু গণতন্ত্র গড়ে ওঠা নয়, নেতৃত্বও গড়ে ওঠে। স্থানীয় সরকারের নেতাদের থেকেই একদিন জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করছি, এবার যাঁরা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, আগামী দিনে তাঁদের অনেককেই আমরা জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দেখব। তাঁদেরই কেউ হবেন মন্ত্রী, চিফ হুইপ বা স্পিকার। এবং আরও আশা করি, তাঁরা অপেক্ষাকৃত যোগ্যতার সঙ্গেই তখন তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কারণ, পৌরসভা বা স্থানীয় সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের থাকবে।
বাংলাদেশের আজ সবচেয়ে বড় অভাব যা, তা হলো নেতৃত্বের সংকট। স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে যোগ্য, দূরদর্শী ও নিবেদিত নেতার অভাব। আগে নেতৃত্ব তৈরি হতো ছাত্ররাজনীতি থেকে। আশির দশকের পরে আমাদের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির ধারা শেষ হয়ে যায়। আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ তলে তলে আপসরফা যা-ই করুন, ব্যতিক্রম কেউ ছাড়া ছাত্রনেতারা ছিলেন আপসহীন। নব্বইয়ের দশকে ছাত্রনেতা বলে পরিচিত যাঁরা, তাঁরা বৈষয়িক দিকে ঝুঁকে পড়েন। বড় দলগুলোর, বিশেষ করে শাসক দলের আনুকূল্য বর্ষিত হয় তাঁদের ওপর। ছাত্ররাজনীতি তাঁদের কাছে বাণিজ্যবিশেষ। তাতে অনাগত নেতৃত্ব তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
গত বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে অসংখ্য সমাবেশে এই কথাটি বলতে চেয়েছি যে, দেশে যখন যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়, তখন নেতৃত্ব চলে যায় অরাজনৈতিক অপশক্তির হাতে। অসৎ ও খারাপ নেতৃত্ব তখন অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির জন্ম দেয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তার উদাহরণ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। ছাত্ররাজনীতি কলুষিত ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এখন আমাদের একমাত্র ভরসা স্থানীয় সরকার থেকে নেতৃত্ব তৈরি করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন সেই পথটা করে দেয়।
জাতীয় নেতৃত্বের ট্রেনিং বা প্রশাসনিক কাজের প্রশিক্ষণটা স্থানীয় প্রশাসন থেকে হওয়া উচিত এবং সব দেশে তা-ই হয়। আমাদের স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় এবং তাঁরা যদি সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে নিজেদের গড়ে তোলেন ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য, তা হলে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আর যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, জনগণের কাজ ফেলে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সয়সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন; এমপি, মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের পোঁ ধরে দুর্নীতিতে অংশ নেন, তা হলে তাঁরা যে শুধু দেশের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হবেন তা-ই নয়, নিজের এলাকাতেই জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা হারাবেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না।
আমাদের উপজেলা পরিষদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অনেক দিন হলো সেখানে নির্বাচন হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের কাজকম্ম নেই বললেই চলে। তাঁদের ওপর খবরদারি করার জন্য এমপিরা কোমর বেঁধেছিলেন। আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। অন্যদিকে খবরের কাগজ পড়ে মনে হয়েছে, চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত হয়েছেন একটি দামি জিপ পাওয়ার জন্য। জিপ জরুরি নয়, জনগণের জন্য কাজ করা জরুরি। অধিকাংশ উপজেলাই দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ১০-১২ মাইলের বেশি নয়। জিপ তাঁরা হাঁকাবেন কোথায়? অবশ্য স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-শ্যালক-শ্যালিকাদের ঢাকায় অনবরত আসা-যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আমি আমার শৈশবে দেখেছি, জেলা বোর্ডের নির্বাচিত কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সেকালের willy জিপে চড়ার সুযোগ পেত না। উল্লেখ করা দরকার, সেকালের জেলার পরিধি ছিল এখনকার ২০টি উপজেলার সমান। যদি কোনো দিন শুনি, কোনো চেয়ারম্যান ৪২ লাখ টাকার জিপ পাননি, সাইকেলে চড়ে যাতায়াত করছেন, তাঁকে গিয়ে সালাম জানিয়ে আসব।
দল-মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হলেও এখন মেয়রদের কর্তব্য হবে দলের ঊর্ধ্বে উঠে পৌর এলাকার সব মানুষের কল্যাণে কাজ করা। আওয়ামী লীগদলীয় মেয়রদের কাজ করতে হবে বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি-জামায়াত সবাইকে নিয়েই। বিএনপি-জামায়াতের মেয়রদের মহাজোটের দলগুলোর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে এবং তাঁদের পরামর্শমতো কাজ করতে হবে। ব্যক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে, কোনো শহরের তা নেই। পৌরসভা চায় উন্নয়ন। সে চায় তার অধিবাসীর জীবনযাত্রা উন্নততর হোক, অবকাঠামোর উন্নতি হোক, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকুক। কোনো শহরই চায় না তার নেতারা মতাদর্শ নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করে তার উন্নতির পথ রুদ্ধ করুক।
দলীয় রাজনীতি ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি সর্বজনীন সামাজিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতি মানুষকে অন্ধ বানায়—আলোকিত মানুষ তৈরি করে না। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকেরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সদ্গুণের কথা স্বীকার করবেন না। ধর্মপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল হলেও কোনো জামায়াত নেতার মধ্যে সততা ও কর্মদক্ষতা থাকতে পারে না—এ কথা কোনো আওয়ামী লীগ নেতার মনে করা সংগত নয়। যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা যে দলেরই হোন, এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি, তা স্বীকার করতেই হবে। এবং তার নামই গণতন্ত্র।
পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থানে মহাজোটের সমর্থকদের যাঁরা লজ্জিত হয়েছেন বা হতাশ হয়েছেন, তাঁরা নির্মোহভাবে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেননি। ভাবাবেগ তাঁদের যুক্তিশীলতা নষ্ট করে দিয়েছে, তাঁদের দৃষ্টি ঝাপসা করে দিয়েছে—অন্ধ যদি না-ও করে থাকে। তাই তাঁরা কোনো কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন না। নিজের ভুল ও দুর্বলতা তাঁদের চোখে পড়ে না। যে স্বনামখ্যাত আমার কাছে তাঁর লজ্জিত হওয়ার কথা বলেছেন, তাঁকে আমি বলেছি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরেই আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল। এখন দেরিতে লজ্জা পাওয়া ঠিক হচ্ছে না।
তাঁকে আমি আরও বলেছি, সিসিসি নির্বাচনের ফলাফল বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল আপনার দলের নেতাদের। তা তাঁরা করার প্রয়োজন মনে করেননি। নির্বাচনের আগে ও পরে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিনোদবিহারী চৌধুরীর টিভি চ্যানেলকে দেওয়া বক্তব্য আওয়ামী লীগের নেতা ও তাঁদের বুদ্ধিজীবীদের অনুধাবন করা উচিত ছিল। তিনি একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ। ১০০ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয়েছিল নির্বাচনের আগে। তিনি তাঁর সৎ মতামতই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন। স্তাবকতা করেননি।
গত ৩৯ বছরে বাংলার জনগণ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে পার হওয়ায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে। তারা নানা রকম সরকার দেখেছে। নির্বাচিত সরকার দেখেছে, অনির্বাচিত সরকার দেখেছে। প্রগতিশীল সরকার দেখেছে, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল সরকার দেখেছে। সামরিক সরকার দেখেছে, ঊন-সামরিক সরকার দেখেছে। অসাম্প্রদায়িক সরকার দেখেছে, সাম্প্রদায়িক সরকারও দেখেছে। বাঙালি শাসকদের শাসনেও তারা ছিল, বাংলাদেশি শাসকদের অধীনেও ছিল। তাদের অভিজ্ঞতার শেষ নেই।
সাম্প্রদায়িকতা একটি ব্যাধি। তবে উপমহাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা একটি সুবিধাও বটে। কোনো দল সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করে বেশি ভোট পায়। কোনো দল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়ী হতে চায়। একটি প্রচলিত ধারণা যে বিএনপি-জামায়াত মুসলমানদের ভোট বেশি পায়। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী বলে অমুসলমানদের ভোটটা টানে বেশি। দুই পক্ষের এই থিওরির কারণে ভারতের মতো বাংলাদেশেও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি সুবিধামতো ব্যবহূত হয়। ফলে সাম্প্রদায়িকতা টিকেও আছে। বছরে এমন একটি দিন নেই যেদিন বাম প্রগতিশীল দলের নেতারা সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি উচ্চারণ করেন না। কিন্তু তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটও পান না, সংখ্যালঘুর ভোটও পান না। সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতি করার থিওরি যে অচল হয়ে পড়েছে, তা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও পৌর নির্বাচনগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শ্রদ্ধেয় বিনোদবিহারী চৌধুরী সে কথাটিই বলেছিলেন। কেউ তাঁর কথায় কান দেননি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে তাদের পুরোনো কৌশল ও নীতি সংশোধন করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করে না। বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির সুশান্ত কুমার শান্ত। দলের বিদ্রোহী মুসলমান প্রার্থী না থাকলে তিনি বিপুল ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করতেন। শেরপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির স্বাধীন কুমার কুন্ডু। আওয়ামী লীগের মুসলমান প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। বদরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের উত্তম কুমার সাহা। নন্দীগ্রাম, শেরপুর ও বদরগঞ্জ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নয়।
বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের কাছে ধর্মীয় পরিচয় কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। যোগ্যতর ও ভালো মানুষ হলে মুসলমান মোল্লা-মুসল্লি পর্যন্ত অমুসলমান প্রার্থীকে ভোট দেন; হিন্দু-বৌদ্ধ ভোটাররা টুপি-দাড়িওয়ালা প্রার্থীর মার্কায় সিল মারেন। প্রার্থী কোন দলের, সেটাও তাঁরা ভাবেন না। তাই বিএনপির হিন্দু প্রার্থী পাস করেন, আওয়ামী লীগের মুসলমান প্রার্থী ফেল করেন। ‘পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র’টির নাম শুনলে এখন যাঁরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, সেই পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু ভোটাভুটিতে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ছিল না। তা থাকলে সামরিক একনায়ক আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’র মধ্যেও বহু হিন্দু ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মেম্বর নির্বাচিত হতে পারতেন না। সম্ভ্রান্ত মুসলমান এলাকায় নমঃশূদ্র হিন্দু নির্বাচিত হয়েছেন।
সব ধর্মের সমন্বিত সংস্কৃতির সমাজ আমাদের। যার যার ধর্ম তার তার কাছে প্রিয় ও পবিত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না—ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বাণিজ্য করেন বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে, হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসী ভোটাররা বিএনপির প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির নেতারা তাঁদের প্রতি সুবিচার করেননি। সেক্যুলারওয়ালারাও তাঁদের প্রতি সুবিচার করেন না। দুর্ভাগ্য তাঁদের। যাঁরা নির্বাচিত হন তাঁদের ভোটে, ভাগ্যবান তাঁরাই।
ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করে ৯৪ ভাগ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে দুই শাসক দলের নেতাদের বিবেক একটুও দংশন করে না। লাখ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসী ভিটেমাটি হারাবে। গোটা উত্তরবঙ্গের পরিবেশ ধ্বংস হবে। সেখানকার জনগণ কী চায়, তা তারা একবার রক্ত দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। এবার পৌর নির্বাচনে ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল। তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সমর্থিত প্রার্থী মানিক সরকার নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি-আওয়ামী লীগকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। ওই এলাকার মানুষ ধর্ম-বর্ণ-জাতি কিছুই বিবেচনা করেনি, বিবেচনা করেছে জাতীয় স্বার্থ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নির্বাচন বড় দলগুলোকে আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ করে দেয়। খারাপ ফলাফলে সমর্থকদের মন খারাপ হতে পারে, কখনো তাদের লজ্জাও হতে পারে। কিন্তু আনন্দিত বা লজ্জিত হওয়া উচিত নেতাদের। নানা কারণে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা কমে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার বশে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করলে, দলীয়করণ সীমা ছাড়িয়ে গেলে, খাদ্যশস্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, শেয়ারবাজারে বিপর্যয় ঘটলে, অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের হিংস্র-কার্যকলাপে, কাজের চেয়ে কথা বেশি বললে, সরকারি কর্মকর্তাদের ভৃত্যের মতো ব্যবহার করতে চাইলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে, আদালত ও অন্যান্য সংস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করলে, অকারণে অর্থহীন প্রকল্প গ্রহণ করে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুললে, বিল-বাঁওড় সব অধিগ্রহণ করে শ্রমজীবী মানুষকে উচ্ছেদ করতে চাইলে, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করলে—জনসমর্থন কমে যায়। বর্তমান পৌরসভার নির্বাচনও বড় দলগুলোর জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
তিনি বললেন, বিএনপি-জামায়াত ৪০ আর আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি ২৫—এ লজ্জা রাখি কোথায়?
আমি তাঁকে বললাম, নির্বাচনে হারা-জেতা কোনো লজ্জা- শরমের ব্যাপার নয়। এটাই গণতন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষ যখন যাঁকে চাইবে, তিনিই নির্বাচিত হবেন, যে দলকে অধিকাংশ মানুষ ভোট দেবে, সে দলই ক্ষমতায় যাবে। গণতন্ত্রের সেটাই বিধান। যাঁরা দলীয় রাজনীতি করেন, নির্বাচনে পরাজিত হলে তাঁদের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিপক্ষের ওপর অথবা ভোটারদের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়াও উচিত নয়। তবে তাঁর লজ্জিত হওয়ার কথায় আমার অনেক দিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ল।
সেবার দিল্লিতে গিয়ে উঠেছিলাম বিপিন চন্দ্র পাল মেমোরিয়াল ট্রাস্টের গেস্টহাউসে। সেটি বাঙালি-অধ্যুষিত চিত্তরঞ্জন পার্কে। সকালবেলা কিছু একটা কিনতে আমি দোকানে গেছি। সেখানে কথাবার্তা হচ্ছিল কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যে। ওই পাড়ার কোনো এক লোকের হাতেনাতে ঘুষ খাওয়া ধরা পড়ায় চাকরি চলে গেছে। একজন বললেন, ছি-ছি-ছি, লজ্জা লজ্জা। আরেক ভদ্রলোক থলে নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। তিনি বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ঘুষ খেয়ে সে চাকরি খুইয়েছে, লজ্জা তো তারই পাওয়ার কথা। আপনার কিসের লজ্জা। এ হলো হাগনেঅলার শরম নাই, দেখনেঅলার শরম।
অর্থাৎ ফাঁকা জায়গায় বসে পায়খানা করতে গিয়ে যদি কেউ শরম না পায়, যারা তাকে দ্যাখে, তাদের আর লজ্জা কী?
নানা কারণে কোনো নির্বাচনে বিশেষ দল বা প্রার্থী খারাপ করেন। বর্তমান পৌর নির্বাচনেও তা হতে পারে। আওয়ামী লীগ উত্তরাঞ্চলে যোগ্যতর প্রার্থী দেয়নি, অথবা মহাজোটের অন্যান্য দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য কাজ করেনি, দলীয় কোন্দলও থাকতে পারে অথবা শাসক দলের দুই বছরের কাজে মানুষ অসন্তুষ্ট। তাই তাদের মনোভাব ভোটের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। তাতে বিএনপি-জামায়াত ভালো করেছে। এই ভালো করার অর্থ এই নয় যে, দুই বছর বিএনপি-জামায়াত মানুষের কল্যাণে প্রচুর কাজ করেছে। হতে পারে তুলনামূলকভাবে তাদের প্রার্থী জনপ্রিয় ও যোগ্য।
আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েক বছর ধরে বলে আসছি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না করতে। নির্দলীয়ভাবে করতে। তাতে দলের বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে যেসব সম্মানিত সমাজকর্মী ও যোগ্য ব্যক্তি আছেন, তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যদিও যে কারও বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্য থাকতেই পারে, হতে পারেন তিনি কোনো দলের সদস্য। কোনো দলের স্থানীয় নেতাও হতে পারেন। দলীয় ভিত্তিতে হলে ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে তার প্রার্থীকে জয়ী করতে। পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতিতে প্রশাসন নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের সেই প্রস্তাব মহাজোট সরকার, এমনকি প্রধান বিরোধী দলও নাকচ করে দেয়। কোন ভীতি থেকে তারা তা করেছে, তা বোঝা যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। একটি ইমারতের মতো নিচের থেকে ধাপে ধাপে গণতন্ত্র গড়ে ওঠে। শুধু গণতন্ত্র গড়ে ওঠা নয়, নেতৃত্বও গড়ে ওঠে। স্থানীয় সরকারের নেতাদের থেকেই একদিন জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করছি, এবার যাঁরা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, আগামী দিনে তাঁদের অনেককেই আমরা জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দেখব। তাঁদেরই কেউ হবেন মন্ত্রী, চিফ হুইপ বা স্পিকার। এবং আরও আশা করি, তাঁরা অপেক্ষাকৃত যোগ্যতার সঙ্গেই তখন তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কারণ, পৌরসভা বা স্থানীয় সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের থাকবে।
বাংলাদেশের আজ সবচেয়ে বড় অভাব যা, তা হলো নেতৃত্বের সংকট। স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে যোগ্য, দূরদর্শী ও নিবেদিত নেতার অভাব। আগে নেতৃত্ব তৈরি হতো ছাত্ররাজনীতি থেকে। আশির দশকের পরে আমাদের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির ধারা শেষ হয়ে যায়। আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ তলে তলে আপসরফা যা-ই করুন, ব্যতিক্রম কেউ ছাড়া ছাত্রনেতারা ছিলেন আপসহীন। নব্বইয়ের দশকে ছাত্রনেতা বলে পরিচিত যাঁরা, তাঁরা বৈষয়িক দিকে ঝুঁকে পড়েন। বড় দলগুলোর, বিশেষ করে শাসক দলের আনুকূল্য বর্ষিত হয় তাঁদের ওপর। ছাত্ররাজনীতি তাঁদের কাছে বাণিজ্যবিশেষ। তাতে অনাগত নেতৃত্ব তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
গত বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে অসংখ্য সমাবেশে এই কথাটি বলতে চেয়েছি যে, দেশে যখন যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়, তখন নেতৃত্ব চলে যায় অরাজনৈতিক অপশক্তির হাতে। অসৎ ও খারাপ নেতৃত্ব তখন অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির জন্ম দেয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তার উদাহরণ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। ছাত্ররাজনীতি কলুষিত ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এখন আমাদের একমাত্র ভরসা স্থানীয় সরকার থেকে নেতৃত্ব তৈরি করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন সেই পথটা করে দেয়।
জাতীয় নেতৃত্বের ট্রেনিং বা প্রশাসনিক কাজের প্রশিক্ষণটা স্থানীয় প্রশাসন থেকে হওয়া উচিত এবং সব দেশে তা-ই হয়। আমাদের স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় এবং তাঁরা যদি সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে নিজেদের গড়ে তোলেন ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য, তা হলে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আর যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, জনগণের কাজ ফেলে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সয়সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন; এমপি, মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের পোঁ ধরে দুর্নীতিতে অংশ নেন, তা হলে তাঁরা যে শুধু দেশের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হবেন তা-ই নয়, নিজের এলাকাতেই জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা হারাবেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না।
আমাদের উপজেলা পরিষদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অনেক দিন হলো সেখানে নির্বাচন হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের কাজকম্ম নেই বললেই চলে। তাঁদের ওপর খবরদারি করার জন্য এমপিরা কোমর বেঁধেছিলেন। আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। অন্যদিকে খবরের কাগজ পড়ে মনে হয়েছে, চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত হয়েছেন একটি দামি জিপ পাওয়ার জন্য। জিপ জরুরি নয়, জনগণের জন্য কাজ করা জরুরি। অধিকাংশ উপজেলাই দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ১০-১২ মাইলের বেশি নয়। জিপ তাঁরা হাঁকাবেন কোথায়? অবশ্য স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-শ্যালক-শ্যালিকাদের ঢাকায় অনবরত আসা-যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আমি আমার শৈশবে দেখেছি, জেলা বোর্ডের নির্বাচিত কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সেকালের willy জিপে চড়ার সুযোগ পেত না। উল্লেখ করা দরকার, সেকালের জেলার পরিধি ছিল এখনকার ২০টি উপজেলার সমান। যদি কোনো দিন শুনি, কোনো চেয়ারম্যান ৪২ লাখ টাকার জিপ পাননি, সাইকেলে চড়ে যাতায়াত করছেন, তাঁকে গিয়ে সালাম জানিয়ে আসব।
দল-মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হলেও এখন মেয়রদের কর্তব্য হবে দলের ঊর্ধ্বে উঠে পৌর এলাকার সব মানুষের কল্যাণে কাজ করা। আওয়ামী লীগদলীয় মেয়রদের কাজ করতে হবে বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি-জামায়াত সবাইকে নিয়েই। বিএনপি-জামায়াতের মেয়রদের মহাজোটের দলগুলোর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে এবং তাঁদের পরামর্শমতো কাজ করতে হবে। ব্যক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে, কোনো শহরের তা নেই। পৌরসভা চায় উন্নয়ন। সে চায় তার অধিবাসীর জীবনযাত্রা উন্নততর হোক, অবকাঠামোর উন্নতি হোক, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকুক। কোনো শহরই চায় না তার নেতারা মতাদর্শ নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করে তার উন্নতির পথ রুদ্ধ করুক।
দলীয় রাজনীতি ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি সর্বজনীন সামাজিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতি মানুষকে অন্ধ বানায়—আলোকিত মানুষ তৈরি করে না। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকেরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সদ্গুণের কথা স্বীকার করবেন না। ধর্মপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল হলেও কোনো জামায়াত নেতার মধ্যে সততা ও কর্মদক্ষতা থাকতে পারে না—এ কথা কোনো আওয়ামী লীগ নেতার মনে করা সংগত নয়। যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা যে দলেরই হোন, এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি, তা স্বীকার করতেই হবে। এবং তার নামই গণতন্ত্র।
পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থানে মহাজোটের সমর্থকদের যাঁরা লজ্জিত হয়েছেন বা হতাশ হয়েছেন, তাঁরা নির্মোহভাবে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেননি। ভাবাবেগ তাঁদের যুক্তিশীলতা নষ্ট করে দিয়েছে, তাঁদের দৃষ্টি ঝাপসা করে দিয়েছে—অন্ধ যদি না-ও করে থাকে। তাই তাঁরা কোনো কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন না। নিজের ভুল ও দুর্বলতা তাঁদের চোখে পড়ে না। যে স্বনামখ্যাত আমার কাছে তাঁর লজ্জিত হওয়ার কথা বলেছেন, তাঁকে আমি বলেছি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরেই আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল। এখন দেরিতে লজ্জা পাওয়া ঠিক হচ্ছে না।
তাঁকে আমি আরও বলেছি, সিসিসি নির্বাচনের ফলাফল বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল আপনার দলের নেতাদের। তা তাঁরা করার প্রয়োজন মনে করেননি। নির্বাচনের আগে ও পরে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিনোদবিহারী চৌধুরীর টিভি চ্যানেলকে দেওয়া বক্তব্য আওয়ামী লীগের নেতা ও তাঁদের বুদ্ধিজীবীদের অনুধাবন করা উচিত ছিল। তিনি একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ। ১০০ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয়েছিল নির্বাচনের আগে। তিনি তাঁর সৎ মতামতই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন। স্তাবকতা করেননি।
গত ৩৯ বছরে বাংলার জনগণ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে পার হওয়ায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে। তারা নানা রকম সরকার দেখেছে। নির্বাচিত সরকার দেখেছে, অনির্বাচিত সরকার দেখেছে। প্রগতিশীল সরকার দেখেছে, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল সরকার দেখেছে। সামরিক সরকার দেখেছে, ঊন-সামরিক সরকার দেখেছে। অসাম্প্রদায়িক সরকার দেখেছে, সাম্প্রদায়িক সরকারও দেখেছে। বাঙালি শাসকদের শাসনেও তারা ছিল, বাংলাদেশি শাসকদের অধীনেও ছিল। তাদের অভিজ্ঞতার শেষ নেই।
সাম্প্রদায়িকতা একটি ব্যাধি। তবে উপমহাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা একটি সুবিধাও বটে। কোনো দল সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করে বেশি ভোট পায়। কোনো দল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়ী হতে চায়। একটি প্রচলিত ধারণা যে বিএনপি-জামায়াত মুসলমানদের ভোট বেশি পায়। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী বলে অমুসলমানদের ভোটটা টানে বেশি। দুই পক্ষের এই থিওরির কারণে ভারতের মতো বাংলাদেশেও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি সুবিধামতো ব্যবহূত হয়। ফলে সাম্প্রদায়িকতা টিকেও আছে। বছরে এমন একটি দিন নেই যেদিন বাম প্রগতিশীল দলের নেতারা সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি উচ্চারণ করেন না। কিন্তু তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটও পান না, সংখ্যালঘুর ভোটও পান না। সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতি করার থিওরি যে অচল হয়ে পড়েছে, তা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও পৌর নির্বাচনগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শ্রদ্ধেয় বিনোদবিহারী চৌধুরী সে কথাটিই বলেছিলেন। কেউ তাঁর কথায় কান দেননি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে তাদের পুরোনো কৌশল ও নীতি সংশোধন করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করে না। বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির সুশান্ত কুমার শান্ত। দলের বিদ্রোহী মুসলমান প্রার্থী না থাকলে তিনি বিপুল ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করতেন। শেরপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির স্বাধীন কুমার কুন্ডু। আওয়ামী লীগের মুসলমান প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। বদরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের উত্তম কুমার সাহা। নন্দীগ্রাম, শেরপুর ও বদরগঞ্জ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নয়।
বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের কাছে ধর্মীয় পরিচয় কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। যোগ্যতর ও ভালো মানুষ হলে মুসলমান মোল্লা-মুসল্লি পর্যন্ত অমুসলমান প্রার্থীকে ভোট দেন; হিন্দু-বৌদ্ধ ভোটাররা টুপি-দাড়িওয়ালা প্রার্থীর মার্কায় সিল মারেন। প্রার্থী কোন দলের, সেটাও তাঁরা ভাবেন না। তাই বিএনপির হিন্দু প্রার্থী পাস করেন, আওয়ামী লীগের মুসলমান প্রার্থী ফেল করেন। ‘পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র’টির নাম শুনলে এখন যাঁরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, সেই পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু ভোটাভুটিতে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ছিল না। তা থাকলে সামরিক একনায়ক আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’র মধ্যেও বহু হিন্দু ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মেম্বর নির্বাচিত হতে পারতেন না। সম্ভ্রান্ত মুসলমান এলাকায় নমঃশূদ্র হিন্দু নির্বাচিত হয়েছেন।
সব ধর্মের সমন্বিত সংস্কৃতির সমাজ আমাদের। যার যার ধর্ম তার তার কাছে প্রিয় ও পবিত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না—ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বাণিজ্য করেন বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে, হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসী ভোটাররা বিএনপির প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির নেতারা তাঁদের প্রতি সুবিচার করেননি। সেক্যুলারওয়ালারাও তাঁদের প্রতি সুবিচার করেন না। দুর্ভাগ্য তাঁদের। যাঁরা নির্বাচিত হন তাঁদের ভোটে, ভাগ্যবান তাঁরাই।
ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করে ৯৪ ভাগ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে দুই শাসক দলের নেতাদের বিবেক একটুও দংশন করে না। লাখ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসী ভিটেমাটি হারাবে। গোটা উত্তরবঙ্গের পরিবেশ ধ্বংস হবে। সেখানকার জনগণ কী চায়, তা তারা একবার রক্ত দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। এবার পৌর নির্বাচনে ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল। তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সমর্থিত প্রার্থী মানিক সরকার নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি-আওয়ামী লীগকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। ওই এলাকার মানুষ ধর্ম-বর্ণ-জাতি কিছুই বিবেচনা করেনি, বিবেচনা করেছে জাতীয় স্বার্থ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নির্বাচন বড় দলগুলোকে আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ করে দেয়। খারাপ ফলাফলে সমর্থকদের মন খারাপ হতে পারে, কখনো তাদের লজ্জাও হতে পারে। কিন্তু আনন্দিত বা লজ্জিত হওয়া উচিত নেতাদের। নানা কারণে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা কমে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার বশে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করলে, দলীয়করণ সীমা ছাড়িয়ে গেলে, খাদ্যশস্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, শেয়ারবাজারে বিপর্যয় ঘটলে, অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের হিংস্র-কার্যকলাপে, কাজের চেয়ে কথা বেশি বললে, সরকারি কর্মকর্তাদের ভৃত্যের মতো ব্যবহার করতে চাইলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে, আদালত ও অন্যান্য সংস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করলে, অকারণে অর্থহীন প্রকল্প গ্রহণ করে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুললে, বিল-বাঁওড় সব অধিগ্রহণ করে শ্রমজীবী মানুষকে উচ্ছেদ করতে চাইলে, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করলে—জনসমর্থন কমে যায়। বর্তমান পৌরসভার নির্বাচনও বড় দলগুলোর জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments