গোধূলির ছায়াপথে-লেখার জন্ম বেদনার মধ্যে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

মধ্য নভেম্বর থেকেই লেখকেরা গা ঢাকা দেন। সামাজিক অনুষ্ঠান, সভা, সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতায়—কোথাও নেই। নিদারুণ ব্যস্ত লেখা নিয়ে, সামনে যে বইমেলা। শীর্ষেন্দুর মতো লেখকেরা পূজার অনেক আগেই পালান অস্ট্রেলিয়া বা পাপুয়া নিউগিনিতে। ফেরেন আনকোরা উপন্যাস, গল্প নিয়ে।


আমাকে বললেন শীর্ষেন্দু, পাঠকেরা ভাবেন সহজেই এসে গেছে চরিত্রগুলো, তা নয়। তারা অনেক দিন ধরে আমার মধ্যে প্রবেশ করে থাকে, আমাকে কাঁদায়, হাসায়, তারপর লিখি।
ব্যস্ত লেখকদের রাজা হুমায়ূন আহমেদ শত শত বই লেখার পর লিখেছেন সিনেমা। বই পড়ে যখন ফেলে দেন পাঠক, হলে যাওয়া যখন ছেড়ে দেন দর্শক, হুমায়ূন চকিতে পরিবর্তন করেন স্ট্র্যাটেজি। টেলিভিশনের সামনে এখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ভিডিওর দর্শক। গল্পে ও কথার ফাঁদে তাঁরা লা-জওয়াব। প্রকাশকেরা বাড়ি চেনেন হাতে গোনা লেখকেরই, বাকিরা যেন ভেসে এসেছেন উত্তরের বানের জলে। ...‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হকের মতো কিছু ছাড়ুন, তার আগেই কড়ির হিসাব?’ ফুচকো, চিনাবাদাম ও বেলুনওয়ালাদের বাটাবিক্রি শুকনো মুখ নতুন লেখকদের চেয়ে বেশি, গত বছর বইমেলায় তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারি।
‘দূরের বাদ্যি মধুর’। দেখিনি যাঁদের, তাঁদের জন্য পাঠকদের আগ্রহ। বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন অপরিচয়ের অবগুণ্ঠন খুলে সামনে এসে দাঁড়ান, চিনতে পারি মুহূর্তে। তাঁরা শুধু্ই লেখক, মানুষের জীবনের কত অজানা গল্প সূক্ষ্ম দৃষ্টির সামনে প্রতিভাত। নিউইয়র্কে, লস অ্যাঞ্জেলেসে, ডালাসে, হিউসটনে, ওয়াশিংটনে, লন্ডনে, প্যারিসে বাঙালিদের বইয়ের র্যাকে খুঁজে পাই পাঠক-পাঠিকাদের সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ, লেখকদের শেষ গন্তব্য।
সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা, শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর মতো নন্দিত গ্রন্থরাজি তাঁদের বেডরুমেই আবিষ্কার করি। হই-হট্টগোলে নয়, নিভৃতে স্বল্প আলোকে পঠিত আদরণীয় গ্রন্থ, পাঠক-পাঠিকা তাঁদের পছন্দের লেখক খুঁজে পান; বাজানো হয় গানগুলো, যা জয় করেছে শ্রোতার মন। আলী ইমাম, তিন শ গ্রন্থের জনক বললেন: ‘টেলিভিশন থেকে অবসর নিয়েছি, তবু অবসরে নই। লিখতাম এক হাতে, এখন দুই হাতে। অপর হাতটির নাম কম্পিউটার। অর্থ নয়, মান নয়, সম্মান নয়, নিশুতি রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে, আমি অতন্দ্র জাগর শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে, যেদিন শিশুটি আমার লেখা নতুন বই হাতে নেয়। আমার রাত জাগা মনে হয় সার্থক।’
মেলায় যাঁর সঙ্গেই দেখা হয় লিখেছেন শতাধিক, বন্ধু মোবারক হোসেন খানেরও তাই, ‘আমার মোটে কয়েকটি।’ খানিকটা দমে যাই বৈকি। তখনই মনে পড়ল নজরুলের গান: ‘আমার আছে এই ক’খানি গান, তা দিয়ে কি ভরবে তোমার প্রাণ’। চার হাজার গান লেখার পরও নজরুলের মনে হয়েছে: ‘অনেক বেশি তোমার দাবি, শূন্য হাতে তাই তো ভাবি, কি দান দিয়ে ভাঙ্গব তোমার গভীর অভিমান’। টেলিভিশনে গানটি গেয়েছিলেন আসাফ্উদ্দৌলাহ্। নজরুলের প্রেম সংগীতের মধ্যে সর্বাধিক পছন্দ গানটি, সম্ভবত আসাফ্উদ্দৌলাহ্র নিজের সুর। ফোন করে বললাম: আমাকে কি তুলে দেওয়া সম্ভব? বললেন, ‘তোমাকে সিডি পাঠাচ্ছি। সুরটি সুন্দর।’
আমার চাচা আবদুল করিম লিখেছিলেন শতাধিক ভাওয়াইয়া, গেয়েছেন আমার পিতা ও আমি। গভীর রাতে চাচা গানগুলো লিখতেন। এ গানগুলো তো আজও বেঁচে। কবি গোলাম মুস্তাফা ভোরবেলায় বুকে বালিশ চেপে লিখতেন বিশ্বনবী, প্রতি সংস্করণে বইটি হতো স্ফীত, যা পৌঁছে গেছে বাংলার ঘরে ঘরে। অধমের রচনাপ্রয়াস আমেরিকার গ্রন্থাগারে নানা গ্রন্থ স্পর্শ করে, মুহাম্মদের নাম [সা.] এক্ষণে বাংলার দিগন্ত স্পর্শধন্য। প্রশংসাবাক্য বা আলোচনার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন যা, পাঠকদের স্বীকৃতি।
পুরোনো বন্ধুর সাতটি বই বেরোবে এ বছর। তাই টেলিফোন, দর্শন, বাক্যালাপ বন্ধ। অনেক আগে একবার সে আমাকে বলেছিল, ‘জানো আব্বাসী, এটি প্রসব বেদনার মতো।’ সত্যি তাই। যে লেখা, যে গান শুধু আমার হূদয়েই গুঞ্জরিত, তাকে আনব জনারণ্যে। এটাও তো জন্মের মতো বেদনার, যদিও অন্যের জন্য তা আনন্দের।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.