ইলিয়াস নিখোঁজ রহস্য-এখন প্রত্যক্ষদর্শীর ছড়াছড়ি তথ্যেও নানা গরমিল by মাসুদুল আলম তুষার
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার ১০ দিন পরও কোনো 'গ্রহণযোগ্য' প্রত্যক্ষদর্শী পাননি তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অথচ গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে।
অপহরণের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদার বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তাঁদের দেওয়া তথ্য যাচাই শেষে কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় নির্ভর করা যায়- এমন কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না পাওয়াটাকেও বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সব কিছু মিলিয়ে গতকাল শুক্রবার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চললেও এখন পর্যন্ত তাঁর নিখোঁজ ঘটনারই কূল-কিনারা পাওয়া যায়নি। কিভাবে কারা তাঁকে অপহরণ করেছে, সে ব্যাপারে নূ্যনতম তথ্য না পেলে ভিকটিমকে উদ্ধার করা কঠিন। ঘনিষ্ঠজনদের সহযোগিতার অভাব ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ঘাটতির জন্য অনুসন্ধানকাজে বিলম্ব হচ্ছে বলেও তাঁরা দাবি করেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সম্ভব সব কিছুই করা হচ্ছে। দেশের সব থানায় এরই মধ্যে বার্তা পাঠানো হয়েছে। ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যেখানে যখন যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গেই যাচাই করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ দুজনের সন্ধান মেলেনি।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, সাবেক এই সংসদ সদস্যের নিখোঁজ বিষয়ে অনুসন্ধানে পুলিশকে সহায়তার জন্য র্যাবের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। তাঁর সন্ধান পেতে র্যাব সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ঘটনার সম্ভাব্য কারণ যাচাই এবং জড়িতদের ব্যাপারে ধারণা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। নিখোঁজ ঘটনাটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জটিলও। সে ক্ষেত্রে সব কিছু যাচাই করতে সময় কিছুটা বেশি লাগছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অপহৃত হওয়ার দুই দিন আগে ইলিয়াস আলী সিলেটে গিয়েছিলেন। তিনি একটি মামলায় হাজিরার জন্য সেখানে যান বলে ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। তবে তিনি দুই দিনে সিলেটের একাধিক হোটেলে বৈঠক করেছেন। এসব গোপন বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ও অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় কারা ফিরেছেন সে ব্যাপারেও তথ্য নেওয়া হচ্ছে। নিখোঁজ ঘটনার আগের বিষয়গুলোই ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে এই অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ইতিমধ্যে অনেকে দাবি করলেও তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা মিলছে না বলেও তদন্ত কর্মকর্তারা জানান। গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন তথ্য ও অপহরণ ঘটনার বর্ণনা যাচাই করে কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তকালে ধারণালাভে সহায়ক হলেও তথ্যগুলো আপাতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদারদের বর্ণনায় অনেক গরমিল পাওয়া যাচ্ছে।
গত কয়েক দিনে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদারদের বর্ণনা অনুসারে, বনানী ২ নম্বর সড়কে রাত সোয়া ১২টার দিকে ইলিয়াস আলীর প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ায় প্রথমে তা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা হয়। এরপর অপহরণকারীরা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। অপহরণকারীরা ইলিয়াস আলীকে গালাগালও করে। ইলিয়াস আলী 'বাঁচাও, বাঁচাও' বলে চিৎকার করেন। পার্কে ঘুমানো একজন ডাব বিক্রেতা ও নির্মাণাধীন ভবনের প্রহরী অপহরণ ঘটনার শুরু থেকেই অনেক কিছু দেখেছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডাব বিক্রেতা সোহেল গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন যে হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। 'একটি লোক'কে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। চার ব্যক্তি গাড়িতে উঠানোর সময় লোকটিকে কিলঘুষিও মারে। গাড়িতে উঠিয়ে তাঁকে বনানী ১ নম্বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল রাত সোয়া ১২টার দিকে বনানীর ২ নম্বর সড়কে এ রকম দৃশ্য বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে অপহরণের ঘটনাকে সমর্থন করে। সোহেল ছবি দেখে অপহৃত ব্যক্তি ইলিয়াস আলী বলে দাবি করেছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত তাঁর সাক্ষাৎকারের সূত্রে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে এ বর্ণনায় যথেষ্ট গরমিল খুঁজে পায়। পার্কের যে স্থানে ঘুমিয়ে ছিলেন বলে সোহেল দাবি করেছেন, সেখান থেকে যে দূরত্বে ঘটনা ঘটেছে তা ঘুম থেকে জেগে উঠে স্পষ্টভাবে দেখা অনেকটাই অবিশ্বাস্য। আবার খুব কাছে থেকে কেউ ঘটনা দেখলে তাকেও অপহরণকারীরা সহজে ছেড়ে দিত না। সোহেল তাঁর পাশে আরেকজন ঘুমাচ্ছিল বলেও দাবি করেছেন। কিন্তু তার পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার বনানী থানায় সোহেলকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে 'বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা' পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, বনানীর ২ নম্বর সড়কের এক পাশে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অন্য পাশে নির্মাণাধীন ভবন নূর টাওয়ার। নূর টাওয়ারের সামনেই একটি ছোট্ট পার্ক। ইলিয়াস আলীর গাড়ি রাস্তার মাঝে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ওই পথে যাতায়াতকারী কয়েকটি গাড়ি আটকা পড়ে। সংবাদ পেয়ে পুলিশও সেখানে যায় এবং গাড়ি স্কুলের দিকে সরিয়ে নেয়। সোহেল সম্ভবত সে দৃশ্যের কোনো অংশ দেখে এ ধরনের বর্ণনা দিচ্ছেন।
ওদিকে ইলিয়াস আলীর গাড়ি যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, তার উল্টো দিকে নির্মাণাধীন নূর টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান এর আগে নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছিলেন। গণমাধ্যমে তাঁর বর্ণনা জেনে পুলিশ তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ফল আগের মতোই, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলেনি। লুৎফর পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই রাতে একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির ধাক্কা লাগার শব্দ তিনি শুনেছেন। ঘুমের প্রস্তুতিতে থাকায় হৈচৈ শুনলেও কিছু বুঝতে পারেননি। আর ঘটনাটি টিনের বেড়ার ওপাশে ঘটায় তা তিনি দেখতে পাননি।
কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের সময় পুলিশের একজন এসআই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ছিনতাইকারী ভেবে প্রথমে ওই কর্মকর্তা পেছন দিক থেকে একজনের কলার চেপে ধরেন। পরে উপস্থিতদের পরিচয় পেয়ে ও ভিন্ন কিছু বুঝতে পেরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তিনি ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে জলখাবার হোটেলের সামনে মোটরসাইকেল রেখে এসে আবার হেঁটে সেখানে ফিরে যান। তিনি ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি অবহিত করেছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিয়াস আলীর অপহরণকারী হিসেবে যে ধরনের গ্রুপকে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের ব্যস্ততম রাস্তায় মিশন শেষ করতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি সময় নেওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনা দেখে হেঁটে পেট্রল পাম্পসংলগ্ন জলখাবার হোটেলে গিয়ে জানানোর পর ওই পুলিশ কর্মকর্তা হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো এবং তর্কে লিপ্ত হওয়ার বর্ণনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতটা সময় ধরে ঘটনা চলার কোনো আলামত সেখানে মেলেনি। অন্যদিকে সশস্ত্র পুলিশ হলে অপহরণকারীদের কাছে গিয়ে কলার চেপে ধরে তর্ক করা, অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসে উঁকি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস ও বিশেষ পরিচয়পত্র দেখার সুযোগ পাওয়ারও কথা নয়। আর নিরস্ত্র পুলিশ হলে একা ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়ারও কথা নয়। সব মিলিয়ে প্রতিবেদনগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় গোপন করাটাই রহস্যজনক। অনেক সংবাদকর্মী এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বনানী থানার এএসআই মাহবুবের নাম বলেছেন।
বনানী থানার এসআই সাইদুর রহমান এ প্রসঙ্গে জানান, ২ নম্বর সড়কে গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এএসআই মাহবুব বেতারবার্তায় বিষয়টি থানায় জানিয়েছিলেন। পরে গাড়ি উদ্ধারসহ তদন্তকাজেও অংশ নেন। অসুস্থতার কারণে তিন-চার দিন আগে মাহবুব ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন। সম্ভবত এতেই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি চৌধুরী লুৎফুল কবীর বলেন, 'বিভিন্ন মাধ্যমে এ ঘটনার ব্যাপারে যে ধরনের তথ্য ও বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তার সবই যাচাই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ রকম দুজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদারের বক্তব্য শোনা হয়েছে। তাঁদের বর্ণনায় মিল নেই। তথ্যগুলোরও সমর্থন পাওয়া যায়নি। আর পুলিশের কেউ এ ধরনের ঘটনা দেখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। ওই দিন ইলিয়াস আলীর ব্যবহার করা গাড়িটি উদ্ধারের পর বনানী থানার ওসি একটি জিডি করেন। এ ছাড়া ঘটনাসংশ্লিষ্ট আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তার জিডি নেই। যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের ঘটনা দেখতেন তাহলে নূ্যনতম আলামত থানার নথিতে থাকত এবং আমরা তা জানতে পারতাম।'
সব কিছু মিলিয়ে গতকাল শুক্রবার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চললেও এখন পর্যন্ত তাঁর নিখোঁজ ঘটনারই কূল-কিনারা পাওয়া যায়নি। কিভাবে কারা তাঁকে অপহরণ করেছে, সে ব্যাপারে নূ্যনতম তথ্য না পেলে ভিকটিমকে উদ্ধার করা কঠিন। ঘনিষ্ঠজনদের সহযোগিতার অভাব ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ঘাটতির জন্য অনুসন্ধানকাজে বিলম্ব হচ্ছে বলেও তাঁরা দাবি করেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সম্ভব সব কিছুই করা হচ্ছে। দেশের সব থানায় এরই মধ্যে বার্তা পাঠানো হয়েছে। ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যেখানে যখন যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গেই যাচাই করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ দুজনের সন্ধান মেলেনি।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, সাবেক এই সংসদ সদস্যের নিখোঁজ বিষয়ে অনুসন্ধানে পুলিশকে সহায়তার জন্য র্যাবের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। তাঁর সন্ধান পেতে র্যাব সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ঘটনার সম্ভাব্য কারণ যাচাই এবং জড়িতদের ব্যাপারে ধারণা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। নিখোঁজ ঘটনাটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জটিলও। সে ক্ষেত্রে সব কিছু যাচাই করতে সময় কিছুটা বেশি লাগছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অপহৃত হওয়ার দুই দিন আগে ইলিয়াস আলী সিলেটে গিয়েছিলেন। তিনি একটি মামলায় হাজিরার জন্য সেখানে যান বলে ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। তবে তিনি দুই দিনে সিলেটের একাধিক হোটেলে বৈঠক করেছেন। এসব গোপন বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ও অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় কারা ফিরেছেন সে ব্যাপারেও তথ্য নেওয়া হচ্ছে। নিখোঁজ ঘটনার আগের বিষয়গুলোই ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে এই অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ইতিমধ্যে অনেকে দাবি করলেও তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা মিলছে না বলেও তদন্ত কর্মকর্তারা জানান। গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন তথ্য ও অপহরণ ঘটনার বর্ণনা যাচাই করে কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তকালে ধারণালাভে সহায়ক হলেও তথ্যগুলো আপাতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদারদের বর্ণনায় অনেক গরমিল পাওয়া যাচ্ছে।
গত কয়েক দিনে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদারদের বর্ণনা অনুসারে, বনানী ২ নম্বর সড়কে রাত সোয়া ১২টার দিকে ইলিয়াস আলীর প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ায় প্রথমে তা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা হয়। এরপর অপহরণকারীরা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। অপহরণকারীরা ইলিয়াস আলীকে গালাগালও করে। ইলিয়াস আলী 'বাঁচাও, বাঁচাও' বলে চিৎকার করেন। পার্কে ঘুমানো একজন ডাব বিক্রেতা ও নির্মাণাধীন ভবনের প্রহরী অপহরণ ঘটনার শুরু থেকেই অনেক কিছু দেখেছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডাব বিক্রেতা সোহেল গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন যে হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। 'একটি লোক'কে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। চার ব্যক্তি গাড়িতে উঠানোর সময় লোকটিকে কিলঘুষিও মারে। গাড়িতে উঠিয়ে তাঁকে বনানী ১ নম্বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল রাত সোয়া ১২টার দিকে বনানীর ২ নম্বর সড়কে এ রকম দৃশ্য বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে অপহরণের ঘটনাকে সমর্থন করে। সোহেল ছবি দেখে অপহৃত ব্যক্তি ইলিয়াস আলী বলে দাবি করেছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত তাঁর সাক্ষাৎকারের সূত্রে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে এ বর্ণনায় যথেষ্ট গরমিল খুঁজে পায়। পার্কের যে স্থানে ঘুমিয়ে ছিলেন বলে সোহেল দাবি করেছেন, সেখান থেকে যে দূরত্বে ঘটনা ঘটেছে তা ঘুম থেকে জেগে উঠে স্পষ্টভাবে দেখা অনেকটাই অবিশ্বাস্য। আবার খুব কাছে থেকে কেউ ঘটনা দেখলে তাকেও অপহরণকারীরা সহজে ছেড়ে দিত না। সোহেল তাঁর পাশে আরেকজন ঘুমাচ্ছিল বলেও দাবি করেছেন। কিন্তু তার পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার বনানী থানায় সোহেলকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে 'বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা' পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, বনানীর ২ নম্বর সড়কের এক পাশে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অন্য পাশে নির্মাণাধীন ভবন নূর টাওয়ার। নূর টাওয়ারের সামনেই একটি ছোট্ট পার্ক। ইলিয়াস আলীর গাড়ি রাস্তার মাঝে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ওই পথে যাতায়াতকারী কয়েকটি গাড়ি আটকা পড়ে। সংবাদ পেয়ে পুলিশও সেখানে যায় এবং গাড়ি স্কুলের দিকে সরিয়ে নেয়। সোহেল সম্ভবত সে দৃশ্যের কোনো অংশ দেখে এ ধরনের বর্ণনা দিচ্ছেন।
ওদিকে ইলিয়াস আলীর গাড়ি যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, তার উল্টো দিকে নির্মাণাধীন নূর টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান এর আগে নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছিলেন। গণমাধ্যমে তাঁর বর্ণনা জেনে পুলিশ তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ফল আগের মতোই, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলেনি। লুৎফর পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই রাতে একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির ধাক্কা লাগার শব্দ তিনি শুনেছেন। ঘুমের প্রস্তুতিতে থাকায় হৈচৈ শুনলেও কিছু বুঝতে পারেননি। আর ঘটনাটি টিনের বেড়ার ওপাশে ঘটায় তা তিনি দেখতে পাননি।
কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের সময় পুলিশের একজন এসআই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ছিনতাইকারী ভেবে প্রথমে ওই কর্মকর্তা পেছন দিক থেকে একজনের কলার চেপে ধরেন। পরে উপস্থিতদের পরিচয় পেয়ে ও ভিন্ন কিছু বুঝতে পেরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তিনি ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে জলখাবার হোটেলের সামনে মোটরসাইকেল রেখে এসে আবার হেঁটে সেখানে ফিরে যান। তিনি ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি অবহিত করেছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিয়াস আলীর অপহরণকারী হিসেবে যে ধরনের গ্রুপকে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের ব্যস্ততম রাস্তায় মিশন শেষ করতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি সময় নেওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনা দেখে হেঁটে পেট্রল পাম্পসংলগ্ন জলখাবার হোটেলে গিয়ে জানানোর পর ওই পুলিশ কর্মকর্তা হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো এবং তর্কে লিপ্ত হওয়ার বর্ণনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতটা সময় ধরে ঘটনা চলার কোনো আলামত সেখানে মেলেনি। অন্যদিকে সশস্ত্র পুলিশ হলে অপহরণকারীদের কাছে গিয়ে কলার চেপে ধরে তর্ক করা, অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসে উঁকি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস ও বিশেষ পরিচয়পত্র দেখার সুযোগ পাওয়ারও কথা নয়। আর নিরস্ত্র পুলিশ হলে একা ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়ারও কথা নয়। সব মিলিয়ে প্রতিবেদনগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় গোপন করাটাই রহস্যজনক। অনেক সংবাদকর্মী এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বনানী থানার এএসআই মাহবুবের নাম বলেছেন।
বনানী থানার এসআই সাইদুর রহমান এ প্রসঙ্গে জানান, ২ নম্বর সড়কে গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এএসআই মাহবুব বেতারবার্তায় বিষয়টি থানায় জানিয়েছিলেন। পরে গাড়ি উদ্ধারসহ তদন্তকাজেও অংশ নেন। অসুস্থতার কারণে তিন-চার দিন আগে মাহবুব ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন। সম্ভবত এতেই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি চৌধুরী লুৎফুল কবীর বলেন, 'বিভিন্ন মাধ্যমে এ ঘটনার ব্যাপারে যে ধরনের তথ্য ও বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তার সবই যাচাই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ রকম দুজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদারের বক্তব্য শোনা হয়েছে। তাঁদের বর্ণনায় মিল নেই। তথ্যগুলোরও সমর্থন পাওয়া যায়নি। আর পুলিশের কেউ এ ধরনের ঘটনা দেখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। ওই দিন ইলিয়াস আলীর ব্যবহার করা গাড়িটি উদ্ধারের পর বনানী থানার ওসি একটি জিডি করেন। এ ছাড়া ঘটনাসংশ্লিষ্ট আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তার জিডি নেই। যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের ঘটনা দেখতেন তাহলে নূ্যনতম আলামত থানার নথিতে থাকত এবং আমরা তা জানতে পারতাম।'
No comments