বন্য প্রাণী-একটি বাঘের মূল্য by খসরু চৌধুরী
২০০১ সালের জানুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যাবেলা। সারা দিন সুন্দরবনে হাড়ভাঙা খাটুনির পর গরম জলে স্নান সেরে মংলার পশুর মোটেলের লাউঞ্জে বসে ডিনারের অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমাদের স্পিডবোটের চালক এগিয়ে এসে আস্তে করে আমাকে বলল, ‘স্যার, রুমে আসেন, কথা আছে।’
নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বেধেছে। রুমে ঢুকে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার?’
বোটের চালক বেশ উত্তেজনার সঙ্গে বলল, ‘বাঘের চামড়া কিনবেন?’ শুনে থমকে গেলাম। ছাগ-বাঘ যা-ই হোক কোনো বন্য বা পোষা প্রাণীর চামড়ার প্রতি আমার সামান্যতম আগ্রহও নেই। নিরাপদ দূরত্বে থেকে অন্তত তিন-চারবার আমি বাঘ মারতে পারতাম। নিরাপদ বলছি এ জন্য, আমি স্পিডবোটে বসে আট ফুট দূরত্বে অথবা বোটে বসে ২০ ফুট দূরত্বে বাঘ পেয়েছি। গুলিতে আহত হলেও বাঘ আমার কিছু করতে পারত না। মৃত এই মহান প্রাণীটির ওপর বন্দুক রেখে একটি পা তার ওপর তুলে দিয়ে হাস্যমুখে ফটো খিঁচতে পারতাম। পত্রিকায় ছাপিয়ে বা দেয়ালে টাঙিয়ে বেশ বাহবাও পেতাম।
চালককে না বলে দেব—হঠাৎ মাথায় চাপল; আমি তো সাংবাদিকও, বাঘের চামড়া বেচাকেনার ওপর একটা তদন্ত প্রতিবেদন করছি না কেন!
বললাম, ‘দাম কত?’
‘দুইটা আছে, ছোটটার দাম ৩০০ ডলার, বড় একটা আছে, ৫০০ ডলার।’
‘চামড়া তোমার কাছে আছে?’
লজ্জিতভাবে বলল, ‘না স্যার, চামড়া বেচার পার্টি আছে।’
‘ওরা ভাবল কেন, আমি চামড়া কিনতে পারি?’
‘আপনি তো সাহেবদের (সাদা চামড়ার লোক) সঙ্গে জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেন। ভাবছে, আপনি কিনতে পারেন, বললে সাহেবরাও কিনতে পারে। এদের একজন আমার দেশি। বললে চামড়া নিয়ে হোটেলে আসবে দুজন।’
‘এদের একজনকে কাল আসতে বলো, চামড়া যেন সঙ্গে না আনে।’
চালক ফিরে গেলে ঢাকায় ডেইলি স্টার-এ বার দুই চেষ্টা করেও সংযোগ পেলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল খুলনার সাংবাদিক মানিক সাহার কথা (পরে যিনি ঘাতকের বোমায় নিহত হন)। তাঁর পরামর্শ কাজে লাগবে। ফোনে তাঁকে পেয়ে বিস্তারিত বললাম। মানিকদা আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘খবরদার, আপনি এদের সঙ্গে জড়াবেন না। অন্য কেউ হলে বলতাম, ঠিক আছে প্রতিবেদন করেন। কিন্তু আপনি তো সারা বছর জঙ্গলে আসেন। এরা ভিসিয়াস সার্কেল, আপনাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। পুলিশে খবর দিয়ে লাভ নেই, সেখানে এদের লোক আছে। বন বিভাগকে বলতে পারেন—কিন্তু আপনি তো পার পাচ্ছেন না। এদের না খেপিয়ে মানে মানে বিদায় করেন।’
পরের দিন সন্ধ্যায় চালকের সঙ্গে আসা বাদুড়ে টুপি র্যাপার জড়ানো লোকটিকে ঘরে বসালাম। অস্বস্তি বোধ করছিল। পরিস্থিতি হালকা করতে লোকটিকে এক কৌটা বিয়ার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চামড়ার দাম এত কম, বাঘের চামড়া তো?’
কথায় কথায় লোকটি জানাল, ছোট চামড়াটি খুব ছোট না। বাঘটি মারা হয়েছে শরণখোলা রেঞ্জে। চামড়ায় এলজির ছররায় কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে যাওয়ায় দাম কম। বড়টি মারা হয়েছে নলিয়ান রেঞ্জে। কুকুর মেরে সেটির শরীর কেটে কেটে চামড়ার ভেতরে পলিথিনের মোড়কে এনড্রিন ঢুকিয়ে বাঘের যাতায়াতের পথে রেখে দেওয়া হয়। পাশেই গর্ত করে মালসায় পানি রাখা হয়।
বাঘ মরা কুকুর খেতে খেতে মালসার পানি খেলে এনড্রিনের ঘাতক আক্রমণ শুরু হয়। আক্রান্ত বাঘ বেশি দূর যেতে পারে না। শিকারিরা পায়ের ছাপ দেখে সহজেই মরা বাঘ খুঁজে পেয়ে চামড়া ছাড়ায়। অটুট চামড়া লবণ, তুঁতে দিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নেয়। এই চামড়া কয়েক হাত হয়ে দালালদের হাতে আসে। চামড়ার মূল ক্রেতা গ্রিসান জাহাজের নাবিকেরা। তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলারে চামড়া বিক্রি হয়। কোরিয়া ও চীনের নাবিকেরাও চামড়া কেনে। সে সময় যৌথ বাহিনীর চাপ, বন্দরে জাহাজ না আসার কারণে অল্প দামেই এরা চামড়া বিক্রি করবে। কারণ, লবণ ও তুঁতে দিয়ে শুকানো চামড়ার লোম কিছুদিনের মধ্যেই খসে পড়তে থাকে। ঢাকায় নিয়ে ট্যানারিতে ট্যান করাতে ১৫-২০ হাজার টাকা লাগে। আমি চাইলে আমার বাসার ঠিকানায় এরা চামড়া পৌঁছে দিয়ে সেখানে দাম নিতে রাজি। স্টিমারে চেক করা হয় না বলে এরা স্টিমারে পৌঁছে দেবে। আরও জানতে পারলাম বানিয়াখালী, গোলখালী, সাতক্ষীরা এলাকায় যে শিকারির দল আছে, তারা নিজেরাই চামড়া বিক্রি করে। গ্রাম্য গরিব শিকারি বা ডাকাতের হাতে বাঘ মারা পড়লে সেগুলো দালালদের হাতে আসে। দালালেরা বছরে সাত-আটটি চামড়া পায়।
লোকটির সঙ্গে কথা বলতে আমার চেনা দু-তিনজন চোরাই শিকারির সঙ্গে পরিচয়ের উল্লেখ করেছিলাম বলে তথ্যগুলো পাওয়া গেল। লোকটিকে জানালাম, ‘আমার আগ্রহ নেই, সায়েবরা কেউ কিনলে জানাব।’
ওই ঘটনার পর থেকে যতবারই সুন্দরবনে গিয়েছি, যখনই সুযোগ পেয়েছি স্থানীয় বন বিভাগের লোকজন, চোরাই শিকারি জঙ্গলপাড়ের বন্ধুবান্ধবের কাছে জানতে চেষ্টা করেছি সুন্দরবনে বছরে কটি বাঘ মানুষের হাতে মারা পড়ে। সঠিক হিসাব কারও কাছেই নেই। তবে অধিকাংশের ধারণা, বর্তমানে শিকারিদের হাতে বাঘ কম মারা পড়লেও বছরে অন্তত সাত-আটটি বাঘ মারা পড়ে। লোকালয়ে ঢুকে বছরে গড়ে তিনটি বাঘের মৃত্যু হয়। মোট ১১টি বাঘ অপমৃত্যুর শিকার হয়।
আমরা এখনো জানি না, আমাদের এলাকার সুন্দরবনে কটি বাঘ আছে। কটি বাঘ জন্মের পর বেঁচে থাকে, স্বাভাবিক মৃত্যু হয় কটি বাঘের। আর এই অপমৃত্যু বাঘের সংখ্যার হারকে কতটা প্রভাবিত করে সেটাও আমাদের অজানা।
এ বছর বিশ্বব্যাংক এগিয়ে এসেছে বাঘ রক্ষার্থে। পৃথিবীর ১৩টি বাঘ-অধ্যুষিত দেশে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার জন্য বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে।
কর্মটি সম্পন্ন হবে ২০২০ সালের মধ্যে। বিশ্বব্যাংকের এই উদ্যোগ নেওয়ার কারণ হলো, কয়েক বছর আগেও যেখানে ধারণা করা হতো পৃথিবীতে বন্য অবস্থায় পাঁচ হাজার বাঘ আছে, বর্তমানে সে সংখ্যা কমে তিন হাজার ২০০-তে নেমেছে।
১৯৭৩ সালে ভারতে যখন বাঘ প্রকল্প চালু হলো, তখন বাঘ মারা হতো শুধু চামড়ার জন্য। আজকে চৈনিক ঐতিহ্যবাহী ওষুধের তীব্র চাহিদায় বাঘের হাড়, মাংস, রক্ত, লিঙ্গ, গোঁফ দক্ষিণ এশীয় বাজারে বহুমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এই চাহিদা এমন যে মনে হয় না কখনো শেষ হবে। ওষুধ হিসেবে এর বৈজ্ঞানিক কার্যকারিতা প্রমাণিত না হলেও বাঘের জারকমদ্য, বাম, স্যুপ, পিল সম্পর্কে এমন সংগঠিত প্রচারণা চালানো হয় যে, বাত থেকে আমাশয় পর্যন্ত বাঘনির্যাস সর্বরোগহর। হংকং, তাইওয়ান, চীনের বাজারভর্তি এখন বাঘ-ওষুধে। এগুলো আরও বেশি বিক্রি হয় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার চায়না টাউনে। বাঘের চামড়া উদ্ধার সহজ। সহজেই চেনা যায়। কিন্তু হাড়গোড়, রক্ত-মাংস চিনতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য দরকার। এই কু-ব্যবসার দাপটে শুধু ভারতেই প্রতি ১৮ ঘণ্টায় একটি বাঘ মারা পড়ে।
ভারত থেকে আমাদের দেশের দূরত্ব বেশি নয়। একই সমস্যায় ভুগছি আমরা—দারিদ্র্য। দেশে হয়তো এখনো বাঘ আছে, পয়েন্ট পরিণামে আছে। কিন্তু বৈশ্বিক এই চাপ আমাদের মতো পরিবেশ অবহেলার দেশ কত দিন সামলাতে পারবে?
খসরু চৌধুরী: লেখক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ।
বোটের চালক বেশ উত্তেজনার সঙ্গে বলল, ‘বাঘের চামড়া কিনবেন?’ শুনে থমকে গেলাম। ছাগ-বাঘ যা-ই হোক কোনো বন্য বা পোষা প্রাণীর চামড়ার প্রতি আমার সামান্যতম আগ্রহও নেই। নিরাপদ দূরত্বে থেকে অন্তত তিন-চারবার আমি বাঘ মারতে পারতাম। নিরাপদ বলছি এ জন্য, আমি স্পিডবোটে বসে আট ফুট দূরত্বে অথবা বোটে বসে ২০ ফুট দূরত্বে বাঘ পেয়েছি। গুলিতে আহত হলেও বাঘ আমার কিছু করতে পারত না। মৃত এই মহান প্রাণীটির ওপর বন্দুক রেখে একটি পা তার ওপর তুলে দিয়ে হাস্যমুখে ফটো খিঁচতে পারতাম। পত্রিকায় ছাপিয়ে বা দেয়ালে টাঙিয়ে বেশ বাহবাও পেতাম।
চালককে না বলে দেব—হঠাৎ মাথায় চাপল; আমি তো সাংবাদিকও, বাঘের চামড়া বেচাকেনার ওপর একটা তদন্ত প্রতিবেদন করছি না কেন!
বললাম, ‘দাম কত?’
‘দুইটা আছে, ছোটটার দাম ৩০০ ডলার, বড় একটা আছে, ৫০০ ডলার।’
‘চামড়া তোমার কাছে আছে?’
লজ্জিতভাবে বলল, ‘না স্যার, চামড়া বেচার পার্টি আছে।’
‘ওরা ভাবল কেন, আমি চামড়া কিনতে পারি?’
‘আপনি তো সাহেবদের (সাদা চামড়ার লোক) সঙ্গে জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেন। ভাবছে, আপনি কিনতে পারেন, বললে সাহেবরাও কিনতে পারে। এদের একজন আমার দেশি। বললে চামড়া নিয়ে হোটেলে আসবে দুজন।’
‘এদের একজনকে কাল আসতে বলো, চামড়া যেন সঙ্গে না আনে।’
চালক ফিরে গেলে ঢাকায় ডেইলি স্টার-এ বার দুই চেষ্টা করেও সংযোগ পেলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল খুলনার সাংবাদিক মানিক সাহার কথা (পরে যিনি ঘাতকের বোমায় নিহত হন)। তাঁর পরামর্শ কাজে লাগবে। ফোনে তাঁকে পেয়ে বিস্তারিত বললাম। মানিকদা আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘খবরদার, আপনি এদের সঙ্গে জড়াবেন না। অন্য কেউ হলে বলতাম, ঠিক আছে প্রতিবেদন করেন। কিন্তু আপনি তো সারা বছর জঙ্গলে আসেন। এরা ভিসিয়াস সার্কেল, আপনাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। পুলিশে খবর দিয়ে লাভ নেই, সেখানে এদের লোক আছে। বন বিভাগকে বলতে পারেন—কিন্তু আপনি তো পার পাচ্ছেন না। এদের না খেপিয়ে মানে মানে বিদায় করেন।’
পরের দিন সন্ধ্যায় চালকের সঙ্গে আসা বাদুড়ে টুপি র্যাপার জড়ানো লোকটিকে ঘরে বসালাম। অস্বস্তি বোধ করছিল। পরিস্থিতি হালকা করতে লোকটিকে এক কৌটা বিয়ার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চামড়ার দাম এত কম, বাঘের চামড়া তো?’
কথায় কথায় লোকটি জানাল, ছোট চামড়াটি খুব ছোট না। বাঘটি মারা হয়েছে শরণখোলা রেঞ্জে। চামড়ায় এলজির ছররায় কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে যাওয়ায় দাম কম। বড়টি মারা হয়েছে নলিয়ান রেঞ্জে। কুকুর মেরে সেটির শরীর কেটে কেটে চামড়ার ভেতরে পলিথিনের মোড়কে এনড্রিন ঢুকিয়ে বাঘের যাতায়াতের পথে রেখে দেওয়া হয়। পাশেই গর্ত করে মালসায় পানি রাখা হয়।
বাঘ মরা কুকুর খেতে খেতে মালসার পানি খেলে এনড্রিনের ঘাতক আক্রমণ শুরু হয়। আক্রান্ত বাঘ বেশি দূর যেতে পারে না। শিকারিরা পায়ের ছাপ দেখে সহজেই মরা বাঘ খুঁজে পেয়ে চামড়া ছাড়ায়। অটুট চামড়া লবণ, তুঁতে দিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নেয়। এই চামড়া কয়েক হাত হয়ে দালালদের হাতে আসে। চামড়ার মূল ক্রেতা গ্রিসান জাহাজের নাবিকেরা। তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলারে চামড়া বিক্রি হয়। কোরিয়া ও চীনের নাবিকেরাও চামড়া কেনে। সে সময় যৌথ বাহিনীর চাপ, বন্দরে জাহাজ না আসার কারণে অল্প দামেই এরা চামড়া বিক্রি করবে। কারণ, লবণ ও তুঁতে দিয়ে শুকানো চামড়ার লোম কিছুদিনের মধ্যেই খসে পড়তে থাকে। ঢাকায় নিয়ে ট্যানারিতে ট্যান করাতে ১৫-২০ হাজার টাকা লাগে। আমি চাইলে আমার বাসার ঠিকানায় এরা চামড়া পৌঁছে দিয়ে সেখানে দাম নিতে রাজি। স্টিমারে চেক করা হয় না বলে এরা স্টিমারে পৌঁছে দেবে। আরও জানতে পারলাম বানিয়াখালী, গোলখালী, সাতক্ষীরা এলাকায় যে শিকারির দল আছে, তারা নিজেরাই চামড়া বিক্রি করে। গ্রাম্য গরিব শিকারি বা ডাকাতের হাতে বাঘ মারা পড়লে সেগুলো দালালদের হাতে আসে। দালালেরা বছরে সাত-আটটি চামড়া পায়।
লোকটির সঙ্গে কথা বলতে আমার চেনা দু-তিনজন চোরাই শিকারির সঙ্গে পরিচয়ের উল্লেখ করেছিলাম বলে তথ্যগুলো পাওয়া গেল। লোকটিকে জানালাম, ‘আমার আগ্রহ নেই, সায়েবরা কেউ কিনলে জানাব।’
ওই ঘটনার পর থেকে যতবারই সুন্দরবনে গিয়েছি, যখনই সুযোগ পেয়েছি স্থানীয় বন বিভাগের লোকজন, চোরাই শিকারি জঙ্গলপাড়ের বন্ধুবান্ধবের কাছে জানতে চেষ্টা করেছি সুন্দরবনে বছরে কটি বাঘ মানুষের হাতে মারা পড়ে। সঠিক হিসাব কারও কাছেই নেই। তবে অধিকাংশের ধারণা, বর্তমানে শিকারিদের হাতে বাঘ কম মারা পড়লেও বছরে অন্তত সাত-আটটি বাঘ মারা পড়ে। লোকালয়ে ঢুকে বছরে গড়ে তিনটি বাঘের মৃত্যু হয়। মোট ১১টি বাঘ অপমৃত্যুর শিকার হয়।
আমরা এখনো জানি না, আমাদের এলাকার সুন্দরবনে কটি বাঘ আছে। কটি বাঘ জন্মের পর বেঁচে থাকে, স্বাভাবিক মৃত্যু হয় কটি বাঘের। আর এই অপমৃত্যু বাঘের সংখ্যার হারকে কতটা প্রভাবিত করে সেটাও আমাদের অজানা।
এ বছর বিশ্বব্যাংক এগিয়ে এসেছে বাঘ রক্ষার্থে। পৃথিবীর ১৩টি বাঘ-অধ্যুষিত দেশে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার জন্য বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে।
কর্মটি সম্পন্ন হবে ২০২০ সালের মধ্যে। বিশ্বব্যাংকের এই উদ্যোগ নেওয়ার কারণ হলো, কয়েক বছর আগেও যেখানে ধারণা করা হতো পৃথিবীতে বন্য অবস্থায় পাঁচ হাজার বাঘ আছে, বর্তমানে সে সংখ্যা কমে তিন হাজার ২০০-তে নেমেছে।
১৯৭৩ সালে ভারতে যখন বাঘ প্রকল্প চালু হলো, তখন বাঘ মারা হতো শুধু চামড়ার জন্য। আজকে চৈনিক ঐতিহ্যবাহী ওষুধের তীব্র চাহিদায় বাঘের হাড়, মাংস, রক্ত, লিঙ্গ, গোঁফ দক্ষিণ এশীয় বাজারে বহুমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এই চাহিদা এমন যে মনে হয় না কখনো শেষ হবে। ওষুধ হিসেবে এর বৈজ্ঞানিক কার্যকারিতা প্রমাণিত না হলেও বাঘের জারকমদ্য, বাম, স্যুপ, পিল সম্পর্কে এমন সংগঠিত প্রচারণা চালানো হয় যে, বাত থেকে আমাশয় পর্যন্ত বাঘনির্যাস সর্বরোগহর। হংকং, তাইওয়ান, চীনের বাজারভর্তি এখন বাঘ-ওষুধে। এগুলো আরও বেশি বিক্রি হয় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার চায়না টাউনে। বাঘের চামড়া উদ্ধার সহজ। সহজেই চেনা যায়। কিন্তু হাড়গোড়, রক্ত-মাংস চিনতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য দরকার। এই কু-ব্যবসার দাপটে শুধু ভারতেই প্রতি ১৮ ঘণ্টায় একটি বাঘ মারা পড়ে।
ভারত থেকে আমাদের দেশের দূরত্ব বেশি নয়। একই সমস্যায় ভুগছি আমরা—দারিদ্র্য। দেশে হয়তো এখনো বাঘ আছে, পয়েন্ট পরিণামে আছে। কিন্তু বৈশ্বিক এই চাপ আমাদের মতো পরিবেশ অবহেলার দেশ কত দিন সামলাতে পারবে?
খসরু চৌধুরী: লেখক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ।
No comments