দিল্লির চিঠি-ভুলে ভরা কংগ্রেসের ইতিহাস by কুলদীপ নায়ার

ইতিহাসকে যদি শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণী বলি, তবু তা হতে হয় যথাযথ, পক্ষপাতহীন। ১২৫ বছর বয়সী কংগ্রেসের অর্জন কী, তা নিয়ে দলটির আনুষ্ঠানিক বিবরণী না সৎ, না তথ্যভিত্তিক। কংগ্রেস নেতারা কে কী বলেছিলেন, তা হয়তো ভারতবাসী ভুলে যাবে, কিন্তু তাঁরা যা করেছেন, তা তো কোনো দিন ভোলার নয়।


কংগ্রেসের ওপর সবচেয়ে বড় কলঙ্কের দাগ পড়েছে জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করে দেওয়ার সময় (১৯৭৫-১৯৭৭)। আমি নিজেও সেসব দিনের সাক্ষী। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, প্রভাবশালী বিরোধী মত দলন এবং বিনা বিচারে লক্ষাধিক মানুষকে বন্দী করার মতো ঘটনা আমি দেখেছি। আশা করেছিলাম, কংগ্রেস তার অবৈধ ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য ভারতবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবে। উল্টো তারা বলছে, জরুরি আইন জারিকে জনগণ স্বাগত জানিয়েছিল। দলীয় ইতিহাসে এমন কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। অথচ সত্যি হচ্ছে, তখন গণতন্ত্রের পথ অকার্যকর হয়ে পড়া নিয়ে জনগণের মধ্যে কতই না আক্ষেপ ছিল। প্রথমদিকে জনগণ প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ার আবহ; তার পর অনুভূতিহীনতা—সরকারের কার্যকলাপের সত্যিকার তাৎপর্য বুঝে উঠতে না পারা।
কিন্তু কংগ্রেস কেমন করে সঞ্জয় গান্ধীর ওপর সব দায় চাপিয়ে দিতে পারল? সঞ্জয়ই যে তখন সরকার চালাচ্ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সঞ্জয়ের কার্যকলাপের পেছনে তাঁর মা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদন ছিল।
সঞ্জয় ও ইন্দিরা উভয়ের সহযোগী হিসেবে তখন কাজ করেছেন আর কে ধাওয়ান। কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির এই সদস্য কংগ্রেসের দলীয় ইতিহাসের বিষয়ে যথার্থই বলেছেন: ইন্দিরা এত সবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে তখনকার দায়দায়িত্ব সঞ্জয় গান্ধীর কাঁধে চাপানো ঠিক হবে না।
ইন্দিরা ক্ষমতা ছাড়তে চাননি, তাই জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। এ কথা কারও অজানা নয়। নির্বাচনের কাজে রাষ্ট্রযন্ত্র অপব্যবহারের অভিযোগে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরাকে ছয় বছরের জন্য ক্ষমতায় বসার অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। কংগ্রেসের প্রকাশিত বইয়ে এই রায়ের কোনো উল্লেখ পর্যন্ত নেই। আরেকটি বিষয় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে: রাষ্ট্রপতিকে জরুরি আইন জারি করার পরামর্শ দিয়ে লেখা চিঠিটিও ইন্দিরা স্বাক্ষর করেননি। এমনকি তাঁর দেখানো নিরাপত্তাহীনতার যুক্তিও ঠিক নয়—বেরিয়ে এসেছে শাহ কমিশনের অনুসন্ধানে।
কমিশন বলেছে, ‘বহিস্থ কিংবা অভ্যন্তরীণ কোনো দিক থেকেই দেশ ঝুঁকিতে ছিল না। ঝুঁকিতে থাকার পক্ষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বা অন্য কেউ সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির না করার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে “দেশের ভেতর জরুরি অবস্থা” জারির ঘোষণা দিতে রাষ্ট্রপতিকে বিশেষ প্রস্তাব পেশ করার পেছনে যে প্রণোদনা কাজ করেছে, তা হলো এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায়ে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতিপরায়ণ নির্বাচনী আচরণের কারণে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার ফলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের ভেতরে শুরু হওয়া তীব্র রাজনৈতিক তৎপরতা। যে রাজনৈতিক জাগরণ তখন দেখা দিয়েছিল, তা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হলে স্বাভাবিক নিয়মে একসময় প্রশমিত হয়ে যেত না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারবেন কি না, সেই অনিশ্চয়তার কারণে শ্রীমতী গান্ধী এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন, যা তাঁর ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখল। আর এমন সব বাহিনী তৈরি করা হলো, যা অল্প কিছু ব্যক্তির স্বার্থে বিসর্জন দিল বৃহতের স্বার্থ।
কী অদ্ভুত মিল দেখা গেল সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চের দেওয়া রায়ে। তাঁরা বললেন, জরুরি আইনের অধীনে ইন্দিরা গান্ধীর শাসন অনুমোদন করে দেওয়া ১৯৭৬ সালের রায় বিপুলসংখ্যক মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে। তখনকার ৪-১ ভোটের বিচারকে দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেছেন ‘ভ্রান্ত’। পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চের রায়টিকে দুই বিচারপতির ঘোষণা ডিঙিয়ে যেতে পারবে না, এটা স্পষ্ট। কিন্তু সরকারের তরফে রায় পর্যালোচনার আপিল পেশ করার সময় এসেছে। আইনমন্ত্রী ভিরাপ্পা মইলিকে লোকে আদর্শবান বলে জানে। জাতির কাছে তাঁর দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৭৬-এর বিচার বাতিল করতে এখনই আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা, যেন সেদিন কার কী ভূমিকা ছিল, তা বেরিয়ে আসে। আর যতই উচ্চপদস্থ আর ক্ষমতাশালী হোক না কেন, কেউ যেন ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য নিয়ে খেলতে না পারেন।
জরুরি আইনের অধীনে অসৎ উদ্দেশ্যে দেওয়া আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করা যেত না—এমনটা অবিশ্বাস্য ছিল। বিচারপতি এইচ আর খান্না সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছিলেন। তাঁর রায় ছিল, ‘জরুরি অবস্থার মধ্যেও কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জীবন বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে আইনবহির্ভূতভাবে বঞ্চিত করার কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। সব সভ্য সমাজে এটা আইনের শাসনের স্বীকৃত সত্য।’ ভারতের প্রধান বিচারপতি হওয়ার জন্য একসময় তাঁর পালা এল। ইন্দিরা তাঁকে প্রধান বিচারপতি করলেন না। কংগ্রেসের ইতিহাসে এসবের জায়গা হলো না।
নিঃসন্দেহে কংগ্রেস এখন অনেক চাপে রয়েছে। অজস্র দুর্নীতির গোমর ফাঁস হচ্ছে, একটার পর একটা। এ সময়ে জরুরি অবস্থা বিষয়ে বিতর্কের সূচনা হলে দেশবাসীর মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরে যাবে, এমন নয়। এখানকার দুর্নীতির অভিযোগগুলোর ব্যাপারে যৌথ সংসদীয় কমিটির দ্বারা অনুসন্ধান করার কোনো বিকল্প নেই—এ সত্য সরকারের মেনে নিতেই হবে। টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির পেছনে এখন পর্যন্ত যেসব রাঘব-বোয়াল লুকিয়ে আছে, তাদের মুখোশ হয়তো খুলে দিতে সক্ষম হতে পারে এই কমিটি।
স্বাধীনতার পর থেকে ডান-বামনির্বিশেষে আর কোনো দাবির এত বিরোধিতা হয়নি। সরকার যত তা ঠেকাতে চাইবে, ততই তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগবে। নববর্ষের দিনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন নিরাশ না হয়। কিন্তু তাঁর এই আহ্বানের তেমন কোনো প্রভাব জনগণের ওপর পড়বে না। কেননা, জনগণ বুঝে গেছে যে সরকার জনগণের কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে, অনেক বড় কিছু।
জনজীবনে বিপর্যয় আর কংগ্রেস ও অন্যান্য দল ও গোষ্ঠীর ভেতরের অবক্ষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে বাড়ছে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা। এদের মূল প্রোথিত আছে রাজ্য, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষায়। মুখ্য বিষয়ের কথা ভুলে মানুষ গৌণ ব্যাপার নিয়ে মেতে থাকছে। ফলস্বরূপ দেশের সংহতি, শক্তি ও প্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় দরকার নতুন ভাবনা। স্লোগান বা মতবাদসর্বস্ব নয়, চাই আধুনিক জীবন ও মানবিক মূল্যবোধের মিশেলে তৈরি আদর্শবাদ।
কংগ্রেসের দলীয় ইতিহাসে তা খুঁজতে গিয়ে আমি পণ্ডশ্রম করেছি। বড় দুঃখের বিষয়, ১২৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটা দল সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে আসতে পারল না, সত্যনিষ্ঠ থেকে তুলে ধরতে পারল না অতীতের ঘটনা। দলটির কর্মকাণ্ড যে কেবল দলের স্বার্থে পরিচালিত নয়, সারা দেশবাসীর স্বার্থে—এবার জনগণের সামনে এ কথা তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ হারাল কংগ্রেস।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.