সুদান-বিভক্তির অন্তরালে তেলের রাজনীতি by লিন্ডা এস হার্ড
নতুন জাতীয় সংগীত আর নতুন পতাকা নিয়ে হাজির হয়েছে দক্ষিণ সুদান। নিজস্ব মুদ্রাও চালু করেছে কয়েক বছর হলো। কিন্তু নতুন দেশটির নাম কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক এখনো ফুরায়নি। অনেকগুলো নাম চাপা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আছে নাইল প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়া, জৌয়ামা, নিউ সুদান ও সাউথ সুদান।
তা হলেও নামকরণের চেয়ে বড় সমস্যার মুখে দেশটি। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির জাতিসংঘের চাপে রয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, দেশের তিন ভাগের এক ভাগ এবং তেলসম্পদের ৮০ ভাগ হারাতে হলেও দক্ষিণ সুদানের গণভোটের রায় তিনি মেনে নেবেন। সম্ভাবনা আছে যে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ সুদানের বর্তমান রাজধানী জুবা শহরটি ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাঁকে কিছু সুযোগ দিতে চাইবে। জুবার ওপর দাবি ছেড়ে দিলে তাঁর সরকারের ওপর থেকে মার্কিন অবরোধ এবং সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকা থেকেও সুদানের নাম উঠে যাবে। কিছু ঋণও মওকুফ করা হবে। এটাও সম্ভব যে আন্তর্জাতিক আদালত দারফুরে যুদ্ধাপরাধের জন্য বশিরের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাতে বাস্তবায়ন না করে, সেটাও দেখবে যুক্তরাষ্ট্র।
অবশ্য নির্বাচন শুরুর আগের মুহূর্তে বশির হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, তেলসমৃদ্ধ আবেইকে নতুন কোনো রাষ্ট্রের ভেতর নিয়ে নেওয়া হলে সেটাই হবে নতুন সংঘাতের সূচনা। আল-জাজিরা টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সে জন্যই আমরা চাই, আবেই যেমন আছে তেমন থাকুক। পুরোনো প্রশাসনই চলুক, যতক্ষণ না কোনো সমঝোতায় আমরা আসতে পারি।’
এরই মধ্যে খবর এসেছে, গণভোটের প্রস্তুতির সময়ে আবেইয়ে গণমুক্তি ফৌজের সঙ্গে খার্তুম-সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর সংঘাতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। হলিউড অভিনেতা জর্জ ক্লুনি তো বলেই ফেলেছেন, তিনি ঘরের মধ্যে ভোঁদড়ের গন্ধ পাওয়া শুরু করেছেন। তা হলেও উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে আরেকটি গৃহযুদ্ধ হয়তো এখনই শুরু হচ্ছে না।
একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জর্জ ক্লুনি গুগল, জাতিসংঘসহ অন্যান্য গণহত্যাবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে মিলে সুদানে সেনাদের স্থানান্তর ও উদ্বাস্তু মানুষের চলাচল স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নজরদারি করার একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করছেন। তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধাপরাধ যারা করবে, তাদের আমরা জানিয়ে দিতে চাই যে বিশ্ব তাদের ওপর নজর রাখছে।’
পশ্চিমারা দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় উৎফুল্ল। সেখানকার তেলের খনি তাদের এই আনন্দের উৎস। এভাবে তারা এমন এক ম্যাচবাক্স বানাচ্ছে, যা থেকে দাবানলও জ্বলে উঠতে পারে। খ্রিষ্টানপ্রধান দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু এলাকাকে একই রকম পথে উৎসাহী করে তুলতে পারে।
নাইজেরিয়ার সিভিল রাইটস কংগ্রেসের সভাপতি শেহু সানি মনে করেন, পশ্চিম আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশে খ্রিষ্টান ও মুসলিম জনবিভাজন থাকায় বিচ্ছিন্নতার হিড়িক চালু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বড় রাষ্ট্রকে ছোট ছোট কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করাকে বলা হয় বলকানাইজেশন। সাবেক বলকান রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়া ও যুগোস্লাভিয়াকে টুকরা টুকরা করা থেকে এই নামকরণ হয়েছে। দেখা গেছে, সব সময় এ ধরনের বলকানাইজেশন পাশ্চাত্যের স্বার্থেই হয়ে এসেছে। এখনো তাদের স্বার্থ একই আছে। এটা হলো সেই পুরোনো ‘ভাগ করো শাসন করার’ ব্রিটিশ নীতিরই পুনরাবৃত্তি। ঘানার সাবেক প্রেসিডেন্ট কওয়ামে নক্রুমা তাঁর নব্য উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শেষ স্তর বইয়ে এ বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। নক্রুমা মনে করেন, পশ্চিমা স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এই বলকানাইজেশন।
তেলের দাম যখন ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে উঠেছে, তখন ইউরোপ ও আমেরিকা অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকছে। এ রকম অবস্থায় সুদান ভেঙে তেলসমৃদ্ধ নতুন একটি রাষ্ট্র গঠন করা এবং সেই রাষ্ট্রকে নিজেদের পক্ষপুটে রাখা তাদের বিরাট সুবিধা দেবে।
কোনো কোনো বিশ্লেষকের ধারণা, ইরাকে আগ্রাসন চালানোও আসলে ইরাকের বলকানাইজেশনের নব্য রক্ষণশীল পরিকল্পনার অংশ। মার্কিন দখলাধীন ইরাকে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তাতে সেই কুসম্ভাবনা এখনো বিরাজমান। আমেরিকা দেশটি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ই সেটা ঘটতে পারে।
এখানে এটাও বলা দরকার, ২০০৬ সালে তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস ‘এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের’ কথা বলেছিলেন। সে সময় মার্কিন সমরপতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল র্যালফ পিটার্স সেই সময়ই তাঁদের পরিকল্পিত নতুন মধ্যপ্রাচ্যের একটি মানচিত্রও তাঁদের সামরিক জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন। তখন থেকেই সেটা ন্যাটোর ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সময় ব্যবহূত হয়ে আসছে।
সেই মানচিত্রে সৌদি আরবকে কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত অবস্থায় দেখানো হয়েছে। তার একটি হলো ‘পবিত্র ইসলামি রাষ্ট্র’, অন্যটি ‘সৌদি মাতৃভূমির স্বাধীন অঞ্চলসমূহ’। আর ইরাককে তিন ভাগে বিভক্ত এবং ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরকে জর্ডানের অংশ দেখানো হয়েছে।
১৯৮২ সালের দিকে ইসরায়েলের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাংবাদিক ওদেদ ওয়াইনন একটি দলিল প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘১৯৮০-এর দশকে ইসরায়েলের কর্মকৌশল’। সেখানে তিনি বলেন—
‘মিসরকে স্পষ্ট ভৌগোলিক বিভাজনে বিভক্ত করা ইসরায়েলের রাজনৈতিক লক্ষ্য...মিসর টুকরা টুকরা হয়ে গেলে লিবিয়া, সুদানসহ আরও দূরের রাষ্ট্রগুলোর পক্ষেও তাদের বর্তমান চেহারায় আর থাকা সম্ভব হবে না। মিসরের ওপরের দিকে একটি কপ্টিক খ্রিষ্টান রাষ্ট্র এবং তার পাশে ছোট ছোট আরও কিছু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এদের থাকবে খুবই সীমিত আঞ্চলিক ক্ষমতা...এসবই হলো ঐতিহাসিক বিকাশের অংশ...।’
ওয়াইননের চোখে সুদান হলো সবচেয়ে ‘আরব মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র, যেখানে চারটি গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংস বিবাদে লিপ্ত।’ আর আরব বিশ্ব হলো ‘এমন এক তাসের ঘর, যা বানিয়েছে বিদেশিরা (ব্রিটেন ও ফ্রান্স), যেখানে বেশির ভাগ আরব অধিবাসীর আকাঙ্ক্ষাকে মোটেই আমলে নেওয়া হয়নি।’
১৯১৬ সালে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পক্ষ থেকে দুই কূটনীতিক পিকট ও সাইকস গোটনে একটা চুক্তি করেন। সেই চুক্তিতে তাঁরা ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের ভাঙনের পর কীভাবে ফ্রান্স ও ব্রিটেন আরব অঞ্চলকে তাঁদের প্রভাবিত বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত করে নেবেন, তা ঠিক করেন। রাজতান্ত্রিক রাশিয়াও এতে সম্মতি দেয়।
ওয়াইননের ভবিষ্যদ্বাণী অমোঘ হিসেবে দেখা দেওয়ার আগেই আরবরা কি পারবে বৃহত্তর চিত্রটির দিকে তাকাতে? সুদানের বিভক্তি থেকে তারা কি পাঠ করবে কোনো অশুভ সংকেত? তারা কি টের পাচ্ছে, ১৯১৬ সালের মতো করে আবারও পিকট ও সাইকসের ভূতেরা এই উত্তপ্ত অঞ্চলকে বিভক্ত করার জন্য নেমেছে?
গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
লিন্ডা এস হার্ড: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
No comments