চাকরির সঙ্গে 'ফাও' স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি by অমিতোষ পাল

তিনি চাকরি করেন ঢাকা ওয়াসায়। পাশাপাশি স্ত্রীর নামে করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। সরকারি চাকরিবিধি অমান্য করে বছরের পর বছর এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকার কাজ। গত পাঁচ বছরে ঢাকা ওয়াসায় অন্তত ২০ কোটি টাকার কাজ করেছেন তিনি।


অভিযোগ রয়েছে, বিষয়টি জেনেও কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তাঁর বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত এই কর্মকর্তার নাম রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকা ওয়াসার বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত। কালের কণ্ঠের কাছে তিনি তাঁর একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকার কথা স্বীকার করলেও শুধু ঢাকা ওয়াসায় কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে তা গঠন করা হয়নি দাবি করে বলেছেন, 'এটা আমার স্ত্রীসহ আরো কয়েকজন করেছিল। এখন আর সেই লাইসেন্সে কেউ ব্যবসা করছে না। আমার স্ত্রীও আর তাদের সঙ্গে নেই।'
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তাকসিম এ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি জানি না এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কি না। যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে কেউ এ রকম ব্যবসা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমিও খোঁজ নিয়ে দেখছি ঘটনাটি সত্য কি না।'
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৭ ধারায় ব্যক্তিগত ব্যবসা অথবা চাকরি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, 'কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে তাঁহার পরিবারের কোন সদস্যকে তাঁহার এখতিয়ারাধীন এলাকায় কোন ব্যবসায়ে জড়িত হওয়ার অনুমতি প্রদান করিবেন না।'
নন গেজেটেড কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই শর্ত কিছুটা শিথিল করা হলেও সে ব্যাপারে উল্লেখ আছে, 'নন গেজেটেড কর্মচারী তাঁর পরিবারের সদস্যদের শ্রম কাজে লাগাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে সম্পত্তির ঘোষণাপত্রের সাথে ব্যবসার বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হবে।' অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প ফেজ-২-এর বিভিন্ন কাজের বিপরীতে এ পর্যন্ত ছয় কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার কাজ পেয়েছে রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা জেরিনের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ন্যাশনাল ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির কাগজপত্রে দেখা গেছে, ২০০০ সালের ২৪ অক্টোবর এটি গঠিত হয়। মালিক হিসেবে রয়েছে ফাতেমা জেরিনের নাম। স্বামীর নাম লেখা রয়েছে মো. রফিকুল ইসলাম। ঠিকানা : ২৮ হরিশ্চন্দ্র রায় রোড, ফরিদাবাদ, ঢাকা। জয়েন্ট স্টক কম্পানি থেকে দেওয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর সি-৪১৭০৬(১০৬৫)/২০০০।
জানা গেছে, ঠিকানাটি রফিকুল ইসলামের শ্বশুরবাড়ির। পরে গোল্ড ব্রিক হাউস (দ্বিতীয় তলা), ৪ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা- এই ঠিকানা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ন্যাশনাল ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড তিন দফায় পাম্প ক্রয়, দুই দফায় জেনারেটর ক্রয়সহ আরো অনেক ঠিকাদারি কাজ করেছে ঢাকা ওয়াসায়। প্রায় সব কয়টি কাজই কোটি টাকার কাছাকাছি, কখনো কোটি টাকার ওপরে। রফিকুল ইসলাম প্রভাব খাটিয়ে এসব কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার হিসাবরক্ষণ শাখার নথি থেকে দেখা গেছে, সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার নির্মাণের মাটি ভরাটকাজে ন্যাশনাল ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনকে ২০০৭ সালের ৯ অক্টোবর ৭০ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। একই বছরের ১৯ নভেম্বর সাইটে মাটি ভরাটকাজের বিপরীতে বিল দেওয়া হয়েছে ৬০ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। ২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিল দেওয়া হয়েছে ৬০ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ২০০৮ সালের ৪ মার্চ বিল দেওয়া হয়েছে ৮০ লাখ ৯ হাজার টাকা। একই বছরের ২ এপ্রিল বিল দেওয়া হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা। ৬ মে বিল দেওয়া হয়েছে ৮৫ লাখ পাঁচ হাজার টাকা এবং ২৪ জুন বিল দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৪৬ লাখ ২১ হাজার টাকা। ২০০৯ সালের ২৯ জুন বিল দেওয়া হয়েছে ৬২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-২-এর প্রকল্প পরিচালক মো. সিরাজউদ্দিনের স্বাক্ষরে হিসাব বিভাগ থেকে বিলগুলো পরিশোধ করা হয়েছে। সিরাজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি জানি না, এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে রফিকুল ইসলাম বা তাঁর স্ত্রী যুক্ত আছেন।'
ওয়াসার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয় গোপন রেখে জানান, মেসার্স ন্যাশনাল ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মালিক হিসেবে কাগজে-কলমে স্ত্রীর নাম থাকলেও মূলত রফিকুল ইসলামই সব কিছু দেখাশোনা করেন। তাঁর স্ত্রী হয়তো জানেনও না তিনি ওই কম্পানির মালিক। এই প্রতিবেদক এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা জেরিন কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
ওয়াসার ওই সব কর্মকর্তা-কর্মচারী আরো অভিযোগ করেন, বর্তমানে পুরো ঢাকা ওয়াসা 'র‌্যামস' (আরএএমএস) গ্রুপের কব্জায়। এই র‌্যামস গ্রুপেও আছেন রফিকুল ইসলাম (আর)। অন্যরা হলেন গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক দূষণ প্রতিরোধ প্রকল্পের পরিচালক তত্ত্বাধায়ক প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান (এ), প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মহসীন (এম) এবং সংগ্রহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার সাত্তার সবুজ (এস)। সংক্ষেপে সবাই তাঁদের র‌্যামস গ্রুপ হিসেবে সম্বোধন করে। ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ, পদায়ন, বদলি- সব কিছুই তাঁদের কথামতো হয় বলে ঠিকাদারদের অভিযোগ।
র‌্যামস গ্রুপের প্রধান হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'স্বামী চাকরি করলে স্ত্রী ওয়াসায় ব্যবসা করতে পারবেন না- এ ধরনের কোনো নিয়ম আছে কি না আমি জানি না। থাকলে ওয়াসা তো আগেই আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। কারণ আমার ব্যবসা করার কথা তো অনেকেই জানে।'
বর্তমানে তাঁর স্ত্রী ফাতেমা জেরিন ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর যুক্ত নেই বলে উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ওয়াসায় কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কম্পানি গঠন করা হয়নি। আর ওয়াসায় কাজও করেছি অল্প। যাক, এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেক দুঃখের কথা আছে। সেগুলো আর বলতে চাই না।

No comments

Powered by Blogger.